শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নের জন্য শ্রমিক মালিক সুসম্পর্ক অপরিহার্য। সেসব প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে ‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ; এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ শ্লোগানে পালিত হবে এবারের মে দিবস। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ভাবতে হচ্ছে, বাংলাদেশে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিক পক্ষের সম্পর্ক কেমন?
শ্রমিকরা বলছেন, মালিকদের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক থাকার কথা তা মালিকপক্ষ রাখছে না। এই সেক্টরের গবেষকরা বলছেন, সম্পর্ক যে পর্যায়ে থাকার কথা ছিল ততটা না থাকলেও দিন দিন সর্ম্পক ভাল হচ্ছে। আর মালিকপক্ষের দাবি শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের অত্যন্ত সুসম্পর্ক বিদ্যমান।
শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে শ্রমিকপক্ষ এবং এ খাতের গবেষকরা যৌক্তিকতা তুলে ধরলেও মালিকপক্ষ বলছে এটা শিল্পের উন্নয়নের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। বরং এর ফলে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আক্তার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মালিকপক্ষ ও রাষ্ট্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন দমনে যতটা মনোযোগী তাদের ন্যায্য পাওনা ও দাবিদাওয়ার ব্যাপারে ততটা মনোযোগী নয়। যেটি মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় বাধা। শ্রমিকদের নায্য দাবি-দাওয়া মালিকপক্ষের কাছে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন। কিন্তু কাগজে কলমে ট্রেড ইউনিয়ন থাকলেও বাস্তবে তা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে না।
‘যারা মালিকপক্ষের ‘পারপাস সার্ভ’ (স্বার্থরক্ষা) করতে পারছে তাদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা হচ্ছে। শ্রমিকদের চেয়ে মালিকদের স্বার্থ রক্ষায়ই বেশি মনোযোগী এসব কাগুজে ইউনিয়ন।’’
তবে এ শ্রমিক নেতার বক্তব্যকে পুরোপুরি নাকচ করেছেন তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র অন্যতম সহ-সভাপতি ফেরদৌস পারভেজ।
বর্তমানে পোশাক শিল্পে প্রায় ৪২ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। গত বছর আমাদের রপ্তানি ছিল ৩৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ৮১ ভাগই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
চ্যানেল আই অনলাইনকে ফেরদৌস পারভেজ বলেন: বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশে মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের অত্যন্ত সুসম্পর্ক বিদ্যমান। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা এবং দাবির ব্যাপারেও মালিক পক্ষ মনোযোগী।
‘যারা বলে মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক ভালো নয়, তারা আসলে কোনদিন শ্রমিকই ছিল না।’
ট্রেড ইউনিয়নের ব্যাপারে মালিকদের কিছু করার নেই উল্লেখ করে এই পোশাক শিল্প মালিক বলেন: ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সঙ্গে জড়িত দুই পক্ষ হচ্ছে শ্রমিকপক্ষ এবং সরকার। এখানে মালিকপক্ষের কিছু করার নেই।
তবে ট্রেড ইউনিয়ন শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে উপযোগী নয়, মন্তব্য করে মালিক পক্ষের এ নেতা বলেন: আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, যতগুলো প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল তার অর্ধেকই বন্ধ হয়ে গেছে।
‘‘বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোন দেশের শ্রমিকরা কিছু একটা হলেই রাস্তা অবরোধ করে কারখানা বন্ধ করে দিতে পারে না’’ এমন মন্তব্যও করেন বিজিএমইএ সহ-সভাপতি।
ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের গুরুত্ব তুলে ধরে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে আসা সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ট্রেড ইউনিয়ন। কারণ ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের একটা ন্যায্য দরকষাকষির সুযোগ তৈরি হয়। যার ফলে উভয়পক্ষের লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে।
‘শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া মেনে নিলে তাদের কাজের প্রতি উৎসাহ বাড়ে। এতে যেকোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বেড়ে যেতে পারে বহুগুনে। আর উৎপাদন বাড়লে সেটা উভয় পক্ষের জন্যই লাভ।’
আইনের ফাঁক-ফোকরকে কাজে লাগিয়ে মালিকপক্ষ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মন্তব্য করে এ সাংবাদিক বলেন: আগের চেয়ে মালিকপক্ষ অনেক বেশি কৌশলী। তারা বিভিন্নভাবে আইনের ফাঁকফোকরকে কাজে লাগাচ্ছে নিপূণভাবে।
বিষয়টি ব্যাখা করে তিনি বলেন: ট্রেড ইউনিয়ন আইনে বলা আছে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হতে হলে তাকে স্থায়ী কর্মচারী হতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানই শ্রমিকদের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়। যার ফলে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ থাকে না।
শ্রম আইন ও ক্রেতাদের চাপে তৈরি পোশাকখাতে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক দিন দিন উন্নততর হলেও অন্যান্য সেক্টরে পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ।
চ্যানেল আই অনলাইনকে ড. নাজনীন বলেন: রপ্তানিযোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালো এবং দিনদিন তা উন্নততর হচ্ছে। শ্রম আইন, বিদেশী ক্রেতাদের চাপ ইত্যাদির ফলে আসলে এখানে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের ভালো সম্পর্ক না রেখে উপায় থাকে না।
‘তবে তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক কেমন সেটি বলা যাচ্ছে না। কারণ সেখানে পর্যবেক্ষনের অভাব রয়েছে বা সুযোগ কম।’
অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক শিল্প এবং এর মালিকদের যে উন্নতি শ্রমিকদের সে হারে উন্নতি হয়নি বলে মনে করেন সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত।