পশ্চিম লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বেঁচে ফেরা বাসিন্দা, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেই ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায়। ভবনের বেশ কয়েকটি ফ্লোর থেকে সন্তানকে বাঁচানোর আশায় জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেন বেশ কয়েকজন মা ও বাবা। এমনই একজন ২২ তলা থেকে তার সন্তানকে ছুড়ে মারেন এই আশায় যে নিচে থাকা কেউ হয়তো তাকে ধরবে, বা আহত হলেও সন্তানটি হয়তো বেঁচে যাবে। এসময় আর্তনাদ, চিৎকার আর বাঁচার আকুতিতে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
ডেইলি মেইল অনলাইনে এমন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা প্রকাশ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শী একজন শিশুকে জানালা দিয়ে বাইরে লাফ দিতে দেখেন, শিশুটির শরীরে তখন আগুন জ্বলছিলো। জানান, আগুন লাগার দেড়ঘণ্টা পরে দেখলাম ২২ তলায় একজন শিশু শরীরে আগুন লাগা অবস্থায় জানালার কাছে হেঁটে আসলো এবং লাফিয়ে পড়লো।
তিনি ধারণা করে বলেন, তিনতলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত। আগুনের খবরটি ফায়ার ব্রিগেডকে জানানোর পর তারা ২০ মিনিটের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হন বলেও তিনি জানান।
যুক্তরাজ্যের পশ্চিম লন্ডনের লাটিমার রোডে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন গ্রেনফেল টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনে এখন পর্যন্ত ৬ জন মারা গেছে বলে নিশ্চিত করেছে লন্ডন ফায়ার কমিশন, যা বাড়তে পারে। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান বলেছেন, এখনও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।
৭০ জনেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মেট্রোপলিটন পুলিশের কমান্ডার স্টুয়ার্ট কানডি উদ্ধার অভিযান চলছে জানিয়ে বলেন, তা অনেক জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ার।
২৪ তলা আবাসিক ভবনটিতে আগুন লাগার পর ১২ ঘণ্টার বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও সম্পূর্ণভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। ভবনটি ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
নারকীয় সেই বর্ণনায় শোনা যায়, চিৎকার, বাচ্চাদের আর্তনাদ, ‘আমার বাচ্চাকে বাঁচাও’, শিশু সন্তানকে বাঁচাতে জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার দৃশ্যসহ অবর্ণনীয় পরিস্থিতির। অনেকেই বলেন, এমন ভীতিকর দৃশ্য তারা কখনোই দেখেননি এবং সেই আর্তনাদ, বাঁচার আকুতি তারা জীবনেও ভুলবেন না।
সন্তানদের বাঁচাতে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দেওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা শোনা যায় প্রত্যক্ষদর্শী, বেঁচে ফেরাদের মুখে। এমন একজন শিশুকে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ধরে ফেলতেও সক্ষম হয় বলে জানান একজন। তবে বাকিদের কি অবস্থা তা জানা যায়নি ডেইলে মেইল অনলাইনের প্রতিবেদনটিতে।
এছাড়াও ভবনটি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম একজন বাসিন্দা জানান, তিনি ৬ জন শিশুসহ একজন নারীকে ২১ তলা থেকে নামার চেষ্টা করতে দেখেছেন। কিন্তু নিচে নেমে এসে নারীটি দেখেন দুইজন শিশু তার সাথে নেই।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা একজন বাসিন্দা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলেন, মানুষজন কিভাবে তাদের সন্তানদের বাইরে ছুড়ে দিচ্ছে আর বলছে, ‘আমার বাচ্চাকে বাঁচাও’। বেঁচে আসা অন্য একজন বলেন, তার মা ভবনটি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার সামনে একটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন।
শিশু সন্তানকে বাঁচাতে নিচে অপেক্ষমান মানুষদের উদ্দেশে ৯ বা ১০ তলা থেকে একজন নারী তার সন্তানকে ছুড়ে ফেলেন বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শী সামিরা লামরানি। নারীটি প্রথমে জানালার সামনে উপস্থিত হয়ে শিশুটিকে ছুঁড়ে ফেলবেন বলে ইশারা করেন এবং নিচে অপেক্ষমান কেউ যেনো তার শিশুকে ধরেন এমন ইঙ্গিত করেন। সেই শিশুটিকে নিচে থাকা একজন ধরতে সক্ষম হন বলেও তিনি জানান।
এছাড়াও ২৪ তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে অসংখ্য মানুষকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা শুধু চিৎকার করছে। একজনকে দেখা যায় বাসায় নির্মিত প্যারাসুট সদৃশ্য কিছু দিয়ে নেমে আসার চেষ্টারত। একজন প্রত্যক্ষদশী বলেন, “আমি যতই ফ্লোর থেকে ফ্লোরে তাকাই দেখি অসংখ্য মানুষ।”
স্থানীয়দের মতে চোখের পলকে আগুন ছড়িয়ে পরে। দ্বিতীয় তলা থেকে এর সূত্রপাত হয় এবং মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই তা উপর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।
বেঁচে আসা অনেকেই বলেন তাদের বেঁচে ফিরাটাই বিস্ময়কর। চারদিকে শুধুই ঘনকালো ধোঁয়া, অন্ধকার, শিশুদের চিৎকার, “এটা যেনো হলিউড মুভির কোন দৃশ্য।”
একজন বাবাকেও তার দুই সন্তানকে বাইরে ছুড়ে ফেলতে দেখেন একজন। একজন নারী চিৎকার করেন, “আমি বেরুতে চাই, আমি আমার বাচ্চাকে বাঁচাতে চাই।
এসময় নিচে অপেক্ষমান, প্রত্যক্ষদর্শী, বেঁচে ফেরা অনেকেই তাদের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের কিছুই করার ছিলো না।
মধ্যরাতে যখন ভবনটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তখন বাসিন্দাদের অধিকাংশই ঘুমিয়ে ছিলেন। ধোয়ার গন্ধে, আগুনের উত্তাপেই অনেকের ঘুম ভাঙ্গে বলে জানান। কোন সতর্কতা মূলক সংকেতও তারা শুনতে পারেননি বলে জানান।
ল্যানকাস্টার ওয়েস্ট এস্টেটের গ্রেনফেল টাওয়ার নামের ২৪ তলা আবাসিক টাওয়ার ব্লকটিতে ৬শ’র বেশি মানুষের বসবাস ছিল। অনেকেই এখনও সেখানে আটকে রয়েছেন।
১৯৭৪ সালে গ্রেনফেল টাওয়ার নির্মাণ করে কেনসিংটন অ্যান্ড চেলসি বরোহ্ কাউন্সিল। গত বছরই ভবনটির মেরামতের পেছনে ১ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড ব্যয় করা হয়। কাউন্সিলই ওই মেরামতের অর্থায়ন করেছিল।