আমাদের জীবনে আপদের কোনো শেষ নেই। নির্বাচন, নির্বাচন নিয়ে মারামারি, প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের খেয়োখেয়ি, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, যানজট, মশার বিষাক্ত কামড়, টকশোর বক্তাদের একঘেয়ে প্যাঁচাল, রাস্তায় ভিখিরির বিরক্তিকর ঘ্যান ঘ্যান, ঘরে বউ-বাচ্চার ক্যান ক্যান ইত্যাদি নানা সমস্যা ও সংকটে আমাদের জীবন অস্থির।
এর মধ্যে ইংরেজি নববর্ষ আমাদের জীবনে এক নতুন আপদের নাম। এখন ইংরেজি নববর্ষ মানেই সাজ সাজ রব। শহর-নগরের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মহা-উৎসবের সমারোহ। আলোর ফোয়ারা। রাতের ঘুম হারাম। একটু মদ পান করে বেহুদা উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা। বিভিন্ন স্যাটালাইট চ্যানেলে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকাদের নর্তন-কুদন। ‘বস্ত্রসংকট’ প্রদর্শনী।
নতুন বছরকে ঘিরে অকারণ উত্তেজনা এবং উন্মাদনার কোনোই মানে নেই। মহাকালের নিয়মেই নতুন বছর আসবে, পুরোনো বছর বিদায় নেবে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম কখনও কোথাও ঘটেনি, ঘটা সম্ভবও নয়। পৃথিবীর তাবত সুন্দরী যদি নিবিড় আলিঙ্গনে পুরোনো বছরকে ধরে রাখতে চায়, তবু তারা সফল হবে না। আবার পৃথিবীর সব মারণাস্ত্র তাক করলেও নতুন বছরের আগমন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। কালের নিয়মেই নতুন বছর আসে, পুরোনো বছর বিদায় নেয়।
তা ছাড়া পুরোনো বছর যেমন আমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়ে যায় না ; তেমনি নতুন বছরও আমাদের জন্য নিশ্চিত কোনো সৌভাগ্য চাবি হাতে করে আসে না। আমরা আমাদের কর্ম, প্রকৃতি ও নেতানেত্রীদের আচরণের ফল ভোগ করি। সেদিক থেকে বিচার করলে নতুন বছরের আগমন আর পুরোনো বছর চলে যাওয়ায় আমাদের কিছুই যায়-আসে না। পুরোনো বছরকে বিদায় জানানো আর নতুন বছরকে বরণ উভয়ই তাৎপর্যহীন।
তারপরও আমরা নতুন বছরে আন্দোলিত, উত্তেজিত হই। নতুন বছরকে বরণ করার জন্য হৈ হৈ কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলি। বিশেষ করে শহর-নগরে বসবাসরত নতুন প্রজন্ম। তাদের উদ্দাম-উচ্ছ্বাস-উদ্যোগ-আয়োজন আর উত্তেজনা দেখে মনে হয় যেন কিয়ামত সমাগত। যা কিছু করার, যা কিছু খাওয়ার এবং পান করার—তা ৩১ ডিসেম্বর রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে।
১ জানুয়ারি ঘটবে মহাপ্রলয়। এই মহাপ্রলয়ের আগে তারা বিভিন্ন বাসার ছাদে ছাদে সামিয়ানা টাঙিয়ে উচ্চস্বরে বিজাতীয় গান বাজিয়ে নেচে-গেয়ে-পান করে নরকগুলজারে মশগুল হয়ে পড়ে। আরেকদল নগরীর বিভিন্ন নামী-দামি হোটেলে-বারে আকণ্ঠ পান করে কলির দেবদাস হওয়ার সাধনায় মগ্ন হয়। আরেক দল (নব্য বড়লোকের অশিষ্ট বখে যাওয়া উঠতি যুব বাচ্চারা) নানাধরনের বিজাতীয় খাবার শক্ত-তরল মিলিয়ে গলা অবধি সেঁটিয়ে শরীরের উত্তাপ বশে রাখতে না পেরে গাড়ি করে সবান্ধবে বেপরোয়া উদ্দেশ্যহীন ছুটোছুটি করে। তাদের গাড়িতে বাজে উচ্চস্বরের মিউজিক। আরও একদল দেখা যায় যারা কোনো কিছু না খেয়ে না পেয়েও বেহুদা জনগণের মতো খামোখাই ছুটোছুটি করে। এই রাস্তা থেকে ওই রাস্তায় যায়।
এই নতুন প্রজন্ম ৩১ ডিসেম্বর রাতে পাগলা ষাঁড়ের মতো হয়ে যায়। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। তাদের কারণে পুরো ঢাকা শহরে একটা ‘কি যেন কী হয়, কি যেন কী হয়’ অবস্থা সৃষ্টি হয়। নতুন বছরকে বরণ করার নামে এ ক্ষ্যাপাটে উন্মাদনা ঠেকাতে সরকারকে চিন্তিত ও বিচলিত হতে হয়। বর্ষবরণের নামে যৌবনের বেপরোয়া উচ্ছ্বাস ঠেকাতে ‘রেড অ্যালার্ট’ ঘোষণা করতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনি নিউ ইয়ারের প্রবক্তাদের বশে রাখতে নানা ফন্দি ও পরিকল্পনা আঁটে। হাজার হাজার পুলিশ-র্যাব-গোয়েন্দা মোতায়েন করে। অস্ত্র উঁচিয়ে এসব বাহিনীকে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে তৎপর হতে হয়। যেনো যুদ্ধ পরিস্থিতি। যেকোনো মুহূর্তে হানাদার বাহিনী গর্জে উঠতে পারে। কাজেই সারাক্ষণ সর্তক প্রহরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বেচারারা শীতের রাতে না খেয়ে না ঘুমিয়ে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে নিউ ইয়ার-প্রেমী উন্মাদদের মুখের গন্ধ শুকেন। তাদের সামাল দিতে হিমশিম খান। ৩১ ডিসেম্বরের রাতটা নিয়ে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভীষণ টেনশনে থাকেন। এ রাতটা ভালোয় ভালোয় পার হয়ে গেলে সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন!
যেমন টেনশানে আছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান সন্ধ্যার পরে না করে দিনের বেলায় করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে তিনি ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের ওই দিন সবাইকে সচেতন থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আনন্দ করতে কোনো বাধা নেই। তবে তা রাতে না করাই ভাল। সব সময় একভাবে আনন্দ করতে হবে এমন নয়। দিনের বেলায়ও তো আনন্দ করা যায়।’
অথচ আমাদের সুখের ঘরে ইংরেজি নববর্ষ পালনের এই উটকো ঝামেলা বা হুজুগ কিন্তু আগে ছিলো না। ছোটকালে ক্যালেন্ডারের পাতায় ছাড়া ইংরেজি নববর্ষের কোনো অস্তিত্ব আমরা কোথাও দেখতাম না। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও ইংরেজি নববর্ষের কোনো প্রকোপ কোথাও ছিল না। তখন অবশ্য দেশে এত লোকও ছিল না। অল্প কিছু লোক চাকরি-বাকরি করতেন। তাদেরই ইংরেজি সন-তারিখের দরকার হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ইংরেজি তারিখ ব্যবহার হতো। তবে অনেক সনাতনপন্থী শিক্ষক বাংলা তারিখ ব্যবহার করেই কাজ চালিয়ে নিতেন।
কৃষিনির্ভর চাষা-ভুষাদের সমাজে ইংরেজি ভাষা, ইংরেজি মাস-বছর সবই ছিল বাহুল্য। এখন সময় পাল্টেছে। এখন ঘরে ঘরে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ! হালি হালি গণ্ডা গণ্ডা মানবসন্তান। কাউয়া (কাক) গুণে শেষ করা যায়, কিন্তু মানুষের বাচ্চা গুণে শেষ করা যায় না। কৃষিনির্ভর সমাজের পরিবর্তে এক বারোয়ারি পেশার সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সমাজে বাংলা সনের অবস্থা হয়েছে মায়ে-তাড়ানো বাপে-খেদানো ভবঘুরের মতো। ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা।
পাশ্চাত্য মডেলের পোশাক পরে, স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখে, দু-চারটা ইংরেজি গালি আর বুলি ঝেড়ে আমরা একেকজন বিরাট সাহেব বনে গেছি। এই সাহেব জমানার আমরা নাম দিয়েছি ‘আধুনিকতা।’ এসব নিয়ে কোনো কথা বললেই লেভেল সেঁটে দেওয়া হয়—আনস্মার্ট। আমরা রাজাকার হতেও রাজি আছি, কিন্তু কিছুতেই আনস্মার্ট হতে চাই না। তাতে আমাদের ইজ্জত যায়।
নতুন বছরের শুরুর প্রাক্কালে যুবসমাজের মধ্যে বেশ একটা খুশি খুশি ভাব লক্ষ করা যায়। যেন বিয়ের প্রহর আসছে, কিংবা দলবেঁধে সব ফুলশয্যায় চলেছে। রাস্তা-ঘাটে পরিচিত, আধাপরিচিতদের পেলেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতো হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যাদের চেহারা দেখলে রাগে শিরা টন টন করে, পিত্তি জ্বলে যায়, এমন কেউ যখন সামনে এসে দাঁত কেলিয়ে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে তখন ইচ্ছে করে খাড়া এক ঘুষিতে নাকের বদনা ধসিয়ে দিতে। কিন্তু জীবনের নির্মম পরিহাস, তখনও সংযমের চূড়ান্ত মর্মর মূর্তি হয়ে মৃদু হেসে বলতে হয়, হ্যাপি নিউ ইয়ার।
নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এমন প্রহসনের ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ আমাদের সংযম, ধৈর্য ও রক্তচাপের উপর যে প্রভাব ফেলে—তা সত্যিই আশ্চর্যের! শুধু কি তাই? অনেক নব্য আঁতেল আবার আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে, নতুন বছরের প্ল্যানটা কী? কী এক্সপেক্ট করছেন? এ সব কথা শুনতে শুনতে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে যায়। ইচ্ছে করে বাটার শক্ত জুতা দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে নিজের কপাল নিজেই ছেঁদা করি।
আরে নরাধম, নতুন বছরের আবার প্ল্যানটা কী? প্ল্যান কী আমাদের জাতীয় জীবনে আছে? কখন কী ঘটবে তা কী আগেভাগে কেউ বলতে পারবে? আমাদের দেশে কোনো কিছুই কী প্ল্যানমাফিক হয়? আমাদের জীবনে প্ল্যান হচ্ছে ঘোড়ার আন্ডা, যা কোনো ঘোড়া কোনো কালে পাড়েনি, কখনও পাড়বেও না। আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতায় অবহেলায় একটু একটু করে একটা নতুন ধরন, একটা নতুন আচরণ ও সংস্কৃতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আগামী দিনের কাণ্ডারি যারা, সেই তরুণ ও যুবসমাজ অন্যরকমভাবে সমাজে বড় হচ্ছে। একটা অলীক ফাঁপা অন্তঃসারশূন্য জগৎ তারা নির্মাণ করছে। এই প্রজন্মের অন্যতম সৃষ্টি ‘নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন’। এটা নিয়ে তারা বড় বেশি বাড়াবাড়ি করে, মাতামাতি করে। অথচ বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। বাধা দেবেই বা কে? তাদের কোনো কাজে বাঁধা দিলেই তারা বলবে—ব্যাকডেটেড, আনস্মার্ট। লেখাপড়া জানা অভিভাবকরা সব কিছু হতে প্রস্তুত আছেন, শুধু আনস্মার্ট ছাড়া!
এভাবে আমাদের সমাজে একটু একটু করে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের ক্রেজ জীবাণুর মতো বিস্তৃত হচ্ছে। একদল মানুষ নতুন বছরে উদ্দেশ্যহীন উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে। হঠাৎ বড়লোক হওয়া এই মানুষগুলো আকণ্ঠ মদ গিলে মাতামাতি-দাপাদাপি করে। চরম সংকট, অনিশ্চয়তা এবং পরম শীতের মধ্যেও ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। একালের যুবসমাজের চালচুলা না থাকলে হবে কি, ৩১ ডিসেম্বর রাতে ঠিকই পার্টিতে যোগ দিতে হয়। সেখানে উচ্চৈঃস্বরে গান বাজাতে হয়। এর সঙ্গে নাচতে হয়। গলা ভেজাতে হয়। হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে লাল-নীল আলোয় নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে হয়। এই তরুণ-যুবদের কে বোঝাবে যে, উন্মাদনা, পাগলামি, মাতলামি করাটা মোটেও নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন নয়।
নতুন বছরে আমরা কী পারব আমাদের স্বভাব-চরিত্র আচরণ বদলাতে? মানুষ হতে? মানবিক হতে? তা যদি না হয় তো কীসের হ্যাপি নিউ ইয়ার! কেবল অবক্ষয়ের নষ্ট স্রোতে গা ভাসিয়ে আকণ্ঠ মদ গিলে কার্ডে, ফোনে, ই- মেইলে, ফেসবুক-টুইটার-হোয়টসআপে, এসএমএসে এবং দেখা-সাক্ষাতে দাঁত কেলিয়ে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলার মধ্যেই নতুন বছরে আমাদের কর্তব্য শেষ করব?