বাংলাদেশে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে ভারতে, তথাকথিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিংকে কেন্দ্র করে। হত্যা-ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার পর তার অনুসারীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অরাজকতা শুরু করেছিল। সাঈদীভক্তদের তাণ্ডবে পুলিশসহ হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল অনেক। ভারতেও এখন সেরকম ঘটনা ঘটছে। পার্থক্য হলো যে, সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাবার মতো গুরমিতকে সূর্যে দেখা যাওয়ার দাবি এখনও উঠেনি। তবে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শুক্রবার শুরু হওয়া সহিংসতা এখনো চলছে। ধর্ষণ মামলায় ভারতের আদালত গুরমিতকে দোষী সাব্যস্ত করার পর দেশটির পাঁচ রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বিতর্কিত ধর্মগুরুর ভক্তদের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা ৩১, আহত হয়েছে আড়াইশ‘র বেশি তার অনুসারী। কথিত রাম রহিমের আড়াই হাজারেরও বেশি অনুসারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিছু এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, জারি করা হয়েছে কারফিউ। আর রাম রহিম সিংকে গ্রেফতারের পর সেনা হেফাজতে হরিয়ানার হরতকের বিশেষ কারাগারে রাখা হয়েছে। সোমবার আদালত রায় ঘোষণা করবেন। রায়ে তার ৭ বছর কারাদণ্ড হতে পারে। তথাকথিত ওই ধর্মগুরু যিনি কিনা একইসঙ্গে যোগী, নায়ক এবং গায়ক– তিনি যেনতেন কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হননি। ধর্ষণের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে এবং আদালতে তা প্রমাণিত হয়েছে। ভক্তদের পবিত্র করার নামে অনেক তরুণীকে তিনি ধর্ষণ করেছেন। ভক্তি এবং বিশ্বাসের নামে প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ জানাতে সাহস করেননি। তবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ না কেউ কখনো না কখনো জেগে উঠেই। গুরমিত সিং এর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ২০০২ সালে অজ্ঞাত এক নারী সংবাদপত্রে চিঠি পাঠানোর পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। সেটি প্রকাশ করেন ‘পুরা সাচ’ পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতি। সাহসের প্রতীক ছত্রপতিকে অবশ্য পরে গুলিতে খুন হতে হয়। সেই হত্যা মামলাতেও গুরমিত সিং এর বিচার চলছে। তার আগে ছত্রপতি যে ধর্ষণের খবর প্রকাশ করেছিলেন সেই ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন গুরমিত। এ বিচার অবশ্য খুব সহজ ছিল না। পত্রিকায় খবর প্রকাশ হওয়ার পর হাই কোর্ট তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। ওই ধারাবাহিকতায় প্রথমে জেলা পর্য়ায়ে বিচার বিভাগ এবং পরে স্বাধীন তদন্ত সংস্থা সিবিআই তদন্ত করে গুরমিতের অপরাধের প্রমাণ পায়। গুরমিত যেহেতু আগে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস এবং পরে বিজেপি’র সঙ্গে দহরম-মহরমের সম্পর্ক গড়ে তোলে তাই অল্প হলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাধা অতিক্রম করতে হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে: গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ, স্বাধীন তদন্ত সংস্থা সিবিআই এবং সরকার। বাস্তবতা হচ্ছে, একটি রাষ্ট্রে এসব অঙ্গ ঠিকঠাক কাজ করলে রাষ্ট্র এবং সমাজও ঠিকঠাকমতো চলে। তবে, গুরমিতের মোহে যে অন্ধ সমর্থকগোষ্ঠী তারা কেন এভাবে তাকে গুরু মনে করে সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। বাংলাদেশকে যেমন সাঈদীর মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেই দায়িত্ব শেষ মনে করা ঠিক হবে না, তেমনি ভারতকেও ধর্মকে পুঁজি করে এরকম তথাকথিত ধর্মীয় গুরুর গজিয়ে উঠার আসল কারণ নির্ণয় করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।