১১ বছর পর আবারও রক্তাক্ত হলো রাজশাহীর বাগমারা। শুক্রবার জুমা’র নামাজের পর উপজেলার মচমইল এলাকার সৈয়দপুর মচমইল চকপাড়ায় আহমাদিয়া মুসলিম জামাত জামে মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হয়। আহত হয়েছে অন্তত ৭ জন।
নতুন করে আলোচনায় আসা বাগমারা মনেকরিয়ে দিলো এখান থেকেই উত্থান হয়েছিলো জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি)।
প্রায় একযুগ পেরিয়ে গেলেও রাজশাহীর বাগমারার মানুষের মন থেকে এখনো জেএমবি আতঙ্ক মুছে যায়নি। সংগঠনটি আবির্ভূত হয়ে মাত্র ৩ মাসেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। এ সময় তারা ২৩ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বর্বর নির্যাতনের শিকার হয় ওইসব এলাকার নিরীহ মানুষ।
শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলাভাইসহ অনেকের ফাঁসি হলেও জেএমবি সদস্যরা গোপনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে সাধারণ মানুষের অভিযোগ ছিলো। তাদের সেই ধারণা ও অভিযোগ শুক্রবারের হামলার ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হলো।
রাজশাহীর বাগমারার ও নওগাঁর আত্রাই-রানীনগর এলাকায় সর্বহারা দমনের নামে ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ আবির্ভূত হয় জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন। নেতৃত্বে ছিলেন জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই।
১ এপ্রিল সকালে জেএমবি ক্যাডাররা বাগমারায় প্রবেশ করে সর্বহারা অধ্যুষিত গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের পলাশী গ্রামে নাটোর সদর এলাকার চরমপন্থী ক্যাডার মোনায়েম হোসেন বাবুকে হত্যা করে। ওই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জনসম্মুখে তাদের আগমন বার্তা ঘটে।
প্রথম দিকে জেএমবি ক্যাডাররা হামিরকুৎসা এলাকার পুরনো ইউপি ভবনে ক্যাম্প তৈরি করে কার্যক্রম চালালেও পরে রমজান কায়ার বাড়িতে অবস্থান নেয়। এখান থেকেই রাজশাহীর বাগমারা- নওগাঁর আত্রাই এলাকায় অপারেশন চালায়।
রমজান কায়ার সেই বাড়িটি অল্পদিনেই বাংলাভাইয়ের টর্চারসেলে রূপ নেয়। প্রতি সপ্তাহে গড়ে অন্তত ৫০ জনের একটি করে নতুন দল এসে যোগ দিতো ওই ক্যাম্পে। এক সপ্তাহ থাকার পর পরবর্তী সপ্তাহে পুরনো দল চলে যেতো। এরপর তারা হামিরকুৎসা হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থানান্তর করে। এই দুটি ক্যাম্পে নিরীহ লোকদের ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করা হতো।
জেএমবি সদস্যদের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করে কোনোরকমে বেঁচে আছে। মানুষ জনকে ধরে নিয়ে জেএমবি সদস্যরা গাছের সঙ্গে টাঙিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করতো। এমনভাবে শত শত নিরীহ মানুষকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালাতো জেএমবি সদস্যরা।
২০০৪ সালের ২৪ জুন জেএমবি ক্যাডাররা রাতারাতি ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এলাকাবাসী জানায়, এরপর প্রকাশ্যে জেএমবির প্রভাব এলাকায় দেখা যায়নি। তবে তাদের সহযোগীরা এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখনো। যাদের ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ এখনো মুখ খুলতে সাহস পায় না।
শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলাভাইসহ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সংগঠনটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। তবে নানা সময়ে মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে এর অন্যরা। কিন্তু র্যাব, পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অভিযানে তারা সফল হতে পারেনি। এ ছাড়া আর্থিক সংকটও চলতে থাকে সমান তালে। তবে তারা গোপনে সক্রিয় ছিলো বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
বাগমারায় মানুষ হত্যা করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা আর তারপর ২০০৪ সালের ১৭ই আগস্ট ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। এরপর গাজীপুর, ঝালকাঠিতে চলে আত্মঘাতি হামলা।
পুলিশের হিসেবে এসব হামলায় প্রাণ হারান ৬৩ জন সাধারণ মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করেন অনেকে। জেএমবির উত্থান এবং সিরিজ বোমা হামলায় সাধারণ মানুষ ছিলো ভীত-সন্ত্রস্ত। শুক্রবারের ঘটনা মানুষের সেই ভয় এবং আতঙ্ককে আরো বাড়িয়ে দিলো।