সিরিয়াস জীবনধর্মী একটি উপন্যাস ‘স্বামীসূত্র’। স্ত্রীর চোখে স্বামীরা দেখতে কেমন তার একটি সূত্র পাওয়া যাবে এই বইয়ে। তার সঙ্গে মা এবং জীবনসঙ্গী স্ত্রীর অধিকার লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে পুরুষটির কী দশা হয় সেটি মূলত এ গল্পের বিষয়বস্তু।
ফিকশনধর্মী বইটি ঢাবি’র গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক পড়েছেন। ফেসবুক স্ট্যটাসে বইটি পড়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে লিখেছেন: অনেকদিন পর একটা ফিকশন খুব আগ্রহ করে পড়লাম। উপন্যাসটা খুব টানলো। সন্তান বা স্বামীকে ঘিরে যথাক্রমে জন্মদাত্রী মা ও জীবনসঙ্গী স্ত্রীর অধিকারবোধের লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে পুরুষটির কী দশা হয় তা গল্পের বিষয়বস্তু। এই বিষয়ে বাংলা গল্প-উপন্যাস রচিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আমার পড়া নেই। পুরুষ চরিত্রটির পয়েন্ট অব ভিউয়ে পুরো গল্পটা বলা হয়েছে, তাই সব পুরুষ পাঠক (কেন নয় নারী পাঠকও?) গল্পটির সঙ্গে কানেক্ট করতে পারবেন।
কাউকে না-বলা নিজ নিজ যন্ত্রণা আর বিষাদের কথাগুলো ভেবে গলায় কষ্ট দলা পাকিয়ে বসবে।গল্পটি লিখেছেন অবশ্য একজন নারী, আশা নাজনীন, উপন্যাসের নাম ‘স্বামীসূত্র’। নিজে নারী হয়েও তিনি পুরুষের মনস্তত্ত্ব ভালোভাবেই পাঠ করতে পেরেছেন।
আমরা সবসময় দেখি পুরুষ লেখকরা পুরুষদের গল্প বলছেন, মাঝে মাঝে নারীদের গল্পও তারা বলছেন। আর শক্তিমান নারী লেখকরা নারীর দৃষ্টিতেই গল্প বলতে চান। কিন্তু নারী লেখক পুরোপুরি পুরুষ দৃষ্টিতে গল্প বলছেন, এটা কমই দেখা যায়।
বইটি সম্পর্কে তিনি আরো লিখেছেন, গল্পটিতে প্রধান তিনটি চরিত্রই টিপিক্যাল। নারীটি সুন্দরী, পেশাজীবী ডাক্তার তিনি, কিন্তু সেই অর্থে নারীবাদী নন। তিনি সংসার-স্বামীর জন্য যথেষ্ট স্যাক্রিফাইসিং, শাশুড়ীর সঙ্গে যতদূর সম্ভব মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। মা বা শাশুড়ী গৃহবধূ, ছেলের প্রতি অধিকারপ্রবণ, পুত্রবধূর আবির্ভাবে তার মধ্যে ফ্রয়েডীয় ঈর্ষা কাজ করে, যে পেটের সন্তান আজ অন্য নারীর হয়ে গেছে, তিনি তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নানান উসিলায় উপস্থিত হন, তাদের অন্তরঙ্গতাকে ভণ্ডুল করে দিতে।
ফলে দুই নারীর ভেতরে পারস্পরিক অপছন্দ তৈরী হয়। পুরুষটি সরকারি চাকরিজীবী, ঘুষ খান না, আর্থিক টানাটানিতে থাকেন, সুন্দরী স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন, কিন্তু মার প্রতি ভক্তিও ত্যাগ করতে পারেন না, ফলে কোনো ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থান নিতে পারেন না।
মা আর স্ত্রীর অভিযোগের যাঁতাকলে পড়ে মানসিক পীড়নে ভোগা তার নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রী যেমন নারীবাদী নন, স্বামীও জেন্ডারসংবেদনশীল বলা যাবে না, বরং নারীদের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট গড়পড়তা।
এই চরিত্রগুলো টিপিক্যাল বলেই সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র হয়ে ওঠেন তারা। ‘স্বামীসূত্র’ পাঠ করলে মনে হবে বাংলাদেশের সমাজের যে ট্রানজিশন হয়ে চলেছে নব্বই দশকে বা নতুন শতকের শুরুতে – যৌথ পরিবার থেকে প্রাইভেসি খুঁজতে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জন্ম হতে চলেছে, তার একটা ডকুমেন্টশন এই উপন্যাসটি। তবে উপন্যাসের শেষটা টিপিক্যাল বলা যাবে না। সেটা জানতে হলে বইটা পড়ে নেয়াই ভালো হবে।লেখকের ভাষা প্রাঞ্জল, রসবোধ প্রখর, তবে বইতে বানান ভুল আছে কিছু। সামাজিক মাধ্যমে ‘র’ আর ‘ড়’-এর ভুল ব্যবহার দেখে দেখে ক্লান্ত-বিরক্ত আমি। ছাপা বইতেও এর অভিবাসন অসহ্য!
একটা সময়কে আমরা ফিল করি ‘স্বামীসূত্র’ পড়তে পড়তে, সামাজিক-রাজনৈতিক বৃহত্তর চিত্র আরেকটু বেশি পাওয়া গেলে মাধ্যম হিসেবে উপন্যাসের ব্যাপকতার বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ হতো।
বিঃদ্রঃ আমার কাছ থেকে নিয়ে আমার স্ত্রীও বইটি পড়ে শেষ করেছেন। আমি ভাবলাম, পড়ুক, স্বামীর কষ্টটা বুঝুক। কিন্তু পাঠশেষে তিনি যা বললেন তাতে মনে হলো তার স্বামীর প্রতি সহানুভূতি মোটেও বৃদ্ধি পায় নি। বরং ‘মাইনকা চিপা’য় থাকা গল্পের স্বামী আশ্রয় খুঁজতে মাঝখানে আরেক নারীর প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিল, সেই রেফারেন্সে তিনি বললেন, পুরুষদের চরিত্র কী, তা জেনে গেছি এই গল্প থেকে। অতএব সাধু সাবাধান!
উল্লেখ্য, একুশে বইমেলায় অধ্যাপক ও চলচ্চিত্র গবেষক ফাহমিদুল হকের চলচ্চিত্র বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ হয়েছে।