বন্যা আর অনবরত নদী ভাঙ্গনের কারণে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের চরের মানুষগুলো এখন এক মহা-বিপদাপন্নতার মধ্যে পতিত। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর জেলার বেশিরভাগ চরাঞ্চলই এখন বন্যায় প্লাবিত। রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জের অনেক চরেও এখন অথৈ পানি। বন্যার পানির কারণে বসতির সাথে সাথে হাজার হাজার ফসলের ক্ষেত পানির নিচে চলে গেছে। অনেকের ঘরবাড়ি চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। করোনাকালে এই সীমাহীন দুর্ভোগ চরের মানুষের উপর যেন একেবারেই ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ।’
এমনিতে করোনার কারণে চরাঞ্চলে কর্মসংস্থান এবং আয়ের উৎস কমে আসায় প্রায় প্রতিটি পরিবারকেই এক নতুন বিপদের মুখে পড়তে হয়। এরপর আবার বন্যা। এ যেন নিয়তির এক নির্মম পরিহাস। করোনার কারণে চরে উৎপাদিত ফসল, সবজি, দুধের দাম পাচ্ছিল না চরবাসী। ফলে বিরাট এক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় তাদের। আবার যে সব শ্রমিকরা নগরকেন্দ্রীক কাজকর্মের সাথে যুক্ত ছিল তারাও করোনা শুরু হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে যাওয়ায় পরিবারে নতুন এক চাপ তৈরি হয়। এসব মানুষগুলো চরে ফেরার পর তাদের জন্য বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। ফলে কমবেশি সব পরিবারকেই খাদ্যসমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক পরিবারকেই তাই একবেলা বা দুবেলা খাওয়ার পথ বেছে নিতে হয়। কিন্তু বন্যা এসে চরের মানুষের জীবন আরও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। বন্যায় অচল হয়ে গেছে মানুষের জীবন ও জীবিকার সব পথ।
দেশের চরাঞ্চল মানেই দুঃখ বঞ্চনার এক করুণ উপখ্যান। জীবনের সমান যুদ্ধ যেখানে নিয়ত। এই যুদ্ধের যেনো শেষ নেই। শীত, গ্রীস্ম, বর্ষা সব কালেই এখানকার মানুষগুলোকে বিবিধ দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হয়। প্রায়শই প্রকৃতির কাছে হেরে যেতে হয় চরের মানুষকে। স্বভাবতই বেড়ে যায় মানুষ তথা চরবাসীর বিপদাপন্নতা, দুঃখ-কষ্ট এবং বেদনা। দূরবর্তী জায়গাতে অবস্থানের কারণে সেই বেদনার খবর অনেকেই জানতে পারেন না।
এবারের বন্যায়ও চরবাসীর কপাল পুড়েছে বললে ভুল হবে না। বন্যা তাদের সাজানো জীবনকে যেমন ছন্নছাড়া করে দিয়েছে তেমনি স্বপ্ন ভেঙেও চুরমার হয়েছে। বন্যায় যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে চরবাসীকে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। অন্ততপক্ষে পনেরোটির মতো জেলার চরাঞ্চলের মানুষ এবারের বন্যায়ও কম বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়েছে। বরাবরের মতো এবারও বিভিন্ন নদীতে বয়ে যাওয়া বন্যা চরবাসীর ঘরবাড়ি, সম্পদ গ্রাস করেছে। অনেকই তাই সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন। বাড়িঘর হারিয়ে অনেকে নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছেন। বন্যায় ভেসে গেছে সংসারম বাড়িঘর, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চরাঞ্চল। এর মধ্যে কোনো কোনো চর মূলভূমির সাথে সংযুক্ত। আবার অসংখ্য দুর্গম চর রয়েছে মূলভূমির সাথে যেগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল বরাবরই এক অভাবী জনপদ। বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি বলে জনশ্রুতি রয়েছে। দেশের প্রায় ৩২টি জেলার শতাধিক উপজেলার অংশবিশেষ চরাঞ্চল। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ মানুষ চরে জীবনব্যাপী বহুবিধ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। চরবাসীর জীবন মানেই অসংখ্য সমস্যায় নিমজ্জিত সংকটময় এক দূরুহ জীবন। চরাঞ্চল উচ্চমাত্রার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। চরে বসবাসরত মানুষগুলোর চরম খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস। তবে চরের মানুষের দরিদ্রতার বড় কারণই হলো- নদী ভাঙ্গন। প্রতিবছর গড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় বলে তথ্য আছে। সেই তুলনায় অনেক কম নতুন চর জেগে উঠে। আর জেগে উঠলেও সেসব চর চাষের যোগ্য হতেও অনেক সময় লাগে।
করোনা সংক্রমনের এই সময়ে এবারের বন্যায় বন্যাক্রান্তরা খুব একটা ভাল সহযোগিতা পায়নি। অনেক জায়গাতে সংসদ সদস্যরা সরাসরি উপস্থিত হয়ে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী এবারে বন্যায় সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ বা সহযোগিতা খুবই অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা প্রয়োজন কিন্তু বাস্তবে সেই চিত্র তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। গত ১৬ জুলাই ‘দেশের বন্যা পরিস্থিতি এবং করণীয়’ বিষয়ে ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সে (এনসিএ) যে ভার্চুয়াল সভার আয়োজন করেছিল। সেখানেও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের কেন্দ্র ও মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মাঝ থেকে এ ধরনের বক্তব্য উঠে আসে। সভায় ওয়াটার এইড বাংলাদেশ, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, সুইস কনট্যাক্ট, ফ্রেন্ডশীপ, ডেভেলপমেন্ট অরগাইনেজেশন অফ দা রুরাল পুওর-ডরপ, গণউন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে), বাংলাদেশ অরগাইনেজশন ফর সোশাল সার্ভিস-বস্, উন্নয়ন সংঘ, সিএসডিকে, পল্লীশ্রী, মানব মুক্তি সংস্থা-এমএমএস, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
সভায় অনেকেই বলেন, করোনার কারণে সরকারি কর্মকর্তারাও খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাতে যাচ্ছেন না। সবাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পর্যন্ত গিয়েই দায়-দায়িত্ব শেষ করছেন। কিন্তু যারা দুর্গম চরাঞ্চলে বসবাস করে তাদের খবর তেমন কেউ নিচ্ছেন না। এদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া নিয়েও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নানা বাধ্যবাধকতার অনেকে সেখানেও আশ্রয় নিতে পারছেন না দুর্ভোগে পরা চরের মানুষগুলো।
কোথাও কোথাও বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। আরও কিছুদিন পর বন্যার পানি কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর মাঝে যে ক্ষতি ও ক্ষত তৈরি হলো তা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে-এইপ প্রশ্ন এখন বড় আকারে দেখা দিয়েছে। কেননা হাজার হাজার চরবাসী নিজ বসতি এবং কষ্টের বাড়িঘর সব হারিয়ে ফেলেছেন। আয় উপার্জনের অন্যতম উৎস ফসলের মাঠ হারিয়েছেন। কষ্ট করে যে সম্পদ গড়ে তুলছিলেন সেটা হয় নষ্ট হয়ে গেছে, অথবা পানিতে ভেসে গেছে। পানি সরে যাবার পরপরই তাই চরের মানুষের জীবন ও জীবিকারক্ষায় যেবিষয়গুলো জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন সেগুলো হলো-
১. ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে চরের ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সঠিক তালিকা করে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা। চরে বীজ ও সারের সরবরাহ কম এ কারণে চরাঞ্চলে বীজ ও সারের সরবরাহ সুনিশ্চিত করা।
২. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ প্রতিটি পরিবারকে ক্যাশ ইনসেনটিভ প্রদান করা। যাতে এই দুরবস্থায় তারা ঘরবাড়ি পুননির্মাণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারে।
৩. চরের বাজার ব্যবস্থা সচল করা। দুগম চরে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের ফসল ও দুধ বর্তমানে বিক্রির জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪. বন্যার পরপরই চরে এই বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন শুরু করা। এটি করা হলে যারা শহরে কাজ করতে যেতে পারছে না, তারা কিছুটা হলেও কাজ করার সুযোগ পাবে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
৫. চরে উৎপাদিত ফসল-সবজি সেনাবাহিনী, পুলিশ, সরকারি হাসপাতাল, আনসারদের কিনতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগী হওয়া।
চরের জীবন ও জীবিকাকে চলমান রাখতে হলে মানুষকে শুধু সাহায্য নয়, তাদের কর্মের জায়গাটি অবশ্যই সচল রাখতে হবে। সেটা করতে না পারলে চরাঞ্চলে কেবলই হাহাকার বাড়বে। সবশেষে বলবো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন চরের মানুষের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের। কিন্ত আজ পর্যন্ত সেই তহবিল গঠন করা হয়নি। চরের মানুষের জীবন জীবিকার সুরক্ষায় সেই তহবিল গঠনও এখন জরুরি এজেন্ডা হওয়া উচিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)