চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বাংলা শিল্প সাহিত্যের ধ্রুবতারা আমজাদ হোসেন

কী ছিলেন না আমজাদ হোসেন? পরিচয়ের শেষ নেই এই শিল্পীর। তাঁর বড় পরিচয় কোনটি তা নিরূপণ করতে গেলে খেই হারাতে হয়। আমজাদ হোসেনের সৃজনশীলতা বিচার করতে গিয়ে আমার হয়েছে সমকালীন সাহিত্যে তার মত এতো শক্তিশালী লেখক, গল্পকার ও নির্মাতা খুব বেশি আসেনি।

অভিনেতা আর চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর জাত যে কতোটা উচ্চমার্গীয় তা বারবার প্রমাণ করেছেন আমজাদ হোসেন। ব্যতিক্রমধর্মী সিনেমা নির্মাতা। কর্মজীবনে ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার এবং ৬টি বাচসাস পুরষ্কার অর্জন করেছেন।

সাবিনা ইয়াসমীনের পর তিনিই সর্বাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার বিজয়ী। এছাড়া প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ছয়টি ভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেছেন এবং এক আয়োজনে পাঁচটি বিভাগে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই দুটি কৃতিত্ব গড়েন নাট্যব্যক্তিত্ব গাজী রাকায়েত। আমজাদ হোসেন ১৯৬১ সালে ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রে আগমন করেন। পরে চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনায় মনোনিবেশ করে এবং চলচ্চিত্র পরিচালনায় তুমুল খ্যাতি অর্জন করেন।

তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুণ নিয়ে খেলা’ ১৯৬৭ সালে। পরে নয়নমনি ১৯৭৬, গোলাপী এখন ট্রেনে ১৯৭৮, ভাত দে ১৯৮৪ দিয়ে প্রশংসিত হন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ও ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করেন।

এছাড়া সাহিত্য রচনার জন্য তিনি ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে দুইবার অগ্রণী শিশু সাহিত্য পুরষ্কার ও ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কারসহ একাধিক পুরষ্কার লাভ করেন।

আমজাদ হোসেন ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্তমান বাংলাদেশ এর জামালপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।

লেখালেখির মাধ্যমেই তাঁর সৃজনশীল জীবন শুরু। ছড়া দিয়ে সাহিত্যের অঙ্গণে প্রবেশ। প্রথম কবিতা ছাপা হয় বিখ্যাত দেশ পত্রিকায়। ছোটদের জন্যেও তিনি লিখেছেন বহু গল্প, ছড়া এবং উপন্যাস।

এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ও গল্প লিখেছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক চেতনার অধিকারী আমজাদ হোসেন পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সৃজনশীলতা জুড়ে। ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু করে আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি তাঁকে। একই বছর মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে অভিনয় করেন। পরিচালক সালাহ্উদ্দিন তাঁর রচিত নাটক ধারাপাত অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ধারাপাত তাঁর রচিত প্রথম চলচ্চিত্র এবং তিনি এই চলচ্চিত্রে একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয়ও করেন। পরবর্তীকালে তিনি জহির রায়হানের দলে যোগ দেন ও তার সহকারী হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এর উল্লেখযোগ্য হলো লোককাহিনী নির্ভর বেহুলা (১৯৬৬)।

১৯৬২ সালে ছবিটির কাজ শুরু হয়। তিনি এই ছবির সংলাপ রচনা করেন এবং এতে অভিনয় করেন। এই ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অভিনেতা রাজ্জাকের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব। যে সম্পর্ক রাজ্জাকের মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

এছাড়া পরের বছর তিনি জহির রায়হানের আনোয়ারা ১৯৬৭ চলচ্চিত্রেও রাজ্জাকের সাথে অভিনয় করেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুণ নিয়ে খেলা’ তিনি নুরুল হক বাচ্চুর সাথে যৌথভাবে নির্মাণ করেন। একক পরিচালক হিসেবে তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র জুলেখা ১৯৬৭। পরের বছর তিনি নুরুল হক বাচ্চু, মুস্তাফা মেহমুদ ও রহিম নওয়াজের সাথে যৌথভাবে দুই ভাই চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।

ছবিটির প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার ছিলেন জহির রায়হান। এছাড়া তিনি এককভাবে বাল্যবন্ধু ১৯৬৮ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৭০ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর লেখা চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ পরবর্তীতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৭০ এর দশকে তিনি নয়নমনি ১৯৭৬, গোলাপী এখন ট্রেনে ১৯৭৮, সুন্দরী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৮০ এর দশকে কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি ১৯৮২, দুই পয়সার আলতা ১৯৮২, ভাত দে তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র।

আমজাদ হোসেনের দুই পুত্র সাজ্জাদ হোসেন দুদুল ও সোহেল আরমান। তার দুজনেই পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। এই বছরের নভেম্বর মাসে তিনি ইশকেমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে ঢাকার ইমপালস হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি অনুদানে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৭ নভেম্বর ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিজয়ের মাসে ১৪ই ডিসেম্বর ৭৬ বছর বয়সে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

আমজাদ হোসেনের উপন্যাসগুলো- ‘ধ্রুপদী এখন ট্রেনে’, ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভালোবাসা’, ‘আমি এবং কয়েকটি পোস্টার’, ‘রক্তের ডালপালা’, ‘ফুল বাতাসী’, ‘রাম রহিম’, ‘আগুনে অলঙ্কার’, ‘ঝরা ফুল’, ‘শেষ রজনী’, ‘মাধবীর মধাব’, ‘মাধবী ও হিমানী’ ও ‘মাধবী সংবাদ’।

তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস- ‘যুদ্ধে যাবো’, ‘অবেলায় অসময়’, ‘উত্তরকাল’ ও ‘যুদ্ধযাত্রার রাত্রি’। আমজাদ হোসেন জীবনী গ্রন্থও রচনা করেন- ‘মাওলানা ভাসানীর জীবন ও রাজনীতি’, ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জীবন ও রাজনীতি’, ‘মানবেন্দ্রনাথ রায় জীবন ও রাজনীতি’ এবং ‘শ্রী হেমচন্দ্র চক্রবর্তী’।

আমজাদ হোসেনের ইতিহাস গ্রন্থ- ‘বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস ১ম খন্ড’, ‘বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস ২য় খণ্ড’, ‘নকালবাড়ী কৃষক আন্দোলন’, ‘বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট’, ‘বাঙালির ঐতিহ্য বাঙালির ভবিষ্যত’ এবং ‘উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব বিকাশ ও পরিণতি’ এবং ‘আন্দোলনের রূপরেখা’। তাঁর কিশোর উপন্যাস- ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’, ‘যাদুর পায়রা’, ‘ভূতের রাণী হিমানী’, ‘সাত ভূতের রাজনীতি’, ‘শীতের রাজা উহু কুহু’, ‘টুকটুক’ ও ‘রঙিন ছড়া কৃষ্ণচুড়া’। আমজাদ হোসেন এর গল্পগ্রন্থ ‘পরী নামা জোছনায় বৃষ্টি’ ও ‘কৃষ্ণলীলা’ আর তাঁর ফিকশন গ্রন্থ- ‘ডারকেনিং ডে’। তাঁর রচনাসমগ্র হলো- ‘মুক্তিযুদ্ধের রচনাসমগ্র’, ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র’, ‘মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত কিশোর গল্প’, ‘আমজাদ হোসেনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’, ‘উপন্যাসসমগ্র’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘গল্পসমগ্র’, ‘কিশোর গল্পসমগ্র’, ‘কিশোরসমগ্র’ আর ‘মাধবী সমগ্র’।

তাঁর চলচ্চিত্রগুলো- ‘আগুন নিয়ে খেলা ১৯৬৭’, ‘জুলেখা ১৯৬৭’, ‘দুই ভাই ১৯৬৮’, ‘বাল্যবন্ধু ১৯৬৮’, ‘পিতা পুত্র’ ১৯৭০, ‘নয়নমনি’ ১৯৭৬, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ১৯৭৮, ‘সুন্দরী’ ১৯৭৯, ‘কসাই’ ১৯৮০, ‘দুই পয়সার আলতা’ ১৯৮২, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ১৯৮২, ‘ভাত দে’ ১৯৮৪, ‘সখিনার যুদ্ধ’ ১৯৮৪, ‘হীরা মতি’ ১৯৮৮, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ ১৯৯৪, ‘আদরের সন্তান’ ১৯৯৫, ‘সুন্দরী বধূ ’২০০২, ‘প্রাণের মানুষ ২০০৩, ‘কাল সকালে’ ২০০৫ ও ‘ গোলাপী এখন বিলাতে ২০১০। তাঁর নাটক নাটক- ‘জব্বার আলী এখন রিমান্ডে ও ‘হ্যালো জব্বার আলী’। আমজাদ হোসেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, চ্যানেল আই পরিবারের সদস্য।

ইমপ্রেসের চলচ্চিত্র জয়যাত্রা ২০০৪ সালে মুক্তি পায়। আমজাদ হোসেন এর কাহিনী নিয়ে সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেন তৌকির আহমেদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিত্তিক এই ছবিটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।

জয়যাত্রা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন একদল মানুষের হাসি কান্না, সুখ দুঃখ, মৃত্যু ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। ছবিটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, আবুল হায়াত, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনী। ছবিটি পরিচালনা করে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ পরিচালক তৌকির আহমেদ ২৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করেন।

এছাড়া ছবিটি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। বিশেষ দিন গুলোতে চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনে থাকতো আমজাদ হোসেনের সরব উপস্থিতি। বাংলা শিল্পের এই ধ্রুবতারার অভাব আমরা চিরদিনই উপলব্ধি করবো গভীর শ্রদ্ধায়।