চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচন কবে হবে?

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পৈশাচিক ভূমিকা পালনকারী হিসেবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কথাই বার বার সামনে চলে আসে। সম্প্রতি জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে ১৫ অগাস্টের মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন সেনা প্রধান কেএম শফিউল্লাহর কঠোর সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। শফিউল্লাহ পঁচাত্তরের ওই রাতে কিছু সংখ্যক সেনা সদস্যের ট্যাঙ্ক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে যাওয়ার খবর পেয়ে নিশ্চুপ ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তাঁর মতে, ‘আর শফিউল্লাহতো জীবন্ত মৃত। উনাকে সবাই ঘৃণা করে। কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক। উনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ঘৃণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে আলোচনায় সেলিম বলেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে কেউ ভালো থাকতে পারে নাই। ওই জিয়াউর রহমানেরও ভালো যায় নাই, খালেদ মোশাররফেরও ভালো যায় নাই। বাড়িতে অ্যাটাক হওয়ার পর কিন্তু বঙ্গবন্ধু কয়েক জায়গায় ফোন করেছেন এবং আর্মি চিফ শফিউল্লাহকে ফোন করেছেন। ট্যাঙ্ক যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় তখন রাত সাড়ে ৪টা। কর্নেল সালাউদ্দিন নামের এক অফিসার ট্যাঙ্ক বের হবার সময় আর্মি চিফের কাছে ছুটে যায় আর জানায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে। শফিউল্লাহকে বলে, স্যার ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে বোধ হয় প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে যাচ্ছে। সেই সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা সময়টায় শফিউল্লাহ কী করেছেন? দশটা ট্রাক যদি রওনা দিতো ওরা পালাবারও জায়গা পেত না। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজে ওই রাতে শফিউল্লাহকে ফোন করে বলেছিল, তোমার আর্মি আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। শফিউল্লাহ বলেছিল, ‘স্যার আমি দেখছি’। দ্বিতীয়বার যখন বঙ্গবন্ধু ফোন করে শফিউল্লাহ বলে, ‘স্যার আপনি একটু বাসা থেকে সরে যেতে পারেন না?’ তখন বঙ্গবন্ধু রাগ করে ফোন রেখে দেন।

এই ঘটনায় আর্মি চিফ শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ কিংবা জিয়াউর রহমান কেউ-ই বিন্দুমাত্র রিঅ্যাক্ট করেন নাই। ওই সময় যদি তারা মুভ করতেন, দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে এমন নির্মম পরিণতি বরণ করতে হতো না’’ (বিডি নিউজ ২৪ ডটকম, ১১ আগস্ট, ২০১৬)।

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের কথাগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সেনাকর্তাদের ভূমিকার যথযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধানও হওয়া দরকার। কেবল ফারুক-রশীদ-ডালিম-হুদা-নূর-মুসলেহউদ্দীনসহ দশ-বারোজন মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের সেনাকর্মকর্তার দায় নয় ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড। যারা ১৫ আগস্টে ওই ঘটনা ঘটালো, সেনা অর্ডারের বাইরে যারা গেল তাদের বিরুদ্ধে কেন ঊর্ধ্বতনরা ব্যবস্থা গ্রহণ করল না? মেজর ডালিম, নূররা কীভাবে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকল? সব কিছু জেনেও শফিউল্লাহ-জিয়া-খালেদ মোশারারফ কেন চুপ থাকল? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া দরকার।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল মূলত একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ। যারা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে, তাদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফল হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং পাকিস্তানের ভুট্টো বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের প্রতি তার (কিসিঞ্জার) ঘৃণার কথা স্বীকার করেছেন। মরিস জানান, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। আমেরিকা ও তার অনুগ্রহভাজন পাকিস্তানকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করে এবং মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর।’ (বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন, লরেঞ্জ লিফসুলজ পৃ. ১৩৬-১৩৮)।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হন পাকিস্তানের ভুট্টো। ১৫ আগস্ট মুজিব হত্যার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বাংলাদেশের খুনি সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় খুশিতে ডগমগ ভুট্টো তাৎক্ষণিকভাবে খুনি মোশতাক সরকারকে ২ কোটি ডলার মূল্যের ৫০ হাজার টন চাল ও দেড় কোটি গজ কাপড় দেয়ার কথা ঘোষণা করে।

আমেরিকা-পাকিস্তানের দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্ব কিসিঞ্জার-ভুট্টো বাংলাদেশের ক্ষমতালোভী কিছু কুলাঙ্গারকে দিয়ে খুব সহজেই ইতিহাসের নির্মমতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে বরখাস্ত করে খুনি চক্র জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন মাসের মাথায় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। অনেকেই মনে করেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানই মূল নায়ক। অতি চালাক, উচ্চাভিলাষী, অতি ধুরন্ধর এই ব্যক্তিটি কেবলই সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। ‘ঝোঁপ বুঝে কোপ মারা’র বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত এই জেনারেল ধাপে ধাপে পৌঁছেছেন ক্ষমতার শীর্ষে। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, তিনি কোনো অপকর্মেরই প্রমাণ রাখেননি।

জিয়া ছিলেন সব সময়ই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খানিক পর কর্ণেল রশীদের ফোন পান সেনানিবাসে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল। ঘটনায় হতভম্ব ও উদভ্রান্ত অবস্থায় তিনি ছুটে যান কাছেই উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায়। উত্তেজিত অবস্থায় দরজা ধাক্কাতে থাকেন তিনি, বেরিয়ে আসেন জিয়া। পরনে স্লিপিং ড্রেসের পায়জামা ও স্যান্ডো গেঞ্জি। এক গালে শেভিং ক্রিম লাগানো। শাফায়াত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, দ্য প্রেসিডেন্ট ইজ কিল্ড। শুনে জিয়া অবিচলিত। তার শান্ত প্রতিক্রিয়া- প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইউর ট্রুপস রেডি। আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন। এই সংবিধান সমুন্নত রাখার নির্দেশনা মানে এই নয় যে খুনিদের গ্রেপ্তার, বরং তাদের সার্বিক সহায়তা- যার প্রমাণ মিলেছে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে।

বিবিসির সৈয়দ মাহমুদ আলী তাঁর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ’ বইয়ের ১১১ পৃষ্ঠায় বলেছেন-মূল ষড়যন্ত্রকারী মেজর ফারুক জিয়াউর রহমানের কাছে ২০ মার্চ, ১৯৭৫ অভিযানের নেতৃত্ব কামনা করেন। তিনি তাতে অসম্মত হন কিন্তু মেজরদের থামানোর চেষ্টা তিনি করেন নি। ‘এনাটমি অব আ ক্যু’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের অনেক আগে থেকেই জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিলো। জিয়া তাদের বলেছিলেন- ‘একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে এতে আমার যোগ দেওয়ার সম্ভব নয়, তবে তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু করতে চাও, করো। আমি বাধা দেবো না।’ এই যে সবুজ সংকেত, এটাই ছিল ফারুক-রশীদদের জন্য আশীর্বাদ। অর্থাৎ জিয়া পুরো পরিকল্পনা জানতেন। কিন্তু এতে সরাসরি জড়াতে চাননি। বরং নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর উপর ক্ষুব্ধ অফিসারদের সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ভূমিকাও রহস্যময়। সে সময় সেনাবাহিনীর তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যে ট্যাংক ১৫ আগস্ট ব্যবহার করা হয়, সেই ট্যাংকে কোনো গোলা-বারুদ ছিল না। ওইসব গোলার চাবি ছিল সিজিএস খালেদ মোশাররফের কাছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ১৫ আগস্ট ১২টার মধ্যেই খুনিচক্রকে ট্যাংকের গোলা সরবরাহ করেন।

১৫ আগস্ট ব্রিগেডিয়ার খালেদ ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শাফায়াত জামিলের অফিসিয়াল চেয়ারে বসে সারাদিন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। শাফায়াত জামিল বলেছেন, ১৫ আগস্ট তার চেয়ারে তিনি এক মিনিটের জন্যও বসতে পারেননি। শাফায়াত জামিল তার লেখা ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ শীর্ষক গ্রন্থে দাবি করেছেন, সেনাপ্রধানের নির্দেশেই খালেদ ৪৬ ব্রিগেড নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যদিও সফিউল্লাহ বলছেন, তিনি এমন কোনো নির্দেশ দেননি।

এ সময় এরশাদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান ও উপসেনাপ্রধান বানিয়ে এটাই জানান দেয়া হয় যে, প্রথমে জিয়া এবং এরপর এরশাদকে ক্ষমতায় আনা হবে। জে. জিয়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ দখলের পর এরশাদকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। ১৯৮১ সালে জিয়া-মঞ্জুরকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন এরশাদ। আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল লক্ষ্য ছিল একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তানে’ পরিণত করা। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া তাদের ২৫ বছরের শাসনামলে ৩০ লাখ শহীদ ও ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সত্যি মিনি পাকিস্তানে পরিণত করেছিলেন।

যদি ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা সেদিন চেইন অব কমান্ড রক্ষার মাধ্যমে সংবিধান সমুন্নত রাখতেন, তাহলে মোশতাক, সায়েম, জিয়া, এরশাদ চক্র ১৫ বছর অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাখতে পারত না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারক ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল রায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ, কর্নেল শাফায়াত জামিলসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। রায়ে বলা হয়, ‘এই ঘটনা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলংক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে’ (বঙ্গবন্ধু হত্যা-সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার দালিলিক প্রমাণ : জাহিদ নেওয়াজ খান)।

স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশীয় এজেন্ট ফারুক-রশীদ-জিয়া-এরশাদের ক্ষমতা লিপ্সার কারণে সেনাবাহিনী শুধু নয়, বাংলার ইতিহাসও কলঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সেই কলঙ্কের মূল হোতাদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রহস্য এখনও বের হয়নি। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে কবর দেওয়ার স্বার্থে, জাতির জনকের রক্তঋণ শোধ করার তাগিদেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচন হওয়া দরকার। প্রশ্ন হলো, কাজটি কে করবে? আর কবেই বা করা হবে?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)