ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ভারতের উড়িষ্যা উপকূলে আছড়ে পড়ার পর থেকেই ধ্বংসলীলার বিভিন্ন ছবি সামনে আসতে শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড়টি এখন পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে চলে এসেছে বাংলাদেশে।
অবশ্য এই পরিস্থিতি কোনো ব্যতিক্রম কিছু নয়। বারবার এর মুখোমুখি হয়েছে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষ। ভবিষ্যতেও বারবারই এর মুখোমুখি হতে হবে। এর কারণ পৃথিবীর যে অঞ্চলে আমরা থাকি, সেখানে পাশাপাশি অবস্থান করছে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত প্রবণতা। তাই বার বার ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের মুখে পড়াই এই অঞ্চলের নিয়তি।
এখানে একদিকে মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ স্থলভাগ। আর তার পাশেই বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলভাগ। বিপরীত প্রবণতার উৎস এটাই।
মধ্য ভারতের প্রশস্ত স্থলভাগে প্রায় সারা বছরই সূর্যরশ্মি দাপট দেখায়। সূর্যের তাপে ওই বিস্তীর্ণ স্থলভাগের বাতাস গরম হয়ে ওপরে উঠে যায় এবং মধ্য ভারতের স্থলভাগে নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হয়।
সেই বিশাল স্থলভাগ যেখানে শেষ হচ্ছে, ঠিক সেখানেই আবার বিশাল জলভাগ, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর। সেখানে ঘটে উল্টো ঘটনা। সূর্যের তাপে প্রতিদিন বঙ্গোপসাগরের পানি থেকে বিপুল পরিমাণে বাষ্প তৈরি হয়। জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ এই বাতাস ভারী হওয়ায় বেশি ওপরে উঠতে পারে না। ফলে উচ্চচাপের পরিস্থিতি থাকে এ অঞ্চলে।
বাতাস সবসময় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। তাই বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেয়া ভারী এবং অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা বাতাস উত্তর ভারতের স্থলভাগের দিকে ছুটে যায়। এই প্রবণতাই জন্ম দেয় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের।
তবে বাতাস বঙ্গোপসাগর থেকে মধ্য ভারতের দিকে যেতে চাইলেই যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হবে, এমনটা নয়। সমুদ্রের ওপর জমতে থাকা জলীয় বাষ্প বা ভারী বাতাস ঘূর্ণাবর্তের রূপ নেবে কি না, তা তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির ওপরে অনেকটাই নির্ভর করে। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়ে গেলেই ঘূর্ণি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে: শুধু বঙ্গোপসাগরেই কেন? ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগর যে অবস্থানে আছে, সেখানেও তো একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সম্ভব। মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ স্থলভাগের পূর্ব দিকের কিনারায় যেমন বঙ্গোপসাগরের অবস্থান, ঠিক তেমনি ওই স্থলভাগের পশ্চিম দিকের কিনারায় আরব সাগর রয়েছে।
আরব সাগরে যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না, তা নয়। তবে সে সব ঝড়ের বেশিরভাগই পশ্চিম দিকে চলে যায় অর্থাৎ মধ্য এশিয়ার উপকূলে গিয়ে আঘাত হানে। কারণ প্রথমত, ভারতের পশ্চিম উপকূল জুড়ে বিস্তৃত পাহাড়ে বাতাস বাধা পায়। দ্বিতীয়ত, মধ্য ভারতের চেয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে নিম্নচাপের তীব্রতা অধিকাংশ সময় বেশি থাকে।
তবে এ কথাও ঠিক, বঙ্গোপসাগরে যত ঘূর্ণিঝড় জন্ম নেয়, আরব সাগরে তত বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না। আরব সাগরের চেয়ে বঙ্গোপসাগর অনেক বেশি উত্তাল বা অশান্ত বলেই এমনটা হয় বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
পশ্চিমবঙ্গের উপকূল এমনই একটি অবস্থানে রয়েছে যে, খুব কম সংখ্যক সাইক্লোনই সরাসরি এই উপকূলের দিকে আসে। ঘুর্ণিঝড়গুলোর জন্ম মূলত হয় আন্দামান এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মাঝামাঝি এলাকায়। ওই অঞ্চল থেকে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আঘাত হানার প্রবণতা কমই থাকে। কারণ হয় পূর্বে, না হয় পশ্চিমে যাওয়ার প্রবণতাই বেশি থাকে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলোর। তাই এগুলো হয় তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশে আঘাত হানে, নয়তো মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের দিকে।
উড়িষ্যা উপকূলে আঘাত হানা সাইক্লোনের সংখ্যাও কম নয়। সেসব ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব প্রায় প্রতিবারই পশ্চিমবঙ্গে পড়ে। তবে সাইক্লোন ফণীর চূড়ান্ত গন্তব্য বাংলাদেশই।
সূত্র: আনন্দবাজার