এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর পক্ষ থেকে আমরা গিয়েছিলাম জামালপুর জেলার ইসলামপুরের চরবেষ্টিত বেলগাছা ইউনিয়নের চর মন্নিয়া ও চর বড়লে। আমাদের সহযাত্রী ছিলেন চ্যানেল আই-এর বিশেষ প্রতিনিধি পরাগ আজিম।
সাথে আরও ছিলেন সমকালের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন মিন্টু, মিঠুসহ অন্যান্যরা। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সরেজমিনে চর পরিদর্শন করে তাদের জীবনের সুখ দুঃখের কথাগুলো মিডিয়াতে তুলে ধরা। বেলগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক চরাঞ্চলে যাওয়ার জন্য আগেই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।
চর বড়ল, চর মন্নিয়া দ্বীপচর, একেবারে যমুনার মাঝখানে অবস্থিত। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে এসব চরে যেতে হয়। এর বাইরে আর কোনো পথে যাওয়ার উপায় নেই।
ইসলামপুর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম খালেদ মোশাররফের জন্মভূমি। জামালপুর সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা আর নৌপথে আরও ১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ইসলামপুরের বেলগাছা ইউনিয়নের দুর্গম চর মন্নিয়া, চর বড়লে পৌঁছাতে হয়।
প্রথমে যেতে হয় জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার ঘুটাইল বাজারে। বাজার সংলগ্ন ঘাট। ঐ ঘাট দিয়েই যেতে হয় চরাঞ্চলে। যমুনার পাড়েই ইসলামপুর পৌরসভা। এই উপজেলার মোট ইউনিয়নের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে চর অধ্যুষিত ইউনিয়ন হলো- কুলকান্দি, বেলগাছা, চিনাডুলি, সাপধরী, পাথর্শী, নোয়াপাড়া। এসব ইউনিয়নের অংশবিশেষ একেবারে যমুনা বক্ষে, মূলভূমি থেকে যা একেবারে বিচ্ছিন্ন।
আমরা যেদিন চরে যাই সেদিনই লক্ষ্য করি যমুনার পানি হু হু করে বাড়ছে। আসাম, রৌমারী হয়ে দূরন্ত গতিতে পানি বয়ে চলেছে। তখনও বন্যা শুরু হয়নি। তবে পানি বাড়ার কারণে অনবরত নদী ভেঙ্গে চলেছে। স্বচক্ষে দেখতে পাই ভাঙন এগিয়ে আসার কারণে অনেকেই নিজ বসতবাড়ি ভেঙে নিয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন। অনেকেই দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে এদিক ওদিকে নতুন ঠিকানা গড়ে তুলছে।
নদী ভাঙনের পূর্বাভাস পাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষের মুখেই দেখি বিষণ্ণ ও বেদনাহতের ছাপ। নদী ভাঙন শুরু হলে চরের মানুষের ভীষণ কষ্ট হয়। প্রচণ্ড রকম দুর্গতির সাথে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।সে সময় চরে যাদের সাথে দেখা হয় তাদের অনেকেই বলেন একেকজন গড়ে দশ থেকে পনেরো বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন।
কিন্তু তারপরেও জীবন আর জীবিকা আর বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চরকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। সেই কথাই বলছিলেন বৃদ্ধ হেলাল উদ্দিন। প্রায় সত্তর বছর বয়সের মানুষটির বসবাস চরাঞ্চলে। নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে আটবার।
আমরা ফিরে আসার পরপরই বন্যা শুরু হয়। বন্যায় জামালপুর জেলা বৃহৎ অংশই পানিতে ডুবে যায়।
ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ থেকে জেলার সদরের অনেক স্থান প্লাবিত হয়। তবে ইসলামপুর উপজেলার চরাঞ্চলগুলো খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসলামপুরের সংসদ সদস্য ফরিদুল হক খান দুলালের কাছ থেকে জানা গেছে, উপজেলার চর অধ্যূষিত কুলকান্দি, বেলগাছা, চিনাডুলি, সাপধবী, পাথর্শী প্রতিটি ইউনিয়নেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বন্যার কারণে চরের সমস্ত ফসল চলে যাচ্ছে পানির নিচে। বীজতলা নষ্ট হয়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেছে।গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই সংসদ সদস্য ফরিদুল হক খান দুলাল নিজ এলাকাতে রয়েছেন এবং বন্যার্তদের সর্বত্বক সাহায্য সহযোগিতা করছেন। ফরিদুল হক খান দুলাল জানান, এই মুহূর্তে চরবাসীর জন্য বেশি প্রয়োজন খাবার এবং একই সাথে সুপেয় পানির। বিশুদ্ধ পানির অভাব চারিদিকে। নলকূপগুলো পানির নিচে চলে যাওয়াতে বিশুদ্ধ পানির সংকটটা বেশি তৈরি হয়েছে। একইসাথে পানিবাহিত রোগের প্রকোপও শুরু হয়েছে।
ফরিদুল হক দুলালের মতে, বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই পানি কমছে। কিন্তু পানি নামার সাথে সাথে মানুষের মাঝে দুশ্চিন্তার ছাপ যেনো বাড়ছে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত: চরের মানুষের সাজানো সংসার তছনচ হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রতিটি বাড়িতে খাবার থেকে শুরু করে যে সঞ্চয় ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। বিপত্তিটা এখানেই। ফরিদুল হক খান দুলালের মতে, নদীভাঙ্গা ও বন্যার্ত মানুষের জীবনটা এরকমই।
প্রতিবারই নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই-সংগ্রাম শুরু করতে হয়। তবে চরের মানুষ সংগ্রামী ও সাহসী। একটু সহযোগিতা পেলে তারা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আর এ কারণেই সহযোগিতার হাতটা বাড়িয়ে দিলে আবার তারা স্বাভাবিক জীবনে চলে আসতে পারবে। চরের মানুষের জন্য এই মুহূর্তে কী বেশি প্রয়োজন?
আজ ফোনে এই প্রশ্নটি রেখেছিলাম বেলগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেকের কাছে। তিনি বলেন, চরের বেশিরভাগ মানুষের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এই মানুষের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে। এবারের বন্যায়ও নদী ভাঙনের করুণ শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এবারও নদী ভাঙনের শিকার মানুষেরা সেই আগের কথার প্রতিধ্বণিই করেছেন ‘আমরা ত্রাণ চাই না, আগে নদী ভাঙন ঠেকান’। আসলে নদী ভাঙন প্রতিরোধ এবং নদীভাঙা মানুষের পুনর্বাসন এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে সরকারেরও তেমন আলাদা বরাদ্দ নেই।
জেলা বা উপজেলাগুলোতে সরকারের যে ডিজাস্টার ফান্ড রয়েছে সেখান থেকে নামকাওয়াস্তে কিছু খয়রাতি সাহায্য সহযোগিতা করা হলেও ফান্ড অপ্রতুলতার কারণে সেটা খুব বেশি ফলদায়ক কিছু হয় না। নদীভাঙা মানুষের যে নিয়ত দুর্ভোগ তা থেকে তাদেরকে মুক্তি দিতে হলে সরকারের কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।
প্রথমত: নদী ভাঙা মানুষের পূনর্বাসনে জেলা-উপজেলাগুলো সরকারের সুনিদিষ্ট ফান্ড থাকা প্রয়োজন।যেখান থেকে ভাঙন কবলিত মানুষগুলোকে দ্রুত সাহায্য সহযোগিতা করার সুযোগ থাকবে। একইভাবে নদী ভাঙন এলাকাতে যে সব উন্নয়ন সংগঠন কাজ করে তাদের একটি সমন্বিত ফান্ডের ব্যবস্থা থাকবে যা থেকে তারা দ্রুততই দুর্যোগ এলাকাগুলোতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
ইসলামপুরের চর মন্নিয়া, চর বড়লে অনেকেই বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অনেকেরই এখন থাকার কোনো জায়গা নেই। শুধু ইসলামপুরের চর বলে নয় যমুনা, তিস্তা, ধরলার চরগুলোতে বসবাসরত অনেক চরবাসী এবারের বন্যা ও নদীভাঙ্গনে আবারও নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছেন। এতদিন কর্ম-পরিশ্রম করে তারা যা সঞ্চয় করেছিলেন তার সবই চলে গেছে।
বন্যা, নদী ভাঙন আমাদের নদী পরিবেষ্টিত এই দেশে মোটেও নতুন নয়। কিন্তু নদী ভাঙন রোধ, এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনও আমরা সেভাবে সক্ষমতা দেখাতে পারিনি। ফলে প্রতিবছরই আমাদের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
একইভাবে নদী ভাঙনের কারণে স্বল্প আয়ের চরবাসীকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে চরাঞ্চলে যে প্রায় ১ কোটি মানুষ বাস করে তারা আমাদের অন্যতম এক সম্পদ। এই ১ কোটি মানুষের রক্ষায় আমাদের সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)