শান্তি-শৃঙ্খলা, মানবতা ও আনুগত্যসর্বস্ব জীবনবিধান হিসেবে ইসলামে উৎকণ্ঠা আর বিশৃঙ্খলা এর গোড়াপত্তনের পর থেকে আজঅবধি বৈধতা পায়নি। জোরপূর্বক অপরের প্রতি চড়াও হওয়া, ধন-সম্পদের ক্ষতি সাধন করা এবং প্রাণনাশ কিংবা জনমনে ভীতি সঞ্চার করার বিধান আদৌ অনুমোদন দেয়নি ইসলাম। প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় হাজারো শক্তি, সাহস-সামর্থ সঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও ন্যায়সঙ্গত পন্থায় সম্মুখ প্রতিহত ব্যতিত তার অজান্তে গুপ্তভাবে হামলা করা কিংবা প্রতিশোধ গ্রহণ করা চিরতরে নিষিদ্ধ মানবতাবান্ধব এই জীবনবিধানে। আর এর রয়েছে ইসলামের প্রামাণিক সোনালি ইতিহাস।
ইসলামের শৈশবকাল থেকেই সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গি-সাথীদের এর করণীয়-বর্জনীয়াদির চর্চায় একটি অনুপম শ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদায় সমাসীন করেন। মহানবীর (দ.) অতুলনীয় জীবন চরিতে উজ্জীবিত সাহাবীগণও পরিচয় দিয়েছেন ইসলামের অন্যতম অনুসারী হিসেবে। ইবাদত-বন্দেগী, সামাজিক জীবন পরিচালনা, রাষ্ট্রীয় ও সামরিক জীবনব্যবস্থা কেমন হবে সবকিছুর সর্বাধুনিক ও মার্জিত রূপরেখা সাহাবীগণ পেয়ে যেতেন মহানবীর (দ.) জীবনাদর্শ থেকে। যার প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে ঘটা ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ।
হিজরী সনের ২য় বর্ষের ১৭ই রমযান সংঘটিত এই যুদ্ধ মুসলমানদেরকে একটি সুশৃঙ্খলাবদ্ধ নমনীয় শান্তিকামীর পাশাপাশি বিশ্ববিজয়ে দুরন্ত-সাহসী হিসেবে বেড়ে উঠার প্রেষণা জোগিয়েছে।
শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মুসলমানদেরকে মদিনার ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত বদর নামক উপত্যকায় গিয়ে যুদ্ধে উপনীত হওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে এই প্রথম। তবে মুসলিম সৈন্যদল ও মক্কার পৌত্তলিক কুরাইশদের মাঝে এ যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ নিহিত রয়েছে। বিশেষত যে কারণটি মদিনা আক্রমণের জন্য মক্কার কুরাইশদেরকে অত্যাধিক উদ্বুদ্ধ করেছে তা হলো- কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদিনার মুসলমান কর্তৃক আক্রান্তিত হওয়ার অপপ্রচার। মূলত এ কুরাইশ দলপতি বাণিজ্যের অজুহাতে অস্ত্রসংগ্রহের জন্যই সিরিয়া গমন করে [পরে তিনি ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (দ.) এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবীর মর্যাদায় সমাসীন হন]। সিরিয়া থেকে মক্কা অভিমুখে যাত্রাকালে মদিনা উপকণ্ঠে এসে জানতে পারল যে, মদিনাবাসীরা তার পথরুদ্ধ করবে। সে তখন পথ পরিবর্তন করে অন্য পথে মক্কা গমন করে। আর মক্কায় সংবাদ পৌছল যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশ কাফেলা মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মদিনা উপকণ্ঠে মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে। এটি ছিল মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছড়ানো গুজবমাত্র। তবে ঐতিহাসিক মুহাম্মদ আলী কর্তৃক চিহ্নিত কারণটিও প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তি কে ধ্বংস সধন করার কুরাইশদের উদ্বেগই বদর যুদ্ধের অন্যতম কারণ।”
গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই মক্কার কুরাইশ দলপতি আবু জেহেল আবু সুফিয়ানকে সাহায্যের পাশাপাশি মহানবী (দ.) ও মদিনাবাসী মুসলমানদেরকে ধরাধম থেকে চিরতরে মূছে ফেলার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এক হাজার পৌত্তলিক সৈন্যসহ মদিনা অভিমুখে রওয়ানা করে। মক্কার বিখ্যাত গোত্রপতি ও কাফির সর্দার উতবা, শায়বা, ওয়ালিদ, খাকনা, উবাইদা, মুনাব্বা, নওফিল প্রমুখ এ বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত ছিল।
মহান আল্লাহর ওহী নির্দেশে মহানবী (দ.) মক্কায় সহায় সম্বল রেখে আসা ৬০ জন মুহাজির এবং তাঁদেরকে মদিনায় সাহায্যকারী ২৫৩ জন আনসার- সাকুল্য হিসেবে ৩১৩ (তিনশত তেরো) জনের একটি ছোট্ট কাফেলা নিয়ে হিজরতের ঊনিশতম মাস ৮/১২ রমযানের ফরয রোযা রাখা অবস্থায় বদর উপত্যকায় রওয়ানা হন। ইসলামের ইতিহাসে এটিই “বদর যুদ্ধ” নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে আনসার-মুহাজিরের যৌথ অংশগ্রহণে মুসলমান এবং কাফেরের সাথে সংঘটিত প্রথম সম্মুখযুদ্ধ এটি।
মক্কার বৃহত্তর কুরাইশ বাহিনীর তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল এক-তৃতীয়াংশ; কিন্তু যুদ্ধ সরঞ্জামের দিক থেকে মুসলমানরা তাদের এক শতাংশও ছিলেন না। কুরাইশ কাফেরদের সবাই ছিলো বর্ম পরিহিত এবং প্রত্যেকে বয়সে ছিলো যুবক। পক্ষান্তরে মুসলমানদের সাধারণ অবস্থা ছিলো তাঁরা রোযাদার, ক্ষুধায় কাতর, দুর্বল, অসুস্থ ও ক্ষীনকায়। সকলের কাছে মামুলী হাতিয়ারও পুরোপুরি ছিলো না। কারো কাছে হয়ত তলোয়ার আছে, কিন্তু বল্লম বা ধনুক নেই, কারো কাছে বল্লম আছে, কিন্তু তলোয়ার নেই।
অপরদিকে কুরাইশ বাহিনীতে ছিলো ৭০০ উষ্ট্রারোহী, ১০০ অশ্বারোহী এবং ২০০ পদাতিক সৈন্য। আর মুসলমানদের ছিলো মাত্র ৭০টি উট এবং ৩টি ঘোড়া। প্রতিটি উট-ঘোড়ায় ছিলেন তিন-তিন জন চার-চার জন আরোহী। মহানবী (দ.) যে উটটিতে আরোহণ করেছিলেন, তার পিঠে আরো দু’জন সাহাবী আরোহী হন। (আসাহহুস সিয়র-৮৪ পৃ.)
যুদ্ধ সরঞ্জাম জনবল কাফেরদের তুলনায় অপ্রতুলতাকে উপেক্ষা করেই মহানবী (দ.) মহান প্রতিপালকের দরবারে ফরিয়াদ করে তাঁর সঙ্গী-সাথীদের শুনিয়েছেন আশার বাণী, জোগিয়েছেন তাঁদের অন্তরে একরাশ সাহস-উদ্দীপনা। দিয়েছেন অভয় ও সান্ত¦নার অমোঘ ঘোষণা। শিখিয়ে দিলেন যুদ্ধনীতি। যুদ্ধের প্রস্তুত করে দিয়েছেন অপ্রস্তুত কোনো শান্তিপ্রিয় নিরহ জাতিসত্ত্বাকে। আর মহানবীর (দ.) দেয়া প্রেরণায় মুসলমানগণ উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ঝেঁপে পড়েছেন কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে। যুদ্ধের ময়দানে দু’পক্ষই বীরত্বের পারাকষ্ঠা প্রদর্শন করে। একপর্যায়ে কুরাইশরা মুসলমানদের প্রচ-ভাবে আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায়ও সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর মোকবেলা করা কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি। যার ফলে কুরাইশদল তাদের ৭০ জন বীরের শবদেহ এবং আরো ৭০ জনকে বন্দী অবস্থায় ফেলে রণে ভঙ্গ দিয়ে মুসলমানদের নাগাল থেকে পালায়ন করে। আর এই যুদ্ধে মক্কার বিখ্যাত কাফের সর্দার আবু জেহেল, উতবা ও শায়বাসহ আরো অনেকেই নিহত হয়। অপরদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
অল্প সংখ্যক মুসলমানদের মোকাবেলায় কুরাইশের বিশাল বাহিনীর পরাজয় বিস্ময়ের অন্যতম প্রকৃষ্ট নিদর্শন। মহানবীর (দ.) সামরিক অভিজ্ঞতা, দূরদর্শী বিচক্ষণতা, কাফেরদের প্রতি উত্তম ব্যবহারের নির্দেশনা এবং মুসলিম বাহিনীকে সাহস ও হিম্মত দান ছিল এ যুদ্ধে মুসলিম বিজয়ের অন্যতম প্রেরণা শক্তি। সবিশেষ মহান আল্লাহর অদৃশ্য শক্তির বহিঃপ্রকাশও মুসলমানদেরকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে।
মুসলমানদের বিশ্ব বিজয়ের অনুপ্রেরণা লাভের প্রথম সূত্রপাত ঘটে বদরের যুদ্ধে বিস্ময়কর জয়ের মধ্যদিয়ে। মদিনাকে ইসলামি রাষ্ট্রের শক্তিধর প্রাণকেন্দ্র রূপে গড়ে তোলে। মক্কা বিজয় থেকে শুরু করে আরব-অনারব তথা গোটা দুনিয়াব্যাপী ইসলামের বিজয় নিশান উড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। একসময়কার শক্তিশালী দুই পরাশক্তি রাষ্ট্র রোম ও পারস্য বিজয়ের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে কর্ডোভা, স্পেন, গ্রানাডা, মালাখা ও সেভিলসহ তৎকালীন বিশ্বের ইউরোপ-আফ্রিকার পরাশক্তিগুলো জয় করে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের গণ্ডিতে আবদ্ধ করতে বদর যুদ্ধের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা কাজ করেছে।