চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বাঙালির কোরবান: ভোগের দৃশ্যায়নে ত্যাগের উদযাপন

১.
শাহীন এবার কোরবানি দেননি। কারণ তার কিছু ঋণ ছিলো। স্ত্রীর সাথে এ নিয়ে তার মনোমালিন্য হয়েছে। স্ত্রীর অসন্তোষের কারণ তিনি জানেন। স্যোশাল মিড়িয়ার যুগে সবাই যখন নিজেদের গরু ছাগলের ছবি দিচ্ছেন, তার আপা-দুলাভাইরা কোরবানীর কথা জিজ্ঞাসা করছেন; তখন তিনি কিছুই দিতে পারছেন না। স্ত্রীকে শাহীন শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বুঝাতে পারেন যে ঋণ থাকলে ইসলামে কোরবান না করে ঋণ পরিশোধের নির্দেশনা আছে। হাদিসে স্পষ্ট আছে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কোরবানী আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

২.
জাফর আহমদ। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত জমিতে জমিদার ছিলেন। নিজে লবণ ব্যবসা শুরু করেছিলেন। অমিতব্যয় আর বিশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং লোক দেখানো স্বভাব তার মধ্যে প্রবল। যখন টাকা থাকে তখন তিনটি স্মার্ট ফোন তার হাতে শোভা পায়। মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খান না। ব্র্যান্ডের শার্ট ছাড়া পরেন না। আবার যখন টাকা থাকে না তখন সব করতে পারেন। বাসে রিক্সায় চড়তেও লজ্জা পান না । ব্যবসা লস করতে করতে আর জমি বিক্রি করতে করতে এক সময়ের জমিদারি নি:শেষ। কিন্তু জমিদারি ভাব যায়নি। কোরবান এলে সেই মাথা দ্বিগুণ গতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার সৎ ভাইপোদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সন্তানদের উপর চাপ প্রয়োগ করে বড় গরুর কেনান যাতে তার জমিদারি ফলাতে পারেন। প্রয়োজনে ঋণও করেন।অনেকে জমিদারি ভাব রাখার জন্য শহরে থাকলেও গ্রামে মাংস পাঠান গরীবদের জন্য।

আমাদের দেশে কোরবানী যতো না ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত তার চেয়ে বেশি লোক দেখানো ভোগের দৃশ্যায়ন। কেউ যখন রাস্তা দিয়ে গরুর কিনে নিয়ে যান তখন যেনো এটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে সবার জিজ্ঞাসা করা। যারা বড় গরু কিনেন তারা সগর্বে ঘোষণা দিতে থাকেন। বেশি দামে গরু কিনে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মানুষ দেখানোই লক্ষ্য। হালের গরু কিনে স্যোশাল মিডিয়ায় তার ছবি দেয়া যেনো কোরবানীর অংশ।

এ দৃশ্যমান সংস্কৃতি ব্যক্তির জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক কর্মের প্রভাব ফেলে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ঘুষ যেখানে ওপেন সিক্রেট সেখানে কোরবানীর আগে ঘুষের রেট বেড়ে যায়। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে টাকা কামানোর চেষ্টা বাড়ে।

কোরবানির মাংস তিনভাগ করে দেয়ার প্রচলন রয়েছে। একভাগ গরীব মানুষকে, একভাগ গরীব আত্মীয় স্বজনকে যারা কোরবানী দিতে পানরেনি, আর একভাগ নিজের । কিন্তু অদ্ভুতভাবে এখানে একজন কোরবানীর মাংস আরেকজন কোরবানদাতার কাছে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিয়ের পর প্রথম কোরবানে জামাইয়ের বাড়িতে কোরবানীর মহিষ, ছাগল পাঠাতে হয়। মাংস বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার যুক্তি খোঁড়া ও বাস্তবতা বিবর্জিত।

কোরবান কি মাংস খাওয়ার ও নিজস্ব বড়ত্ব জাহির করা নাকি আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে জীবন যাপনে সেই ত্যাগের চর্চা করার জন্য? বাংলাদেশে প্রতিবছর কোটি কোটি গরু, মহিষ, ছাগল কোরবান হয়। অথচ বাস্তব জীবনচরিত্রে কর্মে, ব্যবহারে ভোগে তার কোন প্রতিফলন নেই।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক মওলানা আকরাম খাঁ’রা সারাজীবন বাঙ্গালি মুসলমানের এই আচারসর্বস্ব ধার্মিকতা ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দিচ্ছেন কিন্তু অভুক্ত প্রতিবেশির খবর নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন না। ঈদ এলে তার দশদিন আগে থেকেই চুল দাড়ি কাটেন না , হজের সময় রোজা রাখেন। বাঙ্গালির জীবনে সওয়াব গুণতে গুণতে আল্লাহর আনুগত্যেও ব্যবসায় পরিণত করেন।

পবিত্র কোরআনে দু ধরণের ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। হাক্কুলাহ্ বা আল্লাহুর ইবাদত এবং হাক্কুল এবাদ বা মানুষের ইবাদত যেখানে মানুষে মানুষে দৈনন্দিন কার্যক্রমে যেসব ধর্মীয় বিধান ও নীতি মেনে চলার নির্দেশ রয়েছে। কাউকে ওয়াদা দিলে সেটি রাখা, মিথ্যা কথা না বলা, কারো হক নষ্ট না করা, ওজনে কম না দেয়া, ভেজাল না করা, ইত্যাদি।

এসব ক্ষেত্রে হক নষ্ট হলে আল্লাহও সেটি ক্ষমা করতে পারেন না। বাংলাদেশে এর চর্চা জরুরী।

ইসলামে সামর্থ্যবানদের একবার সৌদি আরব গিয়ে হজ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এখানকার মুসলমান প্রধানত ব্যবসায়ী মুসলমানরা প্রতিবছর হজ করেন এবং বছরে কয়েকবার ওমরা করে প্রচুর অর্থ খরচ করেন। যে পরিামাণ অর্থ ব্যয় হয় হিসাব করলে সেটি দিয়ে অনেক তরুণ বেকার ও দুস্থকে পূনর্বাসন সম্ভব।

দৃশ্যমান এ ধর্ম উৎসবের এই সংকট থেকে মুক্ত হওয়া না গেলে না ধর্মের বা ধার্মিকের কোন উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সবার আত্মত্যাগ কবুল করুন। আমিন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)