১.
নাসিরনগরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে শঙ্কার ভেতরে রয়েছে সাধারণ মানুষ, আসলে ‘সাধারণ মানুষ’ বলাটা ঠিক হবে কি না জানি না; তবে এটুকু বলতে পারি- শঙ্কিত দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, শঙ্কিত দেশের প্রগতিশীল মানুষ, শঙ্কিত দেশের বিবেকবান মানুষ। আমার এই লেখা ঘটনার অন্যপাশের মানুষদের উদ্দেশে। যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, যারা ঘটনাটিকে সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন, যারা সবকিছু দেখেশুনে নীরব থেকে ফায়দা তুলছেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে এই লেখা।
তর্কের খাতিরে ধরেন মেনেই নিলাম কোথাকার কেউ একজন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার উদ্দেশ্যেই একটা ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেছে (যদিও সেটা হবার কোন সুযোগ নেই, কারণ রসরাজ নামক জেলের পক্ষে এই ছবি ফটোশপ করা অসম্ভব এবং তার ফেসবুক একাউন্টটি অন্য কেউ ব্যবহার করতো বলে গোয়েন্দা পুলিশ মতামত দিয়েছে), তাতেই আপনি তিনশ বাড়ি-ঘর-মন্দির-প্রতিমা ভেঙ্গে-চুরে,পুড়িয়ে, দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে দিতে পারেন কোন যুক্তিতে? এতগুলো মানুষকে বিনা অপরাধে একেবারে নিঃস্ব করে দিলেন কোন যুক্তিতে? সংখ্যাগুরু হয়ে এসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন কেমন করে?
না… না… আপনি নিজ হাতে ভাঙ্গেননি, কিন্তু চুপ থেকে সমর্থন তো ঠিকই যুগিয়ে চলছেন এবং ভবিষ্যতেও চলবেন। সেই আপনিই আবার সম্প্রীতির কথা বলেন, সৌহার্দের কথা বলেন।
আসলেই সংখ্যাগুরু চরিত্র বড় বিচিত্র। তুমিই মারো, তুমিই বিচার করো আবার তুমিই জাস্টিফাই করো। এই গতকালই আমার একটি লেখায় একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন এই ভাষায়-
“ওদেরও ভুলে গেলে চলবে না যে;
ওরা বাংলাদেশে বাস করছে…”
সংখ্যাগুরুর চরিত্র এমন করেই প্রকাশিত হয়ে যায়। হাজার বছরের ‘আমরা’ দিন শেষে ‘ওরা’ হয়ে গেলো…
২.
ঘটনার দিন রাতেই আইনমন্ত্রী এক টক-শোতে বলেন-
‘আমি সাথে সাথে ফোন করে প্রশাসন কে বলেছি যা হবার হয়েছে আর যেন না হয়।’
ভাবা যায়! ৩০০ বাড়িঘর এবং মন্দির ভাংচুরের পর এক টক-শো’তে মন্ত্রী মহোদয় এই কথা বলেছেন? ভাবখানা এমন; যা হবার হয়েছে, এসব বাদ দেন, আমরা বরং সামনের দিকে এগিয়ে চলি। তবে দেখা গেলো মন্ত্রী আচ্ছা করে বকে দেয়ার পরও ‘আর যেন না হয়’ পালিত হয় নাই। পরদিনও সেই এলাকায় ভাংচুর হয়েছে, আগুন লাগানোর মত ঘটনা ঘটেছে।
এই যে মন্ত্রীর ‘আর যেন না হয়’ বলা, সেটার একটা প্রেক্ষাপট আছে। সংখ্যালঘুদের ওপর এই আক্রোশ আজ নতুন নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখে আসছি এই অবস্থা। এই দেশের একটা শ্রেণীর সংখ্যাগুরু মানুষ কোন এক অজ্ঞাত কারণে মেনে নিতে রাজি নয় যে হিন্দুরা এই দেশের নাগরিক। অথচ যারা ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ রাখে তারা জানেন যে ইতিহাস বলে এই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচাইতে বেশি নিপীড়নের স্বীকার হয়েছিলো এই সংখ্যালঘুরাই। অর্থাৎ শক্তভাবে বললে এই দেশের ওপর এই সংখ্যালঘুদের অধিকার আসলে বেশি।
কথা সাহিত্যিক আহমদ ছফা তার ‘বঙ্গভূমির আন্দোলন, রাষ্ট্রধর্ম, মুক্তিযুদ্ধঃ বাংলাদেশের হিন্দু ইত্যাকার প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে সহজ কথাটা সহজে বলে গিয়েছেন-
‘পাকিস্তানের ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি অস্বীকৃতি ছিল বাঙালী তথা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানীদের স্বাধিকার আন্দোলনের মুখ্য দাবী। স্বভাবতই বাংলাদেশের হিন্দুরা এই আন্দোলনের সাথে নিজেদের জড়িত করে ফেলেন। তাঁদের আকাঙ্খা ছিল ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্থানের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তাঁরা সেখানে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মত সব রকম নাগরিক অধিকার পাবেন।
এই একটি মাত্র আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হয়ে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এই যুদ্ধের কাছ থেকে তাঁদের প্রত্যাশার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। তাঁদের জানমালের ওপর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে একক সম্প্রদায় হিসেবে অন্য কারো সঙ্গে তার তুলনা চলতে পারে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাথমিক যে রোষ তা হিন্দু-সম্প্রদায়কেই সর্বাপেক্ষা অধিক সহ্য করতে হয়েছে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেছে বেছে হিন্দু বস্তিতে আগুন লাগানো, তাঁদের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, অধিবাসীদের হত্যা করা, মঠ-মন্দির-দেবালয় ধ্বংস করা, এসবের পেছনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটা সুগঠিত পরিকল্পনা ছিল…’
পাকিস্তানীরা প্রকাশ্যে যেভাবে হিন্দুদের হত্যা করছিলো সেটার সানডে টাইমসের পাকিস্তান-প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যারেসকানহাসের বিখ্যাত ‘জেনোসাইড’ প্রবন্ধে পরিস্কারভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়-
“আবদুল বারী ভাগ্যের ভরসায় দৌড় দিয়েছিল। পূর্ব বাংলার আরো হাজার মানুষের মতো সেও একটা ভুল করে ফেলেছিলো- সাংঘাতিক ভুল- ও দৌড়াচ্ছিলো পাকসেনাদের একটি টহল-সেনাদলের দৃষ্টিসীমার মধ্যে। পাকসেনারা ঘিরে দাঁড়িয়েছে এই চব্বিশ বছরের সামান্য লোককে। নিশ্চিত গুলির মুখে সে থরথরিয়ে কাঁপে। “কেউ যখন দৌড়ে পালায় তাকে আমরা সাধারণত খুন করে ফেলি,” ৯ম ডিভিশনের জি-২ অপারেশনস-এর মেজর রাঠোর আমাকে মজা করে বলেন।
“ওকে খুন করতে হবে কেন?” উদ্বেগের সঙ্গে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
“কারণ হয় ও হিন্দু, নয়তো বিদ্রোহী, মনে হয় ছাত্র কিংবা আওয়ামী-লীগার। ওদের যে খুঁজছি তা ওরা ভালমতো জানে এবং দৌড়ের মাধ্যমে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে।”
“কিন্তু তুমি ওদের খুন করছো কেন ? হিন্দুদেরই বা খুঁজছ কেন?” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। রাঠোর তীব্র কন্ঠে বলেন: “আমি তোমাকে অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে চাই, তারা পাকিস্তান ধ্বংস করার কী রকম চেষ্টা করেছে। এখন যুদ্ধের সুযোগে ওদের শেষ করে দেয়ার চমৎকার সুযোগ পেয়েছি।”
“অবশ্য,” তিনি তাড়াতাড়ি যোগ করেন,
“আমরা শুধু হিন্দুদেরই মারছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই।”
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সূচনা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নামক একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সেই যুদ্ধে তিরিশ লক্ষাধিক মানুষ শহিদ হয়েছেন, চার লক্ষের অধিক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছেন, দেড় কোটি মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এবং এই নিপীড়নের শিকার মানুষদের বড় অংশ ছিলেন আজকের আলোচিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের ধর্ম বিশ্বাস ইসলাম এই যুক্তিতে যদি সংখ্যালঘুদের নিগ্রহ সহ্য করতে হয় তাহলে বলতে হয় যে- বাংলাদেশ গঠনে যারা জীবন দিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগের ধর্ম বিশ্বাস কিন্তু ইসলাম ছিল না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতেই অকাতরে তাঁরা নিজেদের জীবন-ইজ্জত-সম্মান-সম্পদ বিলিয়েছেন। তাঁরা একটা আকাঙ্খাতেই এতোটা করেছিলেন-
বাংলাদেশে তাঁরা হারানো সম্মান ফেরত পাবেন…
৩.
প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী সংখ্যালঘুদের ‘মালাউন’ সম্বোধন করেছেন বলে খবর এসেছে, যদিও মন্ত্রী অস্বীকার করেছেন এবং যেহেতু মন্ত্রীর ‘মালাউন’ উচ্চারণের কোন ভিডিও নেই সুতরাং মন্ত্রীর সমর্থক গোষ্ঠীরা ক্রমাগত দাবী করছেন এই বলে যে মন্ত্রী এই কথাগুলো বলেননি। যদিও এমন ভিডিও গণমাধ্যমে আসছে যেখানে দেখা যাচ্ছে- এই ব্যাপারে জেরার মুখোমুখি হওয়ায় সাংবাদিকদের সাথে অত্যন্ত বাজে ব্যাবহার করছেন মন্ত্রী, এমন ভিডিও আসছে যেখানে তিনি বলছেন- ‘তেমন কিছু হয়নি’, এমন ভিডিও আসছে যেখানে তিনি বলছেন- ‘ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে’। তিনি উসকানি দেয়া ইউএনও আর পুলিশদের রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধীদের সাথেই মোলাকাত করে বেড়াচ্ছেন। সর্বোপরি তিনি প্রথম থেকেই ঘটনাটিকে অস্বীকার করে অপরাধ লঘু করার চেষ্টা করে চলছেন, যদিও এলাকাটা স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয়ের।
অপ্রাসঙ্গিকভাবেই একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনার কথা স্মরণ করি। গত-বছর মোটামুটি এই সময়েই রোমানিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর পন্টা পদত্যাগ করেছিলেন।
গত বছর বুখারেস্টের একটি নাইট ক্লাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেখানে একটি ব্যান্ডদল যখন আতশবাজির প্রদর্শন করছিল তখন আগুন লেগে যায়। সেই নাইট ক্লাব থেকে বের হবার একটি মাত্র রাস্তা ছিলো। সেই ঘটনায় ৩২ জন মারা যায়। উল্লেখ্য অগ্নিকাণ্ডের পর নাইট ক্লাবটির তিন মালিককে গ্রেফতার করা হয়।
রোমানিয়ার নাইট ক্লাবের সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ করে সেই দেশের জনগণ আর তার পরদিনই প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ ছিল সরকারের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যাবস্থার কারণেই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সত্য মিথ্যা যাই হোক বিষয়টি আমলে নিয়ে মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সাথে এই ঘটনাকে মিলিয়ে ফেলবেন না প্লিজ। সবকিছু দেখে-শুনে সবার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে মন্ত্রী তো দূরে থাক একটা মাছিও দায়িত্বে অবহেলা করে নাই।
শামসুর রাহমানের খুব একটা বিখ্যাত কবিতার নাম ‘অভিশাপ দিচ্ছি…’। কবিতার বিষয়বস্তু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী। কবি অভিশাপ দিয়েছেন সে সমস্ত নেকড়েদের যারা কবিকে বাধ্য করেছিলো নিজের জনক-জননীর রক্তাক্ত লাশকে পার হয়ে যেতে। মালাউন শব্দের অর্থ ‘অভিশপ্ত’। এই জাতির সবচাইতে অভিশপ্ত মানুষ হবার কথা সেই সমস্ত যুদ্ধাপরাধীর। অথচ এই জাতিরাষ্ট্র জন্মের পেছনে সবচেয়ে বেশি হত্যা-ধর্ষণ-নিগ্রহ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল যেই গোষ্ঠীর মানুষেরা, আজ ৪৫ বছর পরে তারাই এই দেশে ‘অভিশপ্ত’ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডঃ নাসরিন চৌধুরী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ফেসবুক দেয়ালে যে কথাটি লেখেন তা স্মরণ করছি-
‘ভয়ানক অপমান, ভয়াবহ লজ্জা, আমিত্ববোধের চরম অশ্রদ্ধা। মন্ত্রী সুন্দর কথা বলেছেন, ধন্য অাপনার মনুষ্বত্যবোধকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কাবা শরীফ রক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাঠাতে প্রস্তুত, কিন্তু নিজ দেশে অন্য ধর্মাবলম্বীরা যখন অত্যাচারের শিকার তখন কোথায় থাকে আপনার সেসব আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী? বোধহয় স্বপ্নে বিভোর থাকে; অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র দেখার স্বপ্নে।’
গত কিছুদিনের বাংলাদেশের অধিকাংশ বড়বড় পত্রিকা, বিখ্যাত কিছু অনলাইন কিংবা হেভিওয়েট টিভি চ্যানেলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ওপর নিউজগুলোর কমেন্ট বাক্স লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে এই দেশের মানুষ কি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরা কোন না কোন ভাবে আমাদেরই আত্মীয়।
নির্বাক-নিপীড়িত মানুষদের জন্য কিছুই কি করার নেই?
কিছুই কি করার নেই আমাদের?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)