বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণতা দিতে সারাদেশের মানুষ যাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন, বিজয়ের স্বাদ আস্বাদনের জন্য দিনাতিপাত করেছিলেন, তিনি হলেন আমাদের জাতির জনক, স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ, বাঙালির রাজাধীরাজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান থেকে বৃটেন ও ভারত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন দেশে, স্বভূমে, আপন ভূবনে বীরের বেশে ফিরে আসেন বহু আন্দোলন সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু। ঐ দিন সমগ্র বাঙালি জাতির ন্যায় আনন্দে উদ্বেল হয়েছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
দেশে আসার পরে বঙ্গজননী তাঁর প্রিয়তম স্বামীকে উল্লেখ করে বলেছেন ‘এখন তো তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করেছে। এখন তোমার অবসর নেয়ার সময়।’ বঙ্গবন্ধুকে কাছে পেয়ে রেণুর যে আর্তনাদ প্রকাশ পেয়েছিল তাতে বিগত ১০ মাসের দুঃখ, কষ্ট অভিমানকে ভুলে আনন্দাশ্রু সকলের ন্যায় ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে আনন্দিত করে তুলেছিল। রাজকন্যার রাজপুত্রকে ফিরে পাওয়ার চিত্রায়ন দেখা গিয়েছে শেখ মুজিবের আগমনে। ফজিলাতুন নেছা মুজিব তার হারানো ধনকে ফিরে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে অভিভূত ছিলেন। যে মানুষটির সাথে বিগত ১০ মাস কোন যোগাযোগ ছিল না, বেঁচে আছে না মারা গেছে তার কোন সংবাদও ছিল না, সে মানুষটিকে হাতের কাছে পেয়ে পরিবারের সকলের আনন্দ ছিল চোখে পড়ার মত। দেশে এসে প্রথমে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির সেই ১৮ নং রোডের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। যে বাড়িটিতে খাট ছিল না, ছিল না পালংক, এমনকি পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না। উক্ত বাড়িটিতে যুদ্ধের পুরো সময় ফজিলাতুন নেছা মুজিব পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অধীনে ছিলেন। অত্যন্ত অযাচিত ও নিষ্ঠুর আচরণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সময় অতিবাহিত করতে হয়েছিল শেখ মুজিবের পরিবারকে।
ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িটি পাকিস্তানি সৈন্যরা এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ করে রেখেছিল যে ঠিক করতে মাস দুয়েক সময় লেগেছিল। বাড়িটির সব কিছু শেষ করে দিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বাদ যায়নি ফজিলাতুন নেছা মুজিবের প্রিয় জিনিসগুলো, যে সামগ্রীগুলো শত কষ্টের মধ্যে বিক্রি করা থেকে বিরত ছিলেন তিনি। বাড়িটির ধ্বংসাবশেষে প্রায় শ পাঁচেক কাপ-পিরিচের নমুনা ছিল, যেগুলো বাসার কাজের ছেলে আব্দুল সংগ্রহ করেছিল। সেই কাপ-পিরিচগুলোতে ফজিলাতুন নেছা মুজিব দলীয় নেতাকর্মীদের চা পরিবেশন করতেন। পাকিস্তানি সেনারা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোর পাশাপাশি বাড়ির অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট করেছিলো যা আর পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তারিখে পুরো বাংলাদেশ শেখ মুজিবের আগমণে বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছিল। বাংলাদেশের প্রকৃতিও যেন তার ছোঁয়া পেয়েছিল, আকাশে বাতাসে ছিল বিজয়ের প্রাণোল্লাস। বাংলার প্রকৃতিও যুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্থতার মধ্যে নতুন রূপে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব
বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পরে ফজিলাতুন নেছা মুজিব যেমন তার মহানায়ককে ফিরে পেয়েছিলেন ঠিক তেমনি বাংলার জনগণ পেয়েছিল পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার স্বাদ, পেয়েছিল নতুন উদ্যমে বেঁচে থাকার বাসনা। কিন্তু এত কিছুর পরেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সর্বত্রই ছিল শূন্যতা, পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় অস্থির, হাহাকার, আপনজন হারানোর মর্মবেদনা। সে অবস্থায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে কর্মযজ্ঞের ভাবনায় উৎসুক হয়ে উঠেন। চতুর্দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসের নীলিমা ভেসে বেড়াচ্ছিল, নদীতে নদীতে ভেসে আসছিল মানুষের লাশ, ব্যাথাতুর মানুষের আর্তনাদ, খাবারের অভাব ছিল প্রত্যেক জায়গায়। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পৌঁছেছিল, সাথে সাথে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ঘর-বাড়ি, ব্রীজ-কালভার্ট, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছিল হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল, কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর তারা বুঝতে পেরেছিল অদম্য বাঙালির কাছে পরাজয় সুনিশ্চিত। তাই প্রত্যেকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনায় তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সেই বিবর্ণ বাংলাদেশের পরিপূর্ণ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সহযোগী হিসেবে সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মোটামুটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী চট্রগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরকে সম্পূর্ণরূপে অচল করে দেয়। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সহ ২১৯ টি রেলসেতু, ২৭৪টি সড়ক সেতু, ১৪০টি ট্রাক এবং ২৫০০ এর মত বাস ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। পূর্বপরিকল্পনা মাফিক ব্যাংক ও বীমাগুলোতে কোন ধরনের সঞ্চয় ছিল না, ছিল না কোন বৈদেশিক মুদ্রা বা স্বর্ণমুদ্রা। অর্থাৎ, পাকিস্তানিরা সব দিক থেকেই বাংলাদেশকে নিঃশেষ করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা এঁকেছিল, যাতে করে বিজয় লাভের পর কোনভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে বাংলাদেশ।
সমস্যায় জর্জরিত দেশটাকে বিপদাসংকুল অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সব ধরনের লালসা, আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশ গড়ায় মনোনিবেশ করেন, আর এ কাজে জাতির জনকের সুযোগ্য সহধর্মিনী দক্ষ পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেন। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ক্ষেত্রে এবং শিল্পকারখানার প্রসার ও বিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখেন। সে সময়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর সরকারি কাজ পরিচালনার জন্য কয়েকজন উপদেষ্টা ছিল। কিন্তু সর্ববিষয়ের উপদেষ্টা ছিল একজন, সর্বগুণে গুণান্বিত, ধীর-স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে রাতে খাবার টেবিলে অবশ্যই ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সাথে সলাপরামর্শ হতো এবং সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতো। ২ লক্ষ নির্যাতিত মা বোনের দায়িত্ব গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন ও নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন, প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারী কর্মচারীর মর্যাদা প্রদান, কুদরাত ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও স্বায়ত্বশাসন প্রদান ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ প্রণয়নে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অসামান্য অবদান রয়েছে।
গ্রামের সাধারণ সহজ সরল মহিলা থেকে শ্বাশত বাংলার আবেগ তাড়িত রূপ ধারণ করায় সকলের পরম শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। স্বাধীনতার পূর্বমূহুর্তে আন্দোলনের চরম মূহুর্তে তিনি যে ভূমিকা রেখেছিলেন সত্যিই তা অসাধারণ, অনন্য এবং নজিরবিহীন। দেশের প্রধান ব্যক্তির স্ত্রী হওয়ার পরেও তার আচরণ এবং মানসিকতায় সামান্য পরিবর্তন আসেনি। আগের মতই তিনি সংসারকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়। বিজয় অর্জনের পরেও সকলের জন্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি ছিল উন্মুক্ত, যে কোন প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারতেন নিমিষেই। নিজের ছেলেমেয়েদের ভোগবিলাসে মত্ত না হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, “না, আমার ছেলেমেয়েরা বেশি বিলাসিতায় থাকলে ওদের নজর খারাপ হয়ে যাবে”। একজন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী কতটা সৎ থাকলে এহেন নজরদারী ও দায়িত্ব পালন করতেন ছেলেমেয়েদের বিষয়ে সে দৃষ্টিকোণ থেকেই গবেষণায় আসতে পারে ইস্যুটি। তিনি নিজের ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক জীবন ধারণে অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেছিলেন এবং মানবিক মানুষ হিসেবে বড় হওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন।
শুধু কি নিজের ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজনদের ছেলেমেয়েদের বিষয়ে তিনি কড়া নির্দেশনা দিতেন। নিজের ছেলেমেয়েদের মতো অন্যের সন্তানদের আদর ও ভালবাসা দিতেন। অভিভাবকহীন সন্তানদের নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিতেন। দু লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পরে নির্যাতিত মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। সরকারের এ গ্রহনীয় সিদ্ধান্তের পিছনে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের যথার্থ অবদান ছিল। ঐ সব মেয়েদের বিয়ে সম্পন্ন করার সময় বাবা মায়ের নামের জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নাম লেখা হত। অনেক বিয়েতে ফজিলাতুন নেছা মুজিব উপস্থিত হয়ে নিজের হাতের গহনা দিয়েছেন বিবাহযোগ্য মেয়েদের। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবেও তাঁর আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি, কারণ তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত মানুষ। তিনি তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেন, বিলাসিতার ধারেকাছেও ছিলেন না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে নির্যাতিতদের সাহায্য করা, পুনর্বাসন করা, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরিতে সুপারিশ করা, রিলিফ কমিটির ত্রাণ বিতরণের বিষয়েও খোঁজ রাখতেন সর্বক্ষণ এবং ঐসব মেয়েদের বিয়েতে সার্বক্ষণিক তদারকি করতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
ফজিলাতুন নেছা মুজিব দীর্ঘ ১০ মাস পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বন্দিদশায় থাকার ফলে তিনি ও তাঁর সন্তানেরা খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের চরম দুর্যোগ সময়ে যাপিত জীবনের প্রতিটা ক্ষণ ছিল আশংকার মধ্যে নিমজ্জিত। সে দুঃসময়ে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের দৃঢ়তা সন্তানদের মনোবলকে উন্নত করেছিল। দেশের বিপদের সময়েও সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা করে সমস্ত বিপত্তিকে কিভাবে সামাল দিতে হয় সে দীক্ষা ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলেন। বিকৃত বিলাসিতা, লোভ লালসা, অর্থবিত্ত কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও তাঁর সন্তানদের। বেগম মুজিবের সে দর্শনটা আমরা বর্তমানে তাদের জীবিত দু’কন্যার জীবনাচরণের মধ্যে দেখতে পাই। সাধারণ মধ্যবিত্তের ন্যায় এখনো জীবনযাপন করেন তারা, যদিও একজন এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। ফজিলাতুন নেছা মুজিবের মানসিকতা, মনোবল, দৃঢ়তা, কঠিন সময়ে ধীর স্থির ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অসীম ক্ষমতাকে ব্যক্তি রেণুকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছে।
রেণুর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিসীম প্রেম, ভালবাসা ও আদর্শিক ভাবাবেগ। তদুপরি রেণুরও তাঁর স্বামীর প্রতি ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালবাসার সম্মিলন। স্বামীর প্রতি তার আবেগের বর্ণনা আমরা বিভিন্ন প্রথিতযশাদের কাছ থেকে শুনতে পাই। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও বঙ্গবন্ধুর প্রতিদিনের খাবার রেণু নিজেই রান্না করতেন, বাড়ির কোন কাজের লোককে কখনোই বঙ্গবন্ধুর জন্য কিছুই করতে দিতেন না। নিজের স্বামীর ভাগ কখনোই তিনি অন্যকে দিতে চাইতেন না, ছেলেমেয়েরাও বঙ্গবন্ধুর কাজের ভাগ পেত না। বঙ্গবন্ধু এত এত জনসভা করতেন এবং প্রত্যেক সমাবেশে ভাঁজ করা পাঞ্জাবী, চাদর আর পায়জামা পরিধান করতেন এবং এ কাজগুলো ফজিলাতুন নেছা মুজিব সহস্তে করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য গভীর রাত পর্যন্ত খাবার নিয়ে বসে থাকতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। রাত্রিতে খাবার টেবিলে এক সাথে খেতে বসে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা সেরে নিতেন।
চলবে…