বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগে সব আসামি গ্রেফতারের পর ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে সবাইকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। রিমান্ডে তারা ধর্ষণের এই ঘটনার কথা স্বীকার করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এছাড়া এই ঘটনার পরে আপন জুয়েলার্স ও রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষকেও ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। হোটেল থেকে বিদেশি মদ উদ্ধারের ঘটনার পরে বিষয়টিকে রেইনট্রি কর্তৃপক্ষ ষড়যন্ত্র বললেও হোটেলটির বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে তিনটি মামলা। আপন জুয়েলার্সেও শুল্ক গোয়েন্দারা উদ্ধার করেছে অবৈধ স্বর্ণ ও হীরা। তারা সময় চেয়েছে বিষয়টি ব্যাখার জন্য।
দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা এ ধর্ষণ মামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হলো-
রিমান্ডে সব আসামি
এ মামলায় সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া আসামি এইচ এম হালিম ওরফে নাঈম আশরাফকে সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালতের কাছে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে গত ১১ মে সাফাত ও তার বন্ধু সাদমান সাকিফকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর দিন আদালতে তোলা হলে আদালত সাফাতকে ৬ দিন এবং সাদমান সাকিফকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এছাড়া গত ১৫ মে সাফাতের দেহরক্ষী রহমতকে গুলশান থেকে এবং ড্রাইভার বিল্লালকে নবাবপুর থেকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে রহমতকে ৩ দিন এবং বিল্লালকে ৪ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
ধর্ষণ বিষয়ে আসামিদের স্বীকারোক্তি
জোরপূর্বক মদ পান করিয়ে দুই তরুণীকে ওই হোটেলে তারা ধর্ষণ করে বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে এ ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু সাদমান সাকিফ।
১৪ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে সাফাত জানায়, ঘটনার রাতে হোটেলে মদের আসরের মূল আয়োজক ছিল নাঈম আশরাফ। হোটেলে তারা একসঙ্গে পাঁচজন (দুই তরুণী, সাফাত, নাঈম ও সাদমান) মদ পান করেন। তরুণীদের জোর করে মদ খাওয়ানো হয়। এতে তরুণীরা বেসামাল হয়ে পড়লে তাদের একজনকে বেডরুমে ও অপরজনকে ড্রয়িংরুমে ধর্ষণ করেন তিনি (সাফাত) ও নাঈম। সেখানে উপস্থিত ধর্ষণ মামলার অপর আসামি সাদমান তা উপভোগ করেন। ওই রাতে আরেক তরুণীর সঙ্গে নাঈম জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করেছিল বলেও সে জানিয়েছে।
এছাড়া এইচ এম হালিম ওরফে নাঈম আশরাফের সহযোগিতায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। অন্যদিকে ডিবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপরাধ বিভাগ) কৃষ্ণ পদ রায় জানিয়েছেন, ধর্ষণের দায়ে গ্রেফতারকৃত সবশেষ আসামি নাঈম আশরাফকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে।
নাঈম আশরাফের সেলফিতে বিব্রত অনেকে
আসামি নাঈম রিমান্ডে থাকলেও তার অতীতের অনেক ছবি ও সেলফি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে নাঈমের শো-বিজ ও মিডিয়ার অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মিডিয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে মিডিয়া সেলিব্রেটির সঙ্গে সেলফি তুলেছে। সেইসব ছবি ও সেলফি এখন তারকা-সেলিব্রেটিদের জন্য সর্বনাশের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
বনানীর ধর্ষণকাণ্ডের পর নাঈম আশরাফের সঙ্গে কয়েকজন সেলিব্রেটির সেলফি দেখে ওইসব তারকা-সেলিব্রেটিদের নানাভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। অভিযুক্ত করা হচ্ছে নানা অমূলক ও অপব্যাখায়। এছাড়া সম্প্রতি একটি অনলাইন পোর্টালে আসামি নাঈমের ‘বেপরোয়া জীবন’ নিয়ে একটি নিউজ করেছে, সেখানে ছবি হিসেবে কয়েকজন সেলিব্রেটির সঙ্গে নাঈমের তোলা বিভিন্ন ছবি দেয়া হয়েছে।
তবে এসব তারকা-সেলিব্রেটিরা বলছেন, যারা মিডিয়াতে কাজ করেন তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয় এবং সেসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পরিচিত ও অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হয় এবং অনুরোধে ছবিও তুলতে হয়। কিন্তু এমন নিউজের পর মানুষ তো এখন ধারণা করে নিচ্ছে যে নিউজে যাদের ছবি আছে, তাদের সবার সঙ্গে নাঈমের সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি দু:খজনক। যারা এই নিউজটি করেছে তারা এই সোর্স কোথায় পেয়েছে? কিসের ভিত্তিতে এমন নোংরা নিউজে আমার ছবি জুড়ে দিলো?
এ কারণে সামাজিকভাবে তাদেররকে চরমভাবে মানিহানির শিকার হতে হচ্ছে বলেও জানান তারা।
বনানী থানায় মামলা গ্রহণে গড়িমসি
ধর্ষণের শিকার দুই শিক্ষার্থী প্রাণনাশসহ বিভিন্ন হুমকি উপেক্ষা করে ঘটনার একমাসের বেশি দিন পর ৪ মে তারা বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ মামলা না নিয়ে তাদেরকে হয়রানী করে বলেও তারা অভিযোগ করেছে। তবে এমন অভিযোগের ৪৮ ঘণ্টা পর ৬ মে ওই অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে। কিন্তু বনানী থানার ওসি সহ পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এমন একটি ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করতে হলে প্রাথমিক তদন্ত করতে হয়। মূলত: এই কারণেই মামলা নিতে কিছুটা সময় লেগেছে।
রেইনট্রি হোটেলের দায় এড়ানোর চেষ্টা
এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ দেশজুড়ে যখন আলোড়ন চলছে তখন রাজধানীর বনানীতে ওই রাতে আপত্তিকর কোনো কিছু ঘটেনি বলে দাবি করেছিলেন দ্যা রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষ।
গত শনিবার হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার ও ইন্টার্নাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ ফারজান আরা রিমি এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার রাতে হোটেলের স্ক্যানার মেশিন অকার্যকর থাকায় কোনও ব্যক্তি মদ নিয়ে হোটেলে ঢুকেছিলো কি না তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ২৮ মার্চ অস্ত্র ফ্রন্ট ডেস্কে জমা দিয়ে সাফাত, সাদমান ও নাঈমরা হোটেলে প্রবেশ করেছিল বলেও জানান তিনি। ফলে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী অস্ত্রের মুখে ধর্ষণের যে অভিযোগ করেছেন, তা মিথ্যা বলে দাবি করেন রিমি।
রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের এমন দাবির পর সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুকে তাদের ব্যবসা বন্ধ করা সহ সেই রাতের ঘটনায় হোটেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজস রয়েছে কি না তা তদন্ত করে দেখার দাবি জোরালো হয়। এই দাবির প্রেক্ষিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পরবর্তীতে শুল্ক গোয়েন্দারা হোটেলটিতে অভিযান চালিয়ে ১০ বোতল অবৈধ বিদেশি মদ উদ্ধার করে তাদেরকে তলব করে।
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হোটেল হওয়ায় টেকজায়ান্ট গুগলে নেগেটিভ রিভিউ দিতে থাকে সাধারণ মানুষ। নেগেটিভ রিভিউ, বিভিন্ন সংস্থার অভিযান, তিনটি মামলা দায়ের এবং তা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারের কারণে তাদের ব্যবসায় একপ্রকার ধস নেমে আসে। এরপর সংবাদ সম্মেলনে রেইনট্রি কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের আগামী দুই সপ্তাহের সকল বুকিং বাতিল হয়েছে। এমনকি যারা হোটেলে অবস্থান করছেন তারাও দ্রুত ত্যাগ করছেন। এভাবে চলতে থাকলে আমরা কর্মচারীদের নিয়ে পথে বসে যাবেন বলেও জানান তারা। অবশ্য পরবর্তীতে তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে ওই ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন তারা।
আলোচনায় অবৈধ স্বর্ণ মজুদ ও ধর্মঘট
আলোচিত এই ঘটনার পর গত রোববার শুল্ক গোয়েন্দার দল আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শাখায় অভিযান চালিয়ে ২৮৬ কেজি স্বর্ণ ও ৬১ গ্রাম ডায়মন্ড ব্যাখ্যাহীনভাবে মজুদ রাখার দায়ে সাময়িক আটক করে। এগুলো আইন অনুসারে সিলগালা করে তাদের হেফাজতে নেয়া হয়। এছাড়া গুলশানের সুবাস্তু টাওয়ার শাখা ও মৌচাক শাখা সবার উপস্থিতিতে সিলগালা করে পরবর্তীতে তাদেরকে তলব সাময়িকভাবে আটক এই মূল্যবান সামগ্রী সরবরাহের বৈধতা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
কিন্তু ওই জিজ্ঞাসাবাদে আপন জুয়েলার্সের দিলদার আহমেদ সহ অন্যান্য মালিকরা হাজির হলেও পাঁচটি শো রুম থেকে উদ্ধার করা প্রায় ২৫০ শত কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের বৈধ কাগজ তারা দেখাতে পারেননি। এরপর থেকে স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আপন জুয়েলার্স ছাড়াও আরো কয়েকটি জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে একই ধরণের অভিয়োগ রয়েছে বলে জানান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত বিভাগের মহাপরিচালক মইনুল ইসলাম খান। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালকের এমন বক্তব্যের পর দেশজুড়ে প্রতিটি জুয়েলারি শোরুম বা দোকানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।অবশ্য বৈধভাবে ব্যবসা করা স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কোন ধরণের হয়রানি করা হবে না বলে আশ্বাস দেয়ার পর শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরে বাজুস নেতৃবৃন্দের সাথে সফল আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রাতে তাদের ঘোষিত ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছে।