বাঙালির গর্বের, গৌরবের মাস মার্চ। এই মাসেই ঘোষিত হয় বাঙালির মুক্তি, বাংলাদেশ নামের একটি নতুন দেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির মরণপণ লড়াইয়ে।
সকাল থেকেই ঢাকা মিছিলের নগরী। হাতে বাঁশের লাঠি, জনস্রোতের ঠিকানা রেসকোর্স ময়দান। জায়গায় জায়গায় উড়ছে মানচিত্র আঁকা লাল সবুজের পতাকা। জনসমুদ্রে একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কি ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের: কখন আসবে কবি? শোনাবেন তার অমর কবিতাখানি?
বিকেল তখন ঠিক তিনটা কুড়ি মিনিট। অতঃপর শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে দৃপ্ত পায়ে কবি এসে দাঁড়ালেন মঞ্চে। জনতার সামনে দাঁড়ালেন ইতিহাসের নায়ক, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বজ্রকন্ঠে শুরু করেন সেই মহাকাব্যিক ভাষণ:
‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’
‘কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস…’
অবশেষে গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি: আসে সেই নির্দেশ, আসে মুক্তির ঘোষণা, আসে স্বাধীনতার ঘোষণা:
‘…আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।’
‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না…’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র প্রচার করছিলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বন্ধ করে দেয় শাসকগোষ্ঠী। প্রতিবাদে বেতার কর্মীরা সামগ্রিক প্রচার বন্ধ করে বের হয়ে যান বেতার ভবন থেকে।
বঙ্গবন্ধুর আগুন ঝরা ১৭ মিনিটের ঐতিহাসিক এই ভাষণই পরিণত হয় পরবর্তী পুরো নয় মাসের রক্তাক্ত গেরিলা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জয়ের মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেরণা।