সদরঘাটে লঞ্চে চাপলাম। এক কেবিনে আমি আর সবুজ ভাই। সবুজ ভাই চেনা মুখ। নাট্যজগতের প্রিয় মুখ। আমরা যাচ্ছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। সবুজ ভাই এক বিচিত্র সরল ও সৎ মানুষ। একদা পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। তার পৈতৃক বাড়ি বরিশাল। জন্ম বরিশাল শহরে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিয়মিত লঞ্চে চেপে বরিশাল আসা যাওয়া করতেন। অসম্ভব রোমান্টিক মনের মানুষ তিনি। তখন এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন। একবার এক ঈদ ছুটিতে দুজন একসাথে বরিশাল ফিরছিলেন। ডেকে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। হাওয়ায় তার চুল উড়ছিল। দৃশ্যটা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করলেন তিনি।
জীবন ও সাহিত্য নিয়ে নানা গল্প করতে করতে আমরা বরিশাল পৌঁছালাম। সবুজ ভাই তার গ্রামের বাড়িতে গেলেন। আমি সহসঙ্গী। রাতে যখন বরিশাল ফিরছিলাম তখন গ্রামের পথে জোনাক পোকার উড়াউড়ি। সবুজ ভাই উদাও কণ্ঠে গান ধরলেন। তিনি গায়ক হলেও বড় গায়ক হতেন। হেমন্ত মান্নার গান সবুজ ভাই হুবহু গেয়ে শোনান। কত চন্দ্রমূখ জ্যোৎস্নায় আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে সবুজ ভাইয়ের কণ্ঠে গান শুনেছি।
বরিশালে সবুজ ভাই তার স্মৃতি হাতড়ে বেড়ালেন দুই দিন। নাট্যকর্মীদের সাথে দেখা করলেন। গির্জায় গেলেন। তার স্কুলে গেলেন। সে এক আশ্চর্য ভ্রমণ। এক প্রেমিকের বাসায়ও গেলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আধা ঘণ্টা পর সবুজ ভাই ফিরে এলেন। তার চোখ ছলোছল। কিছুক্ষণ কথা নাই। চুপ। তারপর সবুজ ভাই বললেন, বুঝলিরে ছাত্র জীবনের প্রেম! ও ভালোই আছে। ওর সন্তানকে আমার কোলে দিতে চাইল।তখন কী করলেন সবুজ ভাই? সবুজ ভাই ম্লান হেসে বললেন, এই সন্তান আমারও হতে পারতো। কোলে নেইনি। ছুটে বেরিয়ে এসেছি।
এমনই রোমান্টিক মনের মানুষ আমাদের খায়রুল আলম সবুজ। বহুমাত্রিক চরিত্র তিনি। মূল পরিচয় অভিনেতা। মঞ্চ ও বিটিভির খ্যাতনামা শিল্পী। তিনি একজন দুর্দান্ত অনুবাদক। বিশেষ করে নাট্য সাহিত্য। হেনয়িক ইবসেন, জাঁ আনুই আন্তন চেখভরে এদের গুরুত্বপূর্ণ নাটক সবুজ ভাই অনুবাদ করে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। একটা তথ্য বলে রাখি খায়রুল আমল সবুজ অনুবাদ সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছেন।
সবুজ ভাই একজন নাট্যকার। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনেক জনপ্রিয় নাটকের তিনি নাট্যকার। সবুজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ টিভি নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে।
সবুজ ভাইয়ের একটা বড় গুণাবলী হচ্ছে তিনি নিপাট ভালো মানুষ। তার সঙ্গে কারও বিরোধ নাই। তিনি কাউকে কখনও ফুটবাক্যে কথা বলেননি। আর সবুজ ভাই হচ্ছেন চরম আড্ডাবান। আমাদের কালে সবুজ ভাইয়ের মত প্রাণখোলা আড্ডাবাজ দেখিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যান্টিন ও করিডোর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরানো ভবনের ছাদে, লাইব্রেরিতে, আমতলায় সবুজ ভাইয়ের বহুমাত্রিক আড্ডার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। সবুজ ভাইয়ের উত্তাল হাসি আর উদ্বেলিত গান আমাদের পুরো জীবনের সাক্ষাত।
বহু আগে একবার সবুজ ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতা ভ্রমণ। সবুজ ভাই গেছেন নিয়েটারের নাটক করতে। রবীন্দ্র সদনে। আমরা গিয়েছি ঘুরতে। মনে আছে গড়ের মাঠে আমি মাযহার আর সবুজ ভাইয়ের ঘরে বেড়ানো। কী যে হই চই। নিজেদের উজাড় করে ঘোরা। বিখ্যাত আমি নিয়ায় এক দুপুরে খেতে গেলাম। আমাদের সামনের টেবিলে অবিশ্বাস্য এক মোটা মানুষ বসে বসে খাচ্ছেন। তিনি দশ প্লেট বিরানী আর দশ প্লেট মাটন ঝোল টেবিলে সাজিয়ে বলেছেন। একাই খাবেন। সেই বিস্ময়কর খাদকের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। সবুজ ভাইয়ের চোখও কপালে উঠলো। আমরা দুষ্টুমি করতে পারি ভেবে বারবার বলতে লাগলেন, হারামজাদা সাবধান। কিছু শব্দ করবি না গলা টিপে ধরলে আর রেহাই নাই।
আমরাও চুপচাপ খেতে থাকলাম। আমিনিয়ার সেই প্রথম আমরা নৈশভোজ করলাম। পরে কত শত বার কলকাতা গিয়েছি। আমিনিয়ার একবেলা হলেও খেয়েছি। খাসির চাপ আর রুমালি রুটির কোন তুলনা হয় না। নিষ্পষ্ট্য আনন্দে সেবার কলকাতায় সবুজ ভাইয়ের সাথে ঘুরে বেড়ালাম। মনে আছে, গড়ের মাঠে একটা সাইনবোর্ড। হিন্দিতে লেখা আছে, ‘কুত্তা আনা মানা হ্যায়’। সেবার কলকাতা ভ্রমণে এই ডায়লগটা আমাদের কমন হয়ে গেল। আমরা সবসময় সেটা বলতাম। কুত্তা আনা মানা হ্যায়।
২.
খায়রুল আলম সবুজ নাট্যশিল্পী। আবেগ প্রবণ এক গায়ক। নাট্যকার। মঞ্চের অভিনেতা। লিবিয়ায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেছেন। পরে চাকরি ছেড়ে লিবিয়ায় চলে যান। এমন উদাহরণ আর নেই। তবে কয়েক বছর চাকরি করে চাকরি ছেড়েছেন এমন প্রযোজকদের মধ্যে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আল মনসুর, সালেক খানের কথা মনে পড়ে।
সবুজ ভাই খুবই অন্যরকম চরিত্র। বরিশালী আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা বাউল ভাব তার মধ্যে রয়েছে। তিনি জীবনানন্দ দাশের মত রহস্যময় পৃথিবীর অধিবাসী। তিনি রোমান্টিক মনের অধিকারী। প্রতীতী তার একমাত্র কন্যা। নির্ঝঞ্ঝাট সংসার জীবন। খুব শাদামাটা জীবন। সবুজ ভাই খুব হ্যান্ডসাম। গ্রীক বীরদের মত তার চেহারা। সবুজ ভাই এখনো অনবরত সিগারেট খান। চা পান করেন অনবরত। আড্ডায় বসলে পাগল বানিয়ে তোলেন। আমরা শ্রোতা। সবুজ ভাই গল্প কথক। গান-গল্পে তিনি মাতিয়ে তোলেন পরিবেশ। গান মনে রাখার ব্যাপারে অসম্ভব শ্রুতিধর তিনি। সলিল চৌধুরীর অধিকাংশ জনপ্রিয় গান তার মূখস্ত।
খায়রুল আমল সবুজ একজন শক্তিমান লিখক। তার জনপ্রিয় ধারার পরিচয়ের আড়ালে চাপা পড়ে যায় লেখক পরিচয়টা। সবুজ ভাইয়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ একটা ছোট গল্পের বই। একসময় তিনি সাহিত্যের পাতায় নিয়মিতভাবে ছোটগল্প লিখতেন। শুনে অবাক হবেন কেউ কেউ। সবুজ ভাই একজন কবি। চালচলনে বা স্বভাবে নয়। তিনি বহুদিন নিয়মিতভাবে কবিতা লিখেছেন।
টেলিভিশন নাটক অনেক লিখেছেন। তবে তার সাহিত্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য হচ্ছে নাটক অনুবাদ। অন্তিন চেখভ, হেনরিক ইবসেন এবং জাঁ আনুই এর আধুনিক নাটকগুলো তিনি গভীর প্রত্যয়ে অনুবাদ করেছেন। বিখ্যাত সম্পাদক ও লেখক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ তার কোন কোন অনুবাদ নাটক সম্পাদনা করেছেন। তার অধিকাংশ নাটক প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে। সবুজ ভাইয়ের দু’একটা নাটক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে সহায়ক পাঠ হিসাবে পাঠ্য।
সবুজ ভাই একজন সদা সৃজনশীল প্রতিভাবান ব্যক্তি। সারাক্ষণ সৃষ্টিশীলতায় বিভোর থাকেন। আমাদের যৌবনের হিরো তিনি। তার সঙ্গে কতো যে মুখকর আড্ডার স্মৃতি!
সবুজ ভাইয়ের বয়স হচ্ছে। মাথার চুল পড়ে গেছে। কিছু তার তারুণ্য অক্ষুন্ন আছে। সবাইকে সহজভাবে আপন করে নিতে পারেন। তার কণ্ঠে সবাইকে ‘তুই’ সম্বোধন অত্যন্ত মানিয়ে যায়। প্রাণের ভেতর থেকে তিনি আদর করে ডাক দেন।
কিছু একটা হতে হবে এই আপ্ত বাক্যে সবুজ ভাই বিশ্বাসী নন। তবু মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছু হতে চাননি সবুজ ভাই। তাই হয়তো তিনি অনেক কিছু হয়ে গেছেন।