ধরুন আপনি রাজধানী থেকে কোনো বই কিনবেন; তাহলে আপনার কল্পনার চোখে প্রথমে কোন এলাকার চিত্র ভেসে উঠবে? নিশ্চয়ই নীলক্ষেতের সেই সারি সারি বইয়ের দোকানের চিত্র। ঘুপচি মতো জায়গা। কোথাও কিছুটা অন্ধকার, কোথাও আবার হঠাৎ ভিড়। যেন হাঁটারও জো নেই। দাঁড়িয়ে ভালোমতো বই পরখ করে কিনবেন; অনেক সময় সেই সুযোগও পাওয়া যায় না। কেননা পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন আরো সবক্রেতা। তাদেরকেও তো সুযোগ দিতে হবে!
কিন্তু সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষের রুচিবোধও। একই সঙ্গে ‘ইউজারফ্রেন্ডলি’ শব্দটা পাল্টে দিচ্ছে ব্যবসার ধরণও। আর তাতেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে রাজধানীর বইয়ের দোকান বা লাইব্রেরিগুলোতেও। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত অনেক বুকশপ চালু হচ্ছে। ক্রেতা আর পাঠক টানতে তাদের জন্য ‘কমফোর্টকে’ দেয়া হচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব।
এসব আয়োজনের মধ্যে এখন বইয়ের জগতে অন্তত একবেলা সময় কাটাতে পারছেন অনেক পাঠক। পাশাপাশি বইকেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠান, প্রকাশনা উৎসব, পাঠচক্র, সাহিত্য আড্ডা দিতে পারছেন কাঁটাবনের দীপনপুর, শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কিংবা ধানমণ্ডির বেঙ্গল বইঘরে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে নতুন শাখা খুলছে চট্টগ্রামের নাম করা বইয়ের দোকান ‘বাতিঘর’। পাঠক বৃদ্ধিতে এসব বুকশপ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজধানীর এমনই একটি বুকশপ দীপনপুর। দীপনপুরের পরিচালক নীপা লায়লা জানালেন, জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখতে তারা বুকশপটি দিয়েছেন। দীপন বই ভালোবাসতেন। বুকশপটিকে তারা দীপন স্মৃতিঘর হিসেবে দেখছেন। এখানে নতুন পুরনো সব ধরণের বই আছে। নতুন বই কেনার সুযোগ আছে। পুরনো বই বসে পড়ার সুযোগও আছে। ফলে দীপনপুর ঘিরে পাঠকদের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন।
তিনি বলেন, ‘দীপনপুরে দীপান্তর নামে শিশুদের জন্য বিশেষ জায়গা আছে। এখানে বাচ্চারা ছবি আঁকতে পারে। খেলাধুলা করতে পারে। বইও পড়তে পারে। দীপনতলা নামে একটা স্টেজ আছে। এখানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, সাহিত্য আড্ডা, পাঠচক্রসহ সাহিত্যধর্মী যে কোনো অনুষ্ঠান করা যায়। দীপাঞ্জলী নামে একটি ক্যাফেটেরিয়া আছে। খুবই কম মূল্যে বাসায় তৈরি খাবার পাওয়া যায়। পাঠক পড়তে পড়তে ইচ্ছে করল চা, কফি বা স্ন্যাকস্ খাবে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার হাতের কাছে পাচ্ছে। নামাজঘর আছে। বসে বই পড়ার ব্যবস্থা আছে। কেউ ইচ্ছে করলে সারাদিন বসে বই নোটও করতে পারবে।’
কোন ধরণের ক্রেতারা আসেন- জানতে চাইলে নীপা লায়লা বলেন, ‘চিত্রজগতের তারকারা যেমন নাতি-নাতনী নিয়ে আসেন। তেমনি আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা কনজারভেটিভ পরিবারের মেয়েরাও আসেন। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছাত্ররাও আসেন। পেশাজীবী মানুষজন আসেন। এছাড়াও বসে বসে লেখা-পড়ার সুযোগ থাকায় গবেষণা করছেন এমন গবেষকরাও আসেন। তারা নানা বই ঘেঁটে নোট তৈরি করেন। প্রয়োজন মনে করলে বই কেনেন। না হলে বসে বসে পড়েন।’
দীপনপুরের এক কোনায় বসে বই পড়ছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ খাতায় নোট করছিলেন ডাঃ মাহমুদুল হাসান। চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমি পেশায় ডাক্তার হলেও নেশায় পাঠক। সময় পেলেই দীপনপুরে চলে আসি। প্রায় প্রতিদিনই আসা হয়। ভালো কিছু সময় কাটে এখানে। বই পড়তে পারি। নোট করতে পারি। কিনতে পারি। আবার ক্লান্ত বা ক্ষুধা লাগলে কফি, স্ন্যাকস্ খেতে পারি। সব মিলিয়ে দারুণ এক পরিবেশ।’
শাহবাগের পাঠক সমাবেশে দেখা যায় দীপান্ত সরকার নামে এক পাঠক নিবিষ্টমনে বই পড়ছেন। চলচ্চিত্র পরিচালক দীপান্ত সরকার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘পাঠক সমাবেশে প্রচুর বই আছে। পছন্দসই বই খুঁজতে প্রায়ই আসা হয়। বইয়ের বিশেষ অংশ দরকার হলে ফটোকপি করে নেওয়া যায়। কেনার সুযোগ তো রয়েছেই।’
ধানমণ্ডির ২৭ নম্বরে আছে ‘বেঙ্গল বই’। বেঙ্গল বই নিয়ে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রফিকুজ্জমান রুমান জানান, এখানে বই কেনা যায়, না-কিনে বসে বসে সারাদিন পড়াও যায়। বাচ্চাদের জন্য শুয়ে থেকে পড়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। আমার ছেলে পড়ছে!’