চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাঙালি গৌরবের আরেক নাম অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলা

বাংলা পঞ্জিকা-ইংরেজি ক্যালেন্ডার দেখে এবার বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে
বাংলা নববর্ষ উদযাপন হয়েছে ১৪ এপ্রিল। ছুটি না থাকায় অস্ট্রেলিয়ার
বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে; আগামী ১৬
এপ্রিল। যেমন ছুটির দিন দেখে গত শনিবার সিডনির টেম্পি পার্কে একটি বৈশাখী
মেলা হয়ে গেছে।

১৬ এপ্রিল যে বৈশাখী মেলাটি হবে সেটিকে বলা হয় বাঙালির দেশ বাংলাদেশের অথবা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঙালি উৎসব-সমাবেশ! এর কারণ কী জানেন? দুনিয়ার বেশিরভাগ শহরে সভা-সমাবেশ হয় মিলনায়তনের ভিতরে। প্রচন্ড শীত অথবা গরমের কারণে অনেক জায়গায় উন্মুক্ত স্থানে সভা-সমাবেশ করা যায় না। সংশ্লিষ্ট দেশ-কর্তৃপক্ষেরও অনুমতির বিষয় আছে। কিন্তু সিডনির এই বর্ষবরণের বৈশাখী মেলাটি হয় অলিম্পিক পার্কের মতো বিশাল ভেন্যুতে!

এ উপলক্ষে শুধু সিডনি-ক্যানবেরা নয়, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে বাঙালিরা আসেন সিডনিতে! এবং এই বাঙালি বলতে শুধু বাংলাদেশী বাঙালি না, ভারতীয় বাঙালিদেরও এটি সারা বছরের অপেক্ষার প্রাণের উৎসব। এ উৎসবে প্রায় সবাই বাহারি বৈশাখী রঙের জামা-কাপড়, শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে আসেন! বিদেশীরা অবাক হয়ে বাঙালির প্রাণের উৎসব দেখে! আরেকটি তথ্য, অলিম্পিক পার্কের মতো ব্যয়বহুল ভেন্যুতে বৈশাখী মেলায় কিন্তু কেউ ফ্রি ঢোকেন না। লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ ডলারে বাংলাদেশের-ভারতের কয়েকশো টাকায় টিকেট কেটে তারপর ঢোকেন।

পার্কিং’এর জন্যেও এমন গুনতে হয় ১৫ ডলার। ভেন্যু থেকে এদেশের পার্কিংগুলো সাবও বেশ দূরে  দূরে। সেখানে গাড়ি রেখে বিদেশে অনভ্যস্ত শাড়িপরা মানুষগুলো বাচ্চাদের কোলে-কাঁধে নিয়ে অথবা স্ট্রলার ঠেলতে ঠেলতে হেঁটে আসেন অলিম্পিক পার্কে! প্রাণের আবেগ-টানটি এখানে কতো ব্যাপক বুঝতে পারেন?

এবং প্রতি বছরই সিডনির এই বৈশাখী মেলার স্থান-সংকুলান নিয়ে আক্ষেপ-প্রশ্ন উঠছে বলে এবারের মেলাটি হচ্ছে আরও বড় ভেন্যুতে! এবার প্রথমবারের মতো বৈশাখী মেলা হবে অলিম্পিক পার্কের এএনজেড স্টেডিয়ামে! এর ধারণ ক্ষমতা ৭৫ হাজার!

গোটা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে অত বাঙালি নেই। কিন্তু মেলা উপলক্ষে গোটা স্টেডিয়াম এলাকা জুড়ে যত বাহারি পণ্যের স্টল বসে, পান্তা-ইলিশ, পিঠাপুলি থেকে শুরু করে বই-শাড়ি-পাঞ্জাবি-লুঙ্গি-গামছা-ধুতি, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সি থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার নানা ব্যাংক, সেবা সংস্থা সহ নানান প্রতিষ্ঠানের স্টল-পসরা এখানে এক জায়গায় হয়, এবার ভেন্যুটি অনেক বড় হওয়াতে সবার চলাফেরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের হবে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নানা সব বাহারি খাবারের পাশাপাশি কলকাতারও নানান স্টল থাকে মেলায়। এবার এএনজেড স্টেডিয়ামের বাইরেও স্টলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মূল সাংস্কৃতিক আয়োজনের মঞ্চটি থাকবে স্টেডিয়ামের ভেতরে। আরেকটা মজার কথা বলি। দুনিয়ার নানান ভাষাভাষি-সংস্কৃতির মানুষজনের দেশ অস্ট্রেলিয়ার আর কোন জাতি-ভাষার মানুষের এতো বড় সমাবেশ কিন্তু এখানে সচরাচর হয় না। সে কারণে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিকরা কিন্তু পারতপক্ষে এর দাওয়াত এড়ান না! এক জায়গায় এতো ভোটার! এবারের মেলায় সে কারণে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেতা, নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যোগ দেবার সম্ভাবনা আছে।

গুরুত্বপূর্ণ সবাইকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে মেলার দাওয়াতপত্র। প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেতা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দেশটিতে বসবাসরত বাঙালিদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন। এসবের কারণে প্রশান্তপাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ার বাঙালিদের গৌরবের আরেক নাম হয়ে গেছে সিডনির অলিম্পিক পার্কের এই বৈশাখী মেলা। আর এর মাধ্যমেই সেতুবন্ধন তৈরি করেছে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার সঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতি।

কিন্তু এই মেলা একদিন আজকের মতো বড় ছিলো না। বাঙালিও একদিন এতো বেশি ছিলো না এদেশে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বাংলাদেশের বাঙালি ছিলেন মাত্র পাঁচজন! দিনে দিনে এখানে বাঙালির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈশাখী মেলার পরিসরও। দুই দশক আগে ১৯৯৩ সালে সিডনির বারউড গার্লস স্কুল মাঠে সূচনা হয়েছিল এ মেলার।

বাংলা সালটি ছিলো ১৪০০ সাল। প্রথম মেলাতে দর্শক হয়েছিলো মাত্র ২০০ জন। একটানা তের বছর সেখানে মেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু দিনে দিনে সেখানে স্থান-সংকুলানের সমস্যা বাড়ায় মেলাটি ২০০৬ সালের দিকে স্থানান্তর করা হয় সিডনি অলিম্পিক পার্কে। এখন প্রতি বছর মেলায় আসেন প্রায় পঁচিশ হাজার বাঙালি। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহর ছাড়াও প্রতিবেশি নিউজিল্যান্ড থেকে অনেক বাঙালি আসেন। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালিরা অস্ট্রেলিয়া আসার আগে জেনে নেন সিডনির বৈশাখী মেলার দিন-তারিখ। টিকেট কাটেন সেভাবেই।

মেলার আয়োজক বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি শেখ শামীমুল হক জানান, মেলাপ্রেমিক বাঙালিদের ভোগান্তি এড়াতে এবার অনলাইনেও প্রবেশ ও পার্কিং টিকেট কাটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিদের ব্যান্ড, শিল্পী-কলাকুশলীদের পাশাপাশি প্রতিবছরের মতো এবারও দাওয়াত করা করে আনা হয়েছে বাংলা গানের একজন স্বনামখ্যাত শিল্পীকে। তবে ফ্যাশন শো সহ নানাকিছুর নেতৃত্বে থাকবেন অস্ট্রেলিয়াবাসী বাঙালি প্রিয় প্রজন্ম।

উল্লেখ্য অলিম্পিক পার্কের সব আয়োজন পরিচালনা করে ভেন্যু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি। স্টল সজ্জা, লাইটিং-সাউন্ড, মঞ্চ পরিচালনা, ভেন্যুতে প্রবেশ-পার্কিং, টিকেট বিক্রি, নিরাপত্তাসহ সবকিছুই এএনজেড স্টেডিয়াম অনুমোদিত ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানির মাধ্যমে করাতে হয়।

গত কয়েক বছর ধরে এই বৈশাখী মেলা শেষ হয় বর্ণাঢ্য আতশবাজির মাধ্যমে! প্রতিবছর ইংরেজি নববর্ষের উদযাপনে সিডনির অপেরা হাউসকে ঘিরে আতশবাজির উজ্জ্বল ছবিটি সবার আগে পৃথিবীব্যাপী বর্ষবরণের প্রথম ছবি হয়। মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় সেই আতশবাজিতে।

সেই একই শহর সিডনিতে বাঙালির বর্ষবরণ পর্বও শেষ হয় উজ্জ্বল আতশবাজিতে! অলিম্পিক পার্কের আশেপাশের কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকার লোকজন জানেন এখানে বর্ষবরণ হচ্ছে বাঙালির! ভাবা যায়! এসবই কিন্তু এখন অস্ট্রেলিয়াবাসী বাঙালিদের সত্যি বাস্তব। বিশ্ববাসী বাঙালিরা ভাগীদার এই গৌরবের।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)