সেপ্টেম্বরে নাকি নিউ ইয়র্কের আবহাওয়া এরকমই থাকে। কখনো শীত, কখনো গরম আবার কখনো ঝুম বৃষ্টি, ছাতা ছাড়া চলাই ভার। ঠিক পরের দিনই ‘নিউ ইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’ নীল আকাশ। যেমনটি বলেছেন কালজয়ী লেখক হুমায়ূন আহমেদ। ক’দিন আগে এতটাই শীত ছিলো যে, অনেকেই রীতিমত শীতবস্ত্র ব্যবহার করেছেন। ঘরে হিটারও চলেছে একরাতে।
দু’দিন পরই এতটা গরম পড়লো যে, দিব্যি টি-শার্ট পরে ঘোরা যাচ্ছে। গত এক মাসের মধ্যে কোন কোন দিন রাতে যেমন এ.সি. চালু করতে হয়েছে, তেমনি কখনো কখনো মনে হয়েছে দু’টো কম্বল হলে ভালো হয়। বলা যায় এক মাসের মধ্যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত, বসন্ত- পঞ্চ ঋতু।
এই সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে পেশাগত কাজে নিউ ইয়র্ক আসা ইয়াসীন কবির জয়, আবু তাহের খোকন, সানাউল হক ও কল্লোল ভাই আজ দেশে ফিরে যাবেন। যাওয়ার আগে দেখা হবে না, সে কী করে হয়।
এর আগে স্বনামধন্য ফটোগ্রাফার আক্কাস মাহমুদ ভাইকেও বিনাদর্শনে বিদায় দিতে হয়েছে ফোনে। আসলে যারা নিউ ইয়র্কে অফিসিয়াল কাজে আসেন তারা থাকেন হুলস্থুল রকমের ব্যস্ত। আর যারা এখানে থাকেন তাদের ব্যস্ততা ঘড়িধরা। আমার মত অকর্মা, পথঘাট কম চেনাদের নানা ঝামেলা। অচেনা পথ; ট্রেন-বাসে ঘুরতে গেলে ডলার খরচ, হেঁটে এত দূরের পথ পাড়ি দেয়াও সহজ নয়। এ কারণে আপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সাথেই দেখা করা সহজ নয়।
বেলা ১২টায় ওনাদের ফ্লাইট। সকালে সময়মত রওয়ানা দিতে যেয়েও আমার সিস্টার ইন ল’ কাজল আখতার আপার একটা অনুরোধ রাখবো বলে দেরি হলো। তাই ভাবছিলাম ওনাদের পাব কী না। তারপরও বাসে চড়ে লিবার্টি এভিনিউতে নেহার ভাইয়ের যে বাসায় ওনারা আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন সেখানে রওনা হলাম।
বাস থেকে নেমে অনেকটা দৌঁড়ে সেই বাসার কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে ধেয়ে আসা সাদা গাড়িটা দেখে অনুমান করলাম, ওটাই নেহার ভাইয়ের গাড়ি। ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তা ধরে যে উদ্দেশে এগুচ্ছিলাম, তাতে কাজ হলো। নেহার ভাই আমাকে দেখে গাড়ি থামালেন। খুব তাড়া, তাই কোনমতে হাত মিলিয়ে, একবার সবার সাথে চোখে চোখ রেখে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম, নিউ ইয়র্কের আকাশে তখন মেঘ। বৃষ্টি আসার আগেই আমাকে উডহ্যাভেন যেতে হবে।
কিউ৮৩ বাসের জন্য কিছুদূর এগুতেই মনে হল আমার দু’চোখে বৃষ্টি। বৃষ্টি নাকি চোখের জল, সেটা পরখ করতে আকাশের দিকে তাকাতে দেখি কিউ৮৩ বাস এসে গেছে। মেঘলা আকাশ যেন সবাইকে গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া দিচ্ছে। আমাকে এখনই বাসে চেপে জামাইকা সেন্টার যেতে হবে, সেখান থেকে জে ট্রেনে করে গন্তব্য ৮৫ স্ট্রিট ফরেস্ট পার্কওয়ে, উডহ্যাভেন।
সারাদিন বাসায়, মাঝেমধ্যে বের হই জামাইকা এভিনিউ ধরে একটানা হাঁটি, স্ট্রিটের পর স্ট্রিট অকাতরে পার হয়ে যাই। টায়ার্ড হলে দাঁড়িয়ে দু’একজনকে ফোন করি। কখনো বাসায় কারো কিছু লাগলে দোকান থেকে এনে দেই। বাসায় কোন পার্টি থাকলে, পার্টির সময়টুকু বাইরে হেঁটে হেঁটে পার করে, অতিথিরা চলে যাওয়ার পর ফিরে আসি; এখানকার মানুষ দেখলেই কেমন যেন শামুকের মত দেহমন গুটিতে যায়।
এছাড়া কারো অলস সময়ের সাথী আমি। এ নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কেউ কেউ বলেছে- বেশ ভালোই তো আছো, ঘুরছো ফিরছো। হ্যাঁ, ভালোই আছি।
কবি শামসুর রাহমান এর কবিতার মত-
‘কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি;
খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দু’বেলা
পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনে কথা শুনছি
ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি…….।’
আর সেইসাথে প্রতিদিন বাথরুমে প্রাকৃতিক বর্জ্যের সাথে আত্মসম্মানবোধকেও ফ্লাশ করে দিয়ে আসছি।