প্রাচীন কাল থেকেই এদেশের মানুষের জীবন সংগ্রাম মুখর। অনেক দারিদ্র, হতাশা সংকটের ভেতর দিয়ে চলে আসছে মানুষের টিকে থাকার লড়াই। লড়াই সম্পদ আহরণের, জীবন মান উন্নয়নের। স্বাধীনতার পর দীর্ঘকালের পতন- উত্থান, অস্থিরতর ভেতর দিয়েও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি, এ কথা বলা যাবে না।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে প্রতিটি দেশেই মানুষের মানসিক বিকাশ ঘটে থাকে। আমাদের দেশে মানুষের দারিদ্র, অশিক্ষা, কুসংস্কার অনেকাংশেই কমেছে। মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে সভ্য জগতের নানা উপকরণ, প্রযুক্তি এবং তথ্যভাণ্ডার। কিন্তু আমাদের এ দৃশ্যমান সভ্যতা মানুষের মনোজগতে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন কি আনতে পেরেছে? প্রশ্নটি এখন ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।
এদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন গড়ে ৭-৮ টি আত্মহত্যার ঘটনা আমরা পত্রিকাতেই পাই। গত ১১ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখেই প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ৬ ও ৩ বছর বয়সী দুই শিশুকে নিয়ে মায়ের আত্মহত্যার মর্মান্তিক খবর। সব ঘটনাই যে পত্রিকায় আসে তাও নয়। বিশ্বের কয়েকটি দেশে আত্মহত্যার বড় বড় পরিসংখ্যান রয়েছে। আত্মহত্যা বিশ্বজুড়েই অপ্রত্যাশিত একটি মৃত্যু। সামাজিক বা ধর্মীয় কোন মূল্যবোধই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না, সে মূল্যবোধ মহৎ হলেও। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থাটি আমলে নিলে আমার মনে হয় আমাদের দেশে আত্মহত্যা সংঘটনের বর্তমান প্রবণতা উচ্চমাত্রায় আত্মহত্যাপ্রবণ যে কোন দেশের তুলনায় কম হবে না, বরং বেশিও হতে পারে।
আত্মহত্যার বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নারীর তুলনায় পুরুষরাই বেশি আত্মহত্যা করে। সব দেশেই নারীর আত্মহত্যা প্রবণতা অনেক বিষয় দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। ধর্মভীতি, সন্তান বাৎসল্য, সামাজিক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীল মানসিকতা নিয়ে বড় হওয়া ইত্যাদি নানা কারণ নারীকে প্রবল বিপর্যয়েও সহজে আত্মহত্যা করতে দেয় না। অনেকক্ষেত্রে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নিলেও আত্মহত্যা করার সাহস তাদের পুরুষের চেয়ে কম। আমাদের দেশে আত্মহত্যার এ পরিসংখ্যান উল্টে গেছে। ফতোয়াবাজি বা সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে, ইভটিজিং বা ধর্ষণের গ্লানি থেকে রেহাই পেতে, দাম্পত্যজীবনের অশান্তি থেকে রেহাই পেতে এবং আরও নানা কারণে প্রতিদিনই অনেক নারী আত্মহত্যা করছে।
সবচেয়ে মারাত্মক তথ্য হচ্ছে শিশুরাও ব্যাপকভাবে আত্মহত্যা নামক মানবিক সংকটের শিকার হয়ে চলেছে। হয়ত শিশুরা পরম আস্থা ও নির্ভরতার মানুষটির অসহায় অবস্থা দেখে আত্মহত্যায় সহযাত্রী হচ্ছে কিংবা আত্মহত্যাকারীর সাথে সাথে খুন হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত শিশুরা জীবন নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী হয়। তারা জীবন সম্পর্কে সবচেয়ে আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু। তাদের কাছে জীবন যেমনই হোক তা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দিয়ে মোড়ানো এক প্রাণবন্ত অস্তিত্বের নাম। সদ্য প্রয়াত প্রিয়জনের মৃত্যুশোকের করুণ বিষাদময় আবহের মধ্যেও তারা সহজাত জীবনবাদী আনন্দ নিয়ে খেলা করে। কিন্তু আমাদের সমাজের মানবিক পরিচর্যা আর দায়িত্বহীনতার স্তর এতটা নিচে নেমেছে যে শিশুরাও আত্মহননের সহযাত্রী হয়ে চলেছে। আমাদের সমাজের মানুষের মানবিক বিপর্যয় জীবন সম্পর্কে সবচেয়ে আশাবাদী শিশুদের ভেতরও পরিব্যাপ্ত হয়েছে। কোন জনপদের জন্য এরচেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কিছু হতে পারে না।
শিশুদের আত্মহত্যা প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া খুব বিরল একটি ঘটনা। কারণ মৃত্যু বিষয়টিকে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। ১৯৭৮ সালে রেভারেন্ড জিম জোনস নামক একজন ধর্মীয় নেতার নেতৃত্বে ৫০০ আমেরিকান একটি গণ আত্মহত্যায় অংশ নিয়েছিলো, যা বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়েছিল। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হল আত্মহননকারীদের মধ্যে ২৭৬ জন ছিল শিশু। মনোবিজ্ঞানীগণ এগুলোকে আত্মহত্যা না বলে আত্মহত্যার আবরণে ঘটা হত্যাকাণ্ড বলে থাকেন। সেটিই যুক্তিসংগত।
আমাদের দেশে সাম্প্রতিক আত্মহত্যাগুলোর প্রধান কারণগুলো বিবেচনা করা যাক।
প্রথমেই যে কারণটি উল্লেখ করার মতো, তা হলো, সমাজের প্রতি এবং মানুষের সংবেদনশীলতার প্রতি চরম অনাস্থা। অনেক কারণেই মানুষের মধ্যে এ অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এর প্রধান দুটি কারণ হলো-
এক. রাষ্ট্র মানুষের সুস্থ ও নিরাপদ জীবন রক্ষার ব্যাপারে একেবারেই মনোযোগী নয়। যে মা তার সবচেয়ে আদরের সন্তানদের নিয়ে আত্মহত্যা করে, সে মা তার বিচারে ও যুক্তিতে সন্তানের প্রতি তার শেষ দায়িত্বটি পালন করে। তার কাছে এ সমাজ নরকের মতো, যেখানে তার অবর্তমানে তার সন্তানের মানুষের মতো বেঁচে থাকার নিরাপত্তা নেই।
এবং দুই. জীবনের অপরিমেয় দুঃখগুলোর সাথে বা বিপর্যয়ের সাথে মোকাবেলা করে জীবনের মহিমাকে অক্ষুণ্ন রাখার যে মানবিক যোগ্যতা তৈরি হবার কথা ছিল তা আমাদের নেই। এ মানবিক যোগ্যতা ব্যক্তিকে নিজের উপর আস্থাশীল করে। এ আস্থার অভাব ব্যক্তির মধ্যে অর্থহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। অর্থহীনতা হলো জীবনকে ভাল না বাসতে পারা, জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। সুবিধা বঞ্চিত, দরিদ্র বা প্রান্তিক মানুষেরাই যদি এ সংকটের ভেতর দিয়ে যেতো তাহলে একে ঢালাও ভাবে দারিদ্রের সংকট বলা যেতো। কিন্তু শিক্ষিত, সুবিধাভোগী, সচ্ছল মানুষেরাও সংকটাপন্ন, নিরর্থকতার গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত।
আত্মহত্যার আরেকটি কারণ হল ভ্রান্ত ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিক্ষা, তথ্যপ্রবাহ ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ তৈরি করে থাকে। মানুষ নিজেকে আলাদা মানুষ হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে এবং সে চায় সবাই তাকে একজন আলাদা মানুষ হিসেবে সম্মান করুক। আমাদের দেশে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ভুলভাবে বিকশিত হচ্ছে। ব্যক্তি শুধু তার আবেগীয় অনুভূতিগুলোর ক্ষেত্রেই নিজেকে আলাদা করছে। মূল্যবোধ, সংবেদনশীলতা, দায়িত্ববোধ, সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা, পরিবারে ও সমাজে নিজের ভূমিকা পালন ইত্যাদি দিক থেকে তার বিকাশ ঘটছে না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ হয়ে উঠছে বাস্তবতা বিবর্জিত। ফলে আলাদা মানুষ হিসেবে তার প্রতি অন্যদের ভূমিকাকেই সে বড় করে দেখছে।
অন্যদেরকে বোঝার ক্ষেত্রে সে দায়িত্বশীলতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে পারছে না। এ ভুল ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ব্যক্তির খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। একটি মেয়ে যখন প্রতারিত বা নির্যাতিত হয় তখন তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ ও আত্মসম্মানবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মেয়েটির যদি বিবেচনা বোধ ভালো হয়, আত্মবিশ্বাস থাকে, সে এ ঘটনাটিকে মরে যাবার জন্য যথেষ্ট কারণ বলে মনে করবে না। আবার একটি ছেলে যদি প্রতারিত হয়, তখন একই ভাবে এটি একজন মানুষকে খুন করে ফেলার জন্য যথেষ্ট কারণ কিনা তা বোঝার ক্ষমতা তার থাকবে। ব্যক্তি যখন তার স্বাতন্ত্র্যবোধ দিয়ে নিজেকেই বোঝে একই সাথে অন্যদের স্বাতন্ত্র্যকে মেনে নিতে না পারে, তখন তা আত্মসচেতনতা নয়, তা সংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিকতা। এ আত্মকেন্দ্রিকতার অনেক কুফলের একটি ফল হল আত্মহত্যা বা অন্যকে নির্যাতন বা হত্যা করা।
আত্মহত্যা এখন সংখ্যায় অনেক বেশি ও অসহনীয় রকম মর্মান্তিক। দুঃখ, যন্ত্রণা, বিপর্যয় কোনটিই আমাদের সমাজে নতুন কোন ঘটনা নয়। হঠাৎ করে দুঃখগুলো যেন অনেক বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তাহলে কি আমরা আমাদের সামাজিক জীবনে ক্রমাগত একা হয়ে পড়ছি? সমাজ যদি ব্যক্তির অধিকার, মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, সমাজ যদি ব্যক্তির কোন বিপর্যয়ে সহানুভূতিশীল না হয় তাহলে সে সমাজ তার মানবিক মর্যাদা হারায়। বস্তুত, আত্মহত্যা ও সামাজিক অপরাধের বর্তমান ঘটনাগুলো আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার মানবিক অযোগ্যতাকেই নির্দেশ করছে। যারা আত্মহত্যা করে, তারা শুধু আত্মহত্যার অংশটুকু ছাড়া আমাদের মতোই মানুষ। জীবনের মর্মান্তিক পীড়নে তারা স্বাভাবিক নিয়মে আশ্রয় খোঁজে, বাঁচার নানা রকম চেষ্টা করে। সহজেই নিজেকে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা মানুষকে প্রকৃতি দেয়নি।
কী আশ্রয় মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে? মানুষ বেঁচে থাকে অপরিসীম মানসিক শক্তিতে। সে নিজের অস্তিত্বের স্বপক্ষেই চিন্তা করে। কিন্তু মানুষের মানসিক শক্তি কখনও কখনও পরাস্ত হয়। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিগুলোকে সে এত বেশি প্রতিকূল করে ভাবে যে, তার পক্ষে আর বেঁচে থাকার পক্ষে কোন সমর্থন থাকে না। একজন চরম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ, যার কাছে জীবন পুরোপুরিই অর্থহীন, যার নিজস্ব প্রতিরোধ প্রক্রিয়াগুলো পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়, সেও মনের গহীনে একটু আলো খোঁজার চেষ্টা করে। অনেকে আত্মহত্যার আগে ডেথ নোট লেখে কিংবা কোন না কোনভাবে আপনজনদের জানায়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে যারা আত্মহত্যার কিছু সময় আগে ডেথ নোট লেখে, তাদের মনে ক্ষীণ প্রত্যাশা থাকে যে কেউ তার নোটটি পড়বে এবং তাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাবে। এছাড়াও সে নানা উপায়ে তার আশেপাশের ছোট বড় যে কোন মানুষকে আত্মহত্যা প্রস্তুতির সংকেত দেয়।
কিছুদিন আগে স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে ও প্রতারণায় ক্ষিপ্ত হয়ে একজন নারী তার দুটি শিশুসহ ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি তার ড্রাইভারকে ঘুমের ঔষধ আনতে পাঠান এবং এর বিনিময়ে তাকে গাড়িটি দিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এটি ছিল আত্মহত্যার চরম সিদ্ধান্তের মধ্যে এটি একটি পিছুটান। মহিলা তার ড্রাইভারটিকে আশ্রয় করতে চেয়েছিল। ভেবেছিল তার এ চরম সিদ্ধান্ত শুনে ড্রাইভারটি নিশ্চয় কোন না কোন পদক্ষেপ নেবে। ড্রাইভার সে সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মহিলা ও শিশুদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতো। কিন্তু অসৎ লোকটির কাছে তিনটি মানুষের জীবনের চেয়ে গাড়িটি বরং বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছিল। এভাবে যখন মানুষ আর একটি খড়কুটোও আশ্রয় করতে পারে না তখনই আত্মহত্যা সংঘটিত করে। অর্থাৎ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ও আত্মহত্যা করার মাঝখানে যে সময়টুকু থাকে সে সময়টুকুই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময়টাতে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তার পরিবার, আপনজন, বন্ধুবান্ধব, এবং সংবেদনশীল মানুষেরা।
এখন আমাদের সমাজে মানুষের এ আশ্রয়গুলো আর নেই। অর্থাৎ আমরা আমাদের সংবেদনশীল হৃদয়কে বিসর্জন দিয়েছি, কিংবা সংবেদনশীলতা অর্জনের প্রক্রিয়াটি ভুলে গেছি। একজন মানুষ আত্মহত্যা করার পর সবাই বলে, আত্মহত্যা করার কী দরকার ছিল, আমরা তো ছিলাম, ইত্যাদি। মানুষ আত্মহত্যাকারীকেই প্রকারান্তরে দোষারোপ করে। কিন্তু ব্যক্তি যখন প্রবল হতাশা আর যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে ধ্বংসকামী হয়ে উঠছে তখন তার পাশে কিন্তু কেউ নেই, যে বলবে, আমি আছি, আমরা আছি।
আত্মহত্যা সবসময়ই মানসিক পীড়ার প্রতি তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া নয়। অনেক সময় ব্যক্তির ভেতর আত্মহত্যার ইচ্ছে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। এর পেছনে কাজ করে প্রবল নিরর্থকতা ও ধ্বংসকামিতা। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের নিরর্থকতা ও ধবংসকামিতার বড় কারণ প্রবল ভোগবাদী জীবনযাত্রা। ভোগবাদী মানুষেরা যখন আকণ্ঠ ভোগের ভেতর নিমজ্জিত থাকে তখন তাদের সকল কামনা বাসনা তাদের বিবেক ও ইগোকে অকার্যকর করে দেয়। ভোগের সীমা অতিক্রম করার পর ব্যক্তির ভেতর জন্ম নেয় বিকৃতি, অপচয়- যার অবশ্যম্ভাবী ফল হল জীবনের প্রতি নিরর্থকতার অনুভূতি যা ভয়ানক হতাশাব্যঞ্জক, বিষাদময়। আর, আমাদের দেশে এ নিরর্থকতা ও ধ্বংসকামিতার কারণ প্রবল বঞ্চনা ও অসহয়াত্ববোধ। যাকে দার্শনিক পরিভাষায় অস্তিত্বের সংকট বলা হয়। এ ধরনের নিরর্থকতাবোধ জীবনের মহিমাকে ম্লান করে, জীবন-জগতের প্রতি ব্যক্তির ধারনা হয়ে উঠে ভয়াবহরকম নেতিবাচক। বেশির ভাগ মানুষই এ মানসিক পীড়া থেকে বাঁচার জন্য বিধ্বংসী, নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর হয়ে উঠে। তার বিধ্বংসী মানসিকতাই কোন কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে আত্মঘাতী রূপ নেয়।
আজকাল আত্মহত্যার সাথে যোগ হয়েছে ইভটিজিং নামে নারী নির্যাতনের বিষয়টি। রাস্তার বখাটে তরুণ, সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষক, জনগণের নির্বাচিত নেতা, অনেকেই এখন নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্যাতনকারী হয়ে উঠেছেন। ইভটিজারদের নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নানা রকম আইন করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ ব্যাপারে তৎপর। কিন্তু একবার কি আমরা ভেবে দেখেছি আমাদের সমাজের মানুষেরা হঠাৎ কেন ইভটিজার হয়ে উঠল, সাইবার অপরাধী হয়ে উঠল? ঘটনা ঘটে যাবার পর একজন দুস্কৃতিকে শাস্তি দিলে তা ক্ষত উপশম করে, কিন্তু ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে না। একজন ইভটিজারকে কারাদণ্ড দিয়ে একজন সম্ভাবনাময় তরুণীর জীবন ফিরে আসে না। শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার মধ্যে ব্যস্ত না থেকে এগুলোর কারণ অন্বেষণ করা দরকার, প্রয়োজন যথাযথ প্রতিরোধ।
ইভটিজিং প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল, যন্ত্রসভ্যতার অপব্যবহার। অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের ফলে উন্নত প্রযুক্তির মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু জীবনের আপাতদৃষ্ট চাকচিক্য, প্রযুক্তি ব্যবহারের ছড়াছড়ি দেখে ‘আমরাও খুব সভ্য হয়ে উঠছি’- এমন আশাবাদ পোষণ করার সুযোগ নেই। কেননা মানুষ প্রথমত বেড়ে উঠে বিবেকে, বুদ্ধিতে, মনুষ্যত্বে ও মূল্যবোধে। মানুষ যদি মানবিকভাবে বিকশিত থাকে যন্ত্রসভ্যতা তাকে গ্রাস করতে পারে না। যন্ত্রসভ্যতার ও তথ্যপ্রযুক্তির পরিশীলিত ব্যবহার করে তার অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিয় বা সৃষ্টিশীল প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু উপকরণগুলোর মূল্যায়ন করার ক্ষমতা যদি অর্জিত না হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তি বিবেকহীন যন্ত্রের অধিকারে চলে যাবে। আমাদের দেশে সে ঘটনাটিই ঘটে চলেছে। অকালপক্ব শিশুর মতো অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির অন্ধ আগ্রাসন বেড়ে উঠেছে আমাদের প্রস্তুতির আগেই। মানুষ হয়ে উঠেছে ভোগবাদী, বস্তুকেন্দ্রিক, স্বার্থপর। ফলে সকলের অগোচরেই এ জনপদের মানুষরা যন্ত্রসভ্যতা ও তথ্যপ্রযুক্তির বিরাটাকার দানবীয় শক্তির পদতলে পিষ্ট হয়ে চলেছে নিরন্তর। এখন আমাদের সমাজের বাস্তবতায় অবাধ তথ্য প্রবাহ শিশুর হাতে মারণাস্ত্রের মতো বিপদজনক হয়ে উঠেছে।
যখন ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোন নিয়ে সময় কাটানোর প্রচলন হয়নি তখন আমাদের ছেলেমেয়েরা কিছু করার না থাকলে বই পড়তো অথবা বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দিত। বাবা মা দেখতেন, তার সন্তানটি কার সাথে মিশছে, কী বইটি পড়ছে, বইটি সন্তানের বয়সোপযোগী কি না। কিন্তু এখন মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের অবাধ তথ্য প্রবাহে কী আছে, কারা আছে বন্ধুত্বের তালিকায়, বাবা মা কি খোঁজ রাখেন? খোঁজ রাখলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কি তারা রাখেন? কারণ আমরা জানি তথ্য প্রবাহের সব তথ্যই খুব সৎ বা আদর্শবাদী বা সুস্থ ধারার তথ্য নয়। এটি আরেক পৃথিবী যেখানে ভাল এবং মন্দ দুটোরই প্রাধান্য প্রবল। মানুষের প্রবণতা হল, সে তার প্রকৃতি, চাহিদা, রুচি ও মূল্যবোধ অনুযায়ী তার জীবনের জন্য উপকরণ নির্বাচন করে এবং কাজে লাগায়। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি সত্যি। আমাদের ছেলেমেয়েরা যে ক্ষতিকর ভারচুয়াল জগতে বিচরণ করছে তা থেকে প্রকৃত সামাজিক প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। তাতে কি থেমে থাকবে সে? তার ভেতর জাগ্রত আদিম প্রবণতা দানবীয় শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। (একটি মেয়েকে সে শুধু ধর্ষণই করছে না, তার অমানবিক আচরণের এ পরমানগুলো ইন্টারনেটে বিকৃত মানুষদের জন্য সরবরাহ করছে। এ মানুষগুলোকে পশু বললে পশুদের অপমান করা হয়।)
আমরা পারবো না প্রযুক্তির পথকে রুদ্ধ করে দিতে, কিংবা ব্লু টুথ বা শেয়ারইট নামক এ্যাপগুলোকে অকার্যকর করে দিতে। সেটি বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু আমরা প্রযুক্তির হাতে আমাদের সন্তানদের সমর্পণ করার আগে একবারও কি ভেবে দেখি, প্রযুক্তির বিশালতা ও বৈচিত্র্য ধারণ করার মতো বিশাল হৃদয় ও মানবিক যোগ্যতা তাদের ভেতর তৈরি করতে পেরেছি কি না? প্রযুক্তির খারাপ বিষয়গুলো বর্জন করে ভালো বিষয়গুলো নেয়ার মানসিক প্রস্তুতি সে অর্জন করেছে কিনা? একজন কৃষক তো জানেন তার জমির ধরণটি কি, তাতে কতটা সার দেয়া দরকার। আমরা কেন এত সাধারণ বিষয়টি জানি না? বছরখানেক হল, চট্টগ্রামে চুয়াল্লিশ জন শিশু মরে গেল একজন চরম মানবতাহীন গাড়িচালকের মোবাইল বিলাসিতার জন্য! একদিন কালো ব্যাজ আর পত্রিকায় লেখালেখি ছাড়া, আমরা কী করেছি? শুধু গাড়ি চালানোর দক্ষতা আছে কি নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স বৈধ কি অবৈধ, এসব নিয়েই আমাদের যত আলাপচারিতা। এ চালকগুলোর বুকের ভেতর একটি হৃদয় যে নেই, তারা যে এখন ব্রেকহীন গাড়ির চেয়ে ভয়ানক যন্ত্র, সে কথা আমরা একবারও বলছি না। ভাবছি না এ সমাজের মানুষের মানবীয় পতনের কারণগুলোর কথা।
কেন আমাদের সমাজের মানুষগুলোর কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে নিজের ক্ষণিক আনন্দ এত বড় হয়ে উঠল, তা নিয়ে ভাববার জন্য কিছু সময় কি আমরা ব্যয় করেছি? আমরা শুধু আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করি। এ আইনগুলোকে মানুষের জীবনের প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করি না। আমি আইন কেন মানব? আইন কি কোন দেবতা? আমরা আইন মানব কারণ, আইন মানুষের কল্যাণের জন্য প্রণীত, আইনের উদ্দেশ্য হল মানুষের নিরাপত্তা বিধান, মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক অস্তিত্বকে পালন করা। মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধই যদি তৈরি না হলো তাহলে আইন মানার প্রয়োজনবোধ কোথা থেকে আসবে? এ দায়িত্ববোধ একজন অশিক্ষিত গাড়ি চালকের নেই, সকল শিক্ষিত গাড়ি মালিকের কি যথাযথভাবে আছে? এক কথায়, নেই। এসব নিয়ে প্রতিবাদ শুধু প্রতিবাদের মিছিলের মধ্যেই চোখের পানিতে আর দীর্ঘশ্বাসে শেষ হয়ে যায়। প্রতিরোধের আলো কখনও দেখে না। যেন তার কোন প্রয়োজনও নেই। আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যস্ত।
এ অবস্থা চলতে দেয়া যায়না। যারা বিকৃত কামনা বাসনার জন্য সতর্ক সিরিয়াল কিলার, অসতর্ক খুনী, যারা নিরর্থকতাবোধের দ্বারা তাড়িত হয়ে আত্মহত্যা করে, যারা অন্যদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে, যারা সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সুস্থ, সুখী ও গঠনমূলক ধারাকে ভেঙে দেয়, তারা সবাই অসুস্থ। এরা রাষ্ট্রের এবং সমাজের অব্যবস্থা ও অপরিনামদর্শিতার সুযোগে তৈরি বিকৃত মানুষ। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো একজন সিজোফ্রেনিক রোগী সমাজের জন্য বিব্রতকর কিন্তু অকল্যাণকর নয়। কিন্তু জীবনযাপনের সুস্থতা বিনষ্টকারী তথাকথিত সুস্থ মানুষগুলো সমাজের জন্য অকল্যাণকর। এবং একটি সমাজের পতনের জন্য এ জাতীয় মানুষ খুব বেশি থাকার প্রয়োজন হয়না। কিন্তু আমাদের সমাজে এ জাতীয় মানুষের সংখ্যা আশংকাসীমার চাইতে অনেক বেশি।
আমরা সকলেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি এমন নয়। কিন্তু আশংকার কথা হল আমাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ প্রক্রিয়া ভুল পথে এগুচ্ছে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যখন ভুল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে তখন ব্যক্তির মধ্যে একটি সংকটাপন্ন অবস্থা থাকে। যে কোন অব্যবহিত বা তাৎক্ষণিক মানসিক চাপ, অস্থিরতাই তখন তার মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে। ব্যক্তি হয়ে উঠে আত্মপীড়নকারী বা অন্যকে পীড়নকারী। এটি ক্যান্সারের মতো শারীরিক ব্যাধির চাইতে বহুমাত্রায় বিপদসংকুল। ক্যান্সার একজন মানুষের জীবন সংহার করে, পরিবারের জন্য মানসিক কষ্ট ও আর্থিক বিপর্যয় আনে। কিন্তু মানসিক বিকারের সংক্রমণ সমাজের মর্মমূলে আঘাত করে এর ধ্বংস ডেকে আনে। মানুষ এক অন্যের আচরণ অনুকরণ করে শেখে।
মানবিকভাবে অনগ্রসর মানুষেরা অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য আচরণগুলো নিজের অগোচরেই অনুকরণ করতে শুরু করে। ফলে এগুলোও শারীরিক ব্যাধির মতো সংক্রামক হয়ে উঠে। আমাদের সমাজের অবস্থাটি এখন এরকম যে, কোন আচরণটি সমাজের জন্য ভালো, কোন্টি সমাজের জন্য ভালো নয় সে বিষয়ে খুব স্পষ্ট কোন বর্ডার লাইন নেই। সমাজের সর্বত্র অব্যবস্থা ও অনুপযোগী আচরণ এত বেশি ঘটে চলেছে যে, ভালো কী হতে পারতো, তা যেন মানুষ জানেই না বা ভুলে গেছে। এখন রাস্তাঘাটে, স্কুলে বা হাসপাতালে যথেচ্ছা হর্ন শুনে মানুষ খুব একটা বিরক্ত হয় না। হয়তো এ আচরণটি যে অসভ্যজনোচিত তা চালক এবং পথচারী উভয়েই বিস্মৃত হয়েছে। কিংবা এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মানুষ এখন আর মেজাজ খারাপ করতে চাইছে না। এ রকম আচরণের হাজারো উদাহরণ আছে যেগুলো একত্রে সমাজমানসকে বিকৃত করে তুলেছে।
একজন তরুণী যাতে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, একজন তরুণ যেন ইভটিজার, মাদকাসক্ত এবং খুনী না হয়ে উঠে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রথমত পরিবারের, তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং সমাজের। এ পুরো বিষয়টি দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কারণ পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রের প্রবর্তিত নিয়মনীতিগুলোর চর্চা হয়, এগুলো পালিত হয়। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয় উপলব্ধিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলীয়ান করা। কিন্তু এ সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক তো মানুষ। মানুষগুলোর মনোজাগতিক বিকাশ না ঘটলে কী করে পরিবর্তন সম্ভব? যিনি সুস্থ, বিকশিত মানুষ তিনি বিনা বিতর্কেই একজন ভাল নেতা, ভালো শিক্ষক, ভালো প্রশাসক, প্রতিশ্রুতিশীল ব্যবসায়ী, সফল পিতামাতা, সর্বোপরি নিজ পেশায় ও জীবনে সুষ্ঠুভাবে অভিযোজনক্ষম। কাজেই সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানবিক বিকাশের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। রাষ্ট্র যখন সমাজ মানসের মানবিক বিকাশের দিকটিকে প্রাধান্য দেবে তখন স্বাভাবিক ভাবেই এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্রকে প্রথমেই স্থির করতে হবে, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি ধরণের মানবিক যোগ্যতা দিয়ে তৈরি করতে চাই।
রাজনীতি অনেক হয়েছে, অর্থ উপার্জনের মতো যোগ্যতা সম্পন্ন নাগরিক তৈরির কার্যক্রমও চলছে পুরোদমে। এখন প্রয়োজন মানুষের সামাজিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করতে ও মানুষের মানবিকবোধগুলোর উন্নতিবিধান করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতন লক্ষ্য নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অবিলম্বে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ। প্রয়োজন শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ভাবে মানবিক বিকাশের চর্চাকে অন্তর্ভুক্ত করা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের শিক্ষায়, পারিবারিক জীবনাচরণে, সামাজিক বাস্তবতায় সুস্থ মানুষ, বিকশিত মানুষ গড়ে তোলার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। মানুষের প্রতি যত্নশীল হবার, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে রাষ্ট্রকেই। রাষ্ট্রীয় উপলব্ধি, আন্তরিকতা ও দূরদর্শী প্রজ্ঞাই পারে মানুষকে মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে।
একটা সময় ছিল যখন পরিবারের ভূমিকা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবার প্রয়োজন ছিল না। চারপাশে নষ্ট হয়ে যাবার মতো উপকরণ খুব বেশি ছিল না। মানুষের জীবন যাপনে কিছু মাত্রায় সারল্য ছিল। ফলে সন্তান লালন পালন বিষয়টিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মিশন হিসেবে নেয়ার প্রয়োজন পড়তো না। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থাটির পরিবর্তন ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তি ও তথ্য প্রবাহের ব্যাপকতা সমাজের চিরাচরিত কাঠামোকে বদলে দিয়েছে।
সন্তানের সাথে পিতামাতার প্রজন্ম পার্থক্য ও বোধগম্যতার পার্থক্য সবসময়ই থাকে। কিন্তু এ পার্থক্য এখন অনেক অনেক বেশি। এখনকার বাবা মায়েরা তাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে গিয়ে অনেকটাই যেন দ্বিধাগ্রস্ত। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সন্তানদের কাছে কেবল তথ্যকে সুলভ করেছে কিন্তু তাদের বিবেকবান, দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল করে তৈরি করার দায়িত্ব নেয়নি। এ দায়িত্বটি পরিবারের ছিল, আছেও। এ দায়িত্বটি এখন পরিবার কীভাবে পালন করবে সে সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা খুব প্রয়োজন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শুধু আর্থিকভাবে উন্নত নয়, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী যে ধরনের মানবিক প্রস্তুতি দরকার সেটি তাদের আছে। ফলে গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সেসব দেশের পরিবার ও সন্তানেরা স্পষ্ট ধারণা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে খুব সম্প্রতি গতিশীল হওয়া অর্থনীতির সাথে সাথে আমাদের মানুষ হয়ে উঠার প্রক্রিয়াটি গতিপ্রাপ্ত হয়নি। বরং তা অনেক ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী হয়েছে বলা যায়।
প্রথমেই সমাজের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর ক্ষত সারানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর সাথে চালাতে হবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই জানেনা বা মানতে চায় না যে, ব্যক্তির আচরণগত সমস্যা তার শারীরিক সমস্যার মতোই একটি সমস্যা। সর্দিকাশি বা জ্বর হলে আমরা যেমন ডাক্তারের কাছে যাই তেমনি আচরণগত সমস্যার সমাধানে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া যায়, যেটি কোনভাবেই পরিবারের জন্য গ্লানিকর নয়। এ অজ্ঞানতার দোষ জনগণের নয়। আমাদের সমাজের সচেতন জনগণ ও নীতিনির্ধারকগণ মানুষের কাছে এ তথ্যটি দিতে পারেননি। আর মানুষ সাহায্য চাইতে যাবেই বা কোথায়? প্রথম থেকেই আমাদের দেশে মনোবিজ্ঞান নামক অতি প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক বিজ্ঞানটি আশংকাজনকভাবে অবহেলিত, অচর্চিত। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মানুষ জানে, মানসিক বিকাশকে স্বাভাবিক, সুস্থ ও উপযোজনক্ষম করার জন্য মনোবিজ্ঞানের ব্যাপক ও বিস্তৃত প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। মনোরোগের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। চরম অবস্থায় চলে যাওয়া কোন মনোরাগকে আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি, চিকিৎসা করার প্রয়োজন অনুভব করি। কিন্তু আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ নানা রকম আচরণগত সমস্যা নিয়ে বড় হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে তাদেরকে স্বাভাবিক মানুষ মনে হলেও তাদের ব্যক্তিত্ব ভুল পথে এগুচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখে তাদেরকে স্বাভাবিক মানুষ মনে করার কারণ নেই। এদের সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া না জানার ফলে সমস্যাগুলো বাড়তেই থাকে। আমাদের পরিবারগুলোর জানা নেই, এ সংকটগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য কার্যকর কিছু পন্থা রয়েছে। শারীরিক চিকিৎসার মতোই মনোজগতের হন্তারক সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে সাহায্য করতে পারেন একজন মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলর। তিনি ব্যক্তির ভেতরকার উপযোজন করার উপাদানগুলো খুঁজে বের করেন। একজন হতাশাগ্রস্ত, বিপর্যস্ত মানুষকে যে কোন ধ্বংসমূলক কার্যক্রম থেকে ফিরিয়ে এনে তার জীবনবোধকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারেন। বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলো মানুষের নানা রকম সমস্যার সমাধানে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগায়। অনেক দেশেই জনগণের দোরগোড়ায় শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা। সেখানে জীবনের ছোট বড় নানা উপযোজনমূলক সমস্যায় মানুষ প্রয়োজনীয় পরামর্শ পায়। আমাদের দেশেও এর প্রয়োজনীয়তা মানুষ প্রবল ভাবে অনুভব করে। টেলিভিশনে বা সংবাদপত্রে যারা মনোজগতের নানা সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন, জনগণ প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে চায়। এতে বোঝা যায় মানুষ পেশাগত সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করছে। মানুষের এ প্রয়োজনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। এবং সে কাজটি শুরু করা দরকার এখনই।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি মানুষকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টাটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা দরকার। শিক্ষাক্ষেত্র এর উপযুক্ত স্থান। অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত মানুষ তৈরির লক্ষটি আমরা এখনও স্থির করতে পারিনি। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার প্রক্রিয়ায় আমরা তৈরি করতে চাইছি গণিতবিদ, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের শিক্ষায় সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ ভীষণভাবে অবহেলিত হচ্ছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ বিষয়গুলো পড়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ শিক্ষানীতির প্রচলিত মনোভাব থেকে শিক্ষার্থীরা এ ধারণা পাচ্ছে যে যারা কম মেধাবী তারাই সামাজিক বিজ্ঞান বা কলা বিষয়ে পড়ালেখা করবে। ফলে দেশে মেধাবী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞান প্রফেশনাল গড়ে উঠছে, কিন্তু গড়ে উঠছে না মেধাবী সমাজ বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের কোন চিন্তাশীল সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী প্রয়োজন নেই। অথচ আমরা সবাই জানি, আমরা সামাজিক জীবনে এমন কোন উৎকর্ষ অর্জন করিনি যে, আমাদের সামাজিক বিজ্ঞানের জ্ঞানসম্পন্ন সমাজ সচেতন জনশক্তির প্রয়োজন নেই। বরং আমরা যে কোন সভ্য সমাজের চেয়ে কম করে হলেও শতাব্দী কাল পিছিয়ে আছি। কাজেই আমরা যাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের শিক্ষাকাঠামো নির্মাণ করছি, তাদের সাথে আমাদের মানবিক উৎকর্ষের জগতের ব্যাপক ফারাকটি বিবেচনায় নেয়া উচিত।
একটি সমাজের মানুষ সকলেই মনোবিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার মাধ্যমে উচ্চস্তরের জ্ঞানী হয়ে উঠবে এটা আশা করা বাতুলতা। কিন্তু শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে এটি আশা করা মোটেই বাতুলতা নয়। জ্ঞান একটি আলো যা ব্যক্তির ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি আশেপাশের অজ্ঞান মানুষের মধ্যেও অজান্তে ছড়িয়ে যায়। একজন গৃহপরিচারিকা এবং একজন রিকশাওয়ালাও জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শে আলোকিত হয়। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বিশ্বসভ্যতা বিকাশের বহুকাল আগে সত্যসন্ধানী মানুষ সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিয়েছিলেন। তিনি একটি গল্পের মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। একদল মানুষ একটি পাহাড়ের গুহায় সারা জীবন ধরে বন্দি। তাদের উপর শুধু একটু প্রদীপ জ্বালানো থাকে। এ প্রদীপের আলোয় পাহাড়ের দেয়ালে নিজেদের ছায়াগুলো বিশ্লেষণ করা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ নেই। তাদের মধ্যে একজন কোনভাবে বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরের পৃথিবীতে যাবার সুযোগ পেল। বাইরের পৃথিবীর অসম্ভব আলো ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ লোকটি গুহায় ফিরে এসে তার বন্ধুদের বাইরের পৃথিবীর বর্ণনা করল এবং এখান থেকে পালানোর বুদ্ধি দিল। কিন্তু গুহায় জীবন পার করে দেয়া লোকগুলোর কাছে সে অদৃশ্য জগতের বর্ণনা মোটেও বাস্তব মনে হলো না। তারা সেখান থেকে যাবার আগ্রহও দেখাল না। বরং তারা এ খবর বহনকারী মানুষটিকে সকলে মিলে হত্যা করলো। এ গল্পটির মাধ্যমে প্লেটো বলতে চেয়েছেন, সকল আত্মাই সত্যানুসন্ধানী নয়। যারা সত্যানুসন্ধানী নয় তারা তাদের জানা জগতটিকেই একমাত্র সত্য ধরে নিয়েই জীবন পার করে দেয়।
প্লেটোর এ গল্পটি অন্যরকম হতে পারতো যদি একাধিক মানুষ গুহা থেকে বের হতে পারতো। আমাদের সমাজমানস এখন এরকম গুহাবাসী হয়ে আছে। তাদের?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)