ফেসবুক আরো কিছু দিন বন্ধ থাকবে। আজ ৮ ডিসেম্বর কয়েকটি দৈনিকের খবর। অথচ এই মাত্র দুই দিন আগেও সরকারের খুব কাছের নীতিনির্ধারকদের অনেকের কাছে শুনেছিলাম- “এই তো খুলে দিচ্ছি”। আজকের পত্রিকার খবর পড়ার পরে মনে হল- আমরা যখন ফেসবুকে প্রবেশ করি তখন আমাদের টাইমলাইনে যে ইংরেজি বাক্যটি দেখি সেটা পড়ে বুঝতে পারি আমাদের মনের কথা ওখানে লিখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু গত কিছুদিন ফেসবুক নিয়ে যা হচ্ছে- সরকার যা করছে, যা বলছে তাতে ফেসবুক নিয়ে সরকারের মনের আসল কথা বা ইচ্ছা কী সেটা ঠাউর করে উঠতে পারছি না।
কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের পর সব থেকে আলোচিত দুই মানবতাবিরোধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের আগে সবার মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করছিল, এর আগেও যাদের ফাঁসি কার্যকর বা ফাঁসির রায় হয়েছে তার পরে বা ৫ জানুযায়ীর নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ধরে যে পরিকল্পিত নাশকতা-অরাজকতা তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা সে ধরনের একটা আশঙ্কা ছিল।
সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে সরকার যখন ফেসবুকসহ আরও কয়েকটি যোগাযোগ মাধ্যম সাময়িকভাবে বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানায় তখন অনেক ফেসবুক ব্যাবহারকারীকে দেখেছি সরকারের সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানাতে ।
আমাদের অনেকের মনে থাকার কথা বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরেও একবার সাময়িক সময়ের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল, কিন্তু তখন এতো ব্যবহারকারী ছিল না। ফলে তখন ফেসবুক বন্ধের ইস্যুটা এতো ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়নি। আমরা জানি, সরকার দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য যে কোন পদক্ষেপ নিতে পারে, সেই পদক্ষেপ নেয়ার সময় ক্ষেত্র বিশেষে ক্ষুদ্রগোষ্ঠী স্বার্থের চেয়ে বড় জনগোষ্ঠীর স্বার্থ প্রাধান্য পাবে অথবা পায় এটা প্রচলিত রীতি। আবার সরকার যখন সে ধরনের পদক্ষেপ নেয় তখন তার নাগরিকদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম দিতে হয় যে, সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তটি বৃহৎ সংখ্যক মানুষের স্বার্থে নেয়া হয়েছে।
গত ১৮ নভেম্বরের সিদ্ধান্তটি দেশের জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে নেয়া হয়েছে এটা বিশ্বাস করে সরকারের সিদ্ধান্তটি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল। কিন্তু, যখন বন্ধ ফেসবুক খুলে না দিয়ে একদিকে অনেক সাধারণ ব্যবহারকারীর মতো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিকল্প উপায়ে সেটা ব্যবহার চালিয়ে যেতে থাকেন, সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী খোলা চিঠি লিখেন এবং ফেসবুক খুলে না দিয়ে অথবা কবে খুলে দেয়া হবে সেটা না জানিয়ে বরং ফেসবুক অথরিটিকে চিঠি দিয়ে-বৈঠক করে দেশের ভেতরে পর্যবেক্ষণ সার্ভার স্থাপনের অনুরোধ জানায়, তখন মানুষের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে সরকার ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে নাশকতার অজুহাত কাজে লাগিয়েছে।
দিন যতই যাচ্ছে ততই এই ধারণা মানুষের মনে ক্রমশ শক্ত ভিত্তি তৈরি করছে। ফেসবুক-ভাইবার ইস্যুতে এই জগাখিচুড়ি পাকিয়ে সরকার মানুষের মধ্যে যে ধারণা তৈরি করলো তাতে ভবিষ্যতে যদি সত্যিসত্যি জননিরাপত্তার স্বার্থে অন্য কোন পদক্ষেপ নেয় মানুষ সেটা সন্দেহের চোখে দেখবে। এই সন্দেহ সরকারই সৃষ্টি করলো।
এটা সবাই স্বীকার করবেন, কেউ যদি লাঠি হাতে আপনাকে আঘাত করতে আসে তার মোকাবেলা করতে হবে সেই ধরনের উপকরণ দিয়ে। যোগাযোগ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কেউ যদি নাশকতা চালাতে চেষ্টা করে আপনাকে সেটা মোকাবেলায় একই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। বলা হতে পারে- মোকাবেলার সেই ধরনের প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই। এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে কেন নেই? আমাদের সাংসদদের বা বড় বড় আমলাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে যদি বিদেশের সেতু দেখতে যাওয়ার অর্থের অভাব না হয়, খাল-নদী দেখতে যাওয়ার জন্য অর্থের অভাব না হয়; তাহলে আমাদের গোয়েন্দাদের কেন প্রযুক্তি দিয়ে নাশকতা মোকাবেলার কৌশল শিখাতে পারিনি বা তেমন প্রযুক্তি তাদের হাতে দেইনি ?
আবার ১৬ কোটি মানুষের দেশে সব মিলিয়ে কোটি খানেক মানুষ যে মাধ্যমটি ব্যবহার করছে, যাদের মধ্যে হাতে গোণা কিছু মানুষ মাধ্যমটির অপব্যবহার করে; তাদেরকে সরকার এতো ভয় পায় কেন? বলা হয়- এরা সরকারের বিরুদ্ধে অপ প্রচার করছে। আমরা জানি আজ যারা ক্ষমতায় আছেন ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতাসহ সব পেশায় যেমন তাদের সমর্থক আছে তেমনি তৃণমূলে তাদের বিরাট সমর্থক গোষ্ঠীও রয়েছে। সরকার যদি মনে করে এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে এই এই ক্ষেত্রে অপপ্রচার করা হচ্ছে তাহলে তারা তাদের কর্মী বাহিনী নিয়ে মানুষের কাছে আসল সত্যটা তুলে ধরতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হল- এই কাজ করার সময় তাদের নেই। সরকারী দলের উপর থেকে তৃণমূলের বিরাট সংখ্যক নেতা কর্মীর এই কাজের থেকে দলাদলি-থানার দালালি- দখল বাণিজ্য- টিআর কাবিখার গমের দিকে মনোযোগী বেশি। এদের সময় নেই তাদের দলীয় সরকারের ভালো কাজ মানুষের কাছে তুলে ধরতে তাদের কাছে যাওয়ার। আর নেতারা যতটা বিদেশ ভ্রমণে আগ্রহী ততটা গ্রামে গিয়ে নিজেদের কথা বলা ও মানুষের কথা শোনার আগ্রহ নেই।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে সরকার গঠন করার সুযোগ পায় তার একটা কারণ আগের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি-দুঃশাসন; অন্যদিকে একটা আধুনিক-প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রুতি। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই দুটো বিষয়কে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ বিজয়ী করে।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল, আজ বলতে দ্বিধা নেই সেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় তার ত্রুটি-ব্যর্থতা খুঁজে তা দূর করার পথে না হেঁটে বিএনপির দেখানো পথে হাঁটছে। ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি যেমনি করে বিনা পয়সায় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়ার সুযোগ সিদ্ধান্ত নিয়ে হাত ছাড়া করে বাংলাদেশকে বিশ্বের তথ্য যোগাযোগের মহাসড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, সেই ঠিক সেই কাজটি এই সরকার ঠিক একইভাবে না করলেও ভিন্ন ভাবে যা করছে সেটার ফলাফল আসলে একই দাঁড়ায়।
আজ ফেসবুক বন্ধের কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারে ও মানুষ নানা সমস্যার মুখে পড়েছে। স্বীকার করি সবাই নয়, এই মাধ্যমটি কেউ কেউ সমাজের জন্য ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যে কাজটি নাশকতার অজুহাতে করা হল আমাদের সংবিধান কি সেটা সমর্থন করে? সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃতি দিয়েছে। সেখানে কী কী করা যাবে কী কী করা যাবে না সেটাও বলা হয়েছে। কারো কথা-বক্তব্য আমার পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু তার সমাধান তার মুখ চেপে ধরা নয়- তার বক্তব্যের বিপরীতে যুক্তি নির্ভর বক্তব্য হাজির করা। কেউ যদি এই প্রযুক্তিটিকে ব্যবহার করে সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করে তার জন্য আইন আছে, বিচারের ব্যবস্থা আছে। সমালোচনা বা চিন্তার বিপরীতে চাপাতি যেমন সভ্য সমাজ গ্রহণ করে না একই ভাবে কাউকে অপ্রিয় কথা বলার জন্য তার মুখ বন্ধ করাটাও গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়।
তথ্য প্রযুক্তিতে দেশ যতটুকু এগিয়েছে সেটা আওয়ামী লীগের সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে- এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য হল- সেই আওয়ামী লীগ সরকারই আবার মানুষকে ঘরে আটকে রাখার নানা ছল বের করছে। আজ দেখা যাচ্ছে- সরকার তার ব্যর্থতা খুঁজে তা সংশোধনের উদ্যোগ না নিয়ে সেটা লুকাতে চায়।
বন্ধের সংস্কৃতি নয়- চেপে ধরার সংস্কৃতি নয় – চেপে রাখার সংস্কৃতি নয়, চাই খোলা জানালা। আলো আসুক- আলো আসতে দিন। আলো আসবেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত
মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির
সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)