বদলে যাচ্ছে গ্রাম। গ্রামের মানুষ ও তাদের জীবনধারা। প্রাত্যহিক জীবনের প্রায় প্রতিটি স্তরেই পরিবর্তনের ছোঁয়া এখন স্পষ্ট। গ্রামের মানুষের স্বপ্ন যেমন একটু একটু করে বড় হচ্ছে তেমনি সেই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে।
দুই দশক আগেও গ্রামের যে চিত্র চোখে ভাসত তা এখন কেবলই মলিন ইতিহাস। বলাবাহুল্য, আজকের এ পরিবর্তন যেমন হঠাৎ আসমান থেকে নেমে আসেনি তেমনি হঠাৎ আবির্ভূত কোনো দেশনেতা কিংবা দেশনেত্রীর হাতের অলৌকিক ইশারায়ও হয়ে যায়নি।
পরিবর্তনের এ ক্রমধারা দুই দশক ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে হয়ে আসছে। তার পিছনে রয়েছে নব্বইউত্তর প্রতিটি সরকারের কম-বেশি অবদান। তাদের কর্ম পরিকল্পনা। সর্বোপরি গ্রামের বৃহত্তর মানুষের নিরন্তর চেষ্টা। তাদের বদলে যাওয়ার প্রচেষ্টা।
একটা সময় ছিল যখন গ্রামের মানুষদের অধিকাংশকে নানামুখি অভাব অনটনে দিন কাটাতে হতো। সংসারের ঘানি টানতে গৃহকর্তারা প্রায়ই দিশেহারা হতেন।
দেখা গেছে সংসারের অভাব ঘোচাতে হয়তো হালের গরু বিক্রি কিংবা একমাত্র ধানি জমিটির অর্ধেক অংশ বন্ধক দিয়েছেন। গ্রামীণ অর্থনীতি একেবারে লেজে গোবরে অবস্থায় ছিল।
মানুষের আয় রোজগারের একমাত্র উৎস ছিলো জমির ধান-পাট। সংসারে বাড়তি আয়ের দ্বিতীয় কেউ থাকতনা। বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মানুষের সার্বিক অবস্থার বদল ঘটেছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এখন আর কোনো অভাব নেই।
আশ্বিন কার্তিকের যে তীব্র অভাব বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হতো সেই অভাব এখন টেলিস্কোপেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে গ্রাম নিয়ে এতো কথা বলা হয় সেই গ্রামের পথে পা বাড়ালে দেখা যাবে ষাটের দশকের ছোট্ট শহরগুলো যেমন ছিল গ্রামের চিত্র প্রায় সেই রকম।
পাকা সড়ক। বিদ্যুতায়িত ঘরবাড়ি। মধ্যম কৃষকের বাড়িতে কেবল সংযোগসহ রঙ্গিন টেলিভিশন, ফ্রিজ। গৃহস্থঘরের ছেলেমেয়েদের কারও হাতে ল্যাপটপ, কারও হাতে ডেস্কটপ। মোবাইল ফোন তো প্রত্যেকের কাছে, স্মার্টফোন তরুণ-তরুণীদের হাতে।
গ্রামের এ পরিবর্তন এমনি এমনিই আসেনি। গ্রামের মানুষ এখন পড়ালেখা করে শিক্ষিত হচ্ছে। দেশের বড় বড় কলেজ ইউনিভার্সিটি পাস করে উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে। কৃষকের ছেলেমেয়েরা যেমন মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে আবার কেউ অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। শহুরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত কোনো অধ্যাপক কিংবা প্রতিথযশা কোনো সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারাও সেই গ্রাম থেকেই আসা।
যারা যারা পড়ালেখায় সুবিধা করতে পারেনি, তাদের বিরাট অংশ পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। যারা তাও পারেনি, তারাও বসে থাকেনি। হয়তো দেশীয় কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি কিংবা অন্য কোনো জায়গায় যুক্ত হয়ে সংসারের আয় বাড়াচ্ছে। আবার কেউ কেউ স্থানীয় বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য করে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেওয়ায় ভুমিকা রাখছে। কৃষকরাও বসে থাকেনি। কৃষিকে সেবা বিবেচনা করে এর দিকে নজর বাড়িয়েছে আমাদের কৃষকেরা।
এখন শুধু আর ধান-পাট চাষ করেন না। মধ্যবর্তী সময়ে নানান জাতের সবজি উৎপাদন করছে। বাড়ির পাশের পচা পুকুরটি এখন রূপালী মাছের চারণভূমি। বাড়ির আঙ্গিনায় গরুর গোয়ালটি আর দেখা না গেলেও অদূরে দু-একটি মুরগীর ফার্ম দেখতে পাওয়া যায় সহজেই। সাথে মৌসুমী ফল-বাগানতো আছেই।
বিভিন্ন উৎসব যেমন পহেলা বৈশাখ, ঈদ ও পূজায় গ্রামেও বর্ণিল আয়োজনে চলে উৎসব সমাহার। একটা সময় ছিল, যখন পহেলা বৈশাখ শুধুমাত্র শহুরে উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হতো। গ্রামের মানুষের এ সংক্রান্ত কোনো আবেগ-আগ্রহ দেখা যায়নি। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
গ্রামেও এখন বৈশাখী মেলা হয়, বর্ষবরণ র্যালীতে অংশ নেয় গ্রামের শিক্ষিত-অশিক্ষিত বিভিন্ন বয়সী লোকজন। শুধু বাউল গান নয়, শহর থেকে নিয়ে আসা হাল-ফ্যাশনের কোনো ব্যান্ড পার্টিও চলে আসছে গ্রামের বৈশাখী মেলায়। ঈদ ও পুজোয় যেমন ধুমসে কেনাকাটা হয়, পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে গ্রামের শিক্ষিত প্রজন্মও অংশ নেয় এসব কেনাকাটায়।
দুই দশক আগের ঈদ আয়োজনের সাথে এখনকার ঈদের বিস্তর ফারাক খুব সহজেই চোখে পড়বে। তখন ঈদকে শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ বিবেচনা করেই পালন করা হতো। এতে উৎসবের আমেজ খুব একটা পাওয়া যেতো না। বদলে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতির তোড়ে ঈদ উৎসবের চেহারাও বদলে গেছে অনেক।
যারা শহরে থেকে বিভিন্ন চাকরি-পেশায় নিয়োজিত, ঈদকে সামনে রেখে সবাই দলবেঁধে ছুটে আসেন গ্রামের সবুজ ঠিকানায়। উঠতি তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা কেবল তাদের পোশাকে-আশাকে নয় তার ছোঁয়া পড়ে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহ মাঠেও। জৌলুসহীন সাদামাটা মাঠের পরিবর্তে বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা হয় ঈদগাহ মাঠ।
ঈদের নামাজ শেষে বিকেল বেলায় চলে পাড়া-প্রতিবেশির বাড়িতে দলবেঁধে বেড়ানোর ছলে একে অপরের খোঁজ-খবর নেওয়া। সন্ধ্যাবেলায় স্থানীয় বাজারগুলো লোকসমাগমে অন্যরকম মিলন মেলায় পরিণত হয়। তাদের কথা বার্তায় ভেসে আসে বদলে যাওয়ার গল্প-কথা। তাদের স্বপ্নে ফুটে উঠে এই গ্রামকে আরো চমকে দেওয়ার ইতিকথা।
এখন এই হচ্ছে গ্রাম। তার নতুন ইতিহাস। তবে ইতিহাস যতোই পরিবর্তনের ধারায় সমৃদ্ধ হোক, ইতিহাসের পরতে পরতে কিছু নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে মুছে দেওয়া যাবে না। কালের বিবর্তনে গ্রামের মানুষের জীবনধারা বদলে গেলেও তাদের কষ্টগাথা সম্পূর্ণ উবে গেছে ভাবলে ভুল হবে।
এখনো গ্রামের কৃষকদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের অস্তিত্বের সাথে। কৃষকের প্রাণ কৃষি। সেই কৃষিকাজ নির্বিঘ্নে করার বাধা আছে পদে পদে। সরকার কৃষিকাজে গুরুত্বের কথা বলে। নানান ভর্তুকীর কথা বলে। এসব সুযোগ সুবিধা কারা পায় কিংবা কেন আমাদের কৃষকরা সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় সেদিকে দৃষ্টি দেয় না।
কৃষকের সবচেয়ে বড় দুঃখ, তারা তাদের কষ্টার্জিত কৃষি পণ্যের যথার্থ মূল্য পায় না। কৃষির খরচ যোগাতে গিয়েই কোনো কোনো কৃষক এখন দেউলিয়া হয়েছেন। ভিটেমাটি বন্ধক কিংবা বিক্রি করে বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ করে বেঁচে থাকার আশায় গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় ঢাকার দিকে।
এমন দুঃখ কথা স্বীকার করেও বলতে হবে, বদলে যাচ্ছে গ্রাম। গ্রামের মানুষ। তাদের যাপিত দিন ও জীবনধারা। এই গ্রামকে অবহেলা করার দিন পিছনে গেছে। এখন তা মানতে হবে নইলে অস্বীকারকারীকেই পিছনে পড়তে হবে।