বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রক্তে মিশে ছিল বাঙালির স্বাধীকার সংগ্রামের আন্দোলন, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলন। দলের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে সকলের কাছে পরম স্নেহের পাত্র ছিলেন জাতির জনক। বিভিন্ন জনসভা, পথসভা, দলীয় মিটিং বা সমাবেশ আয়োজনে ছিল শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। এ রকম আয়োজনের পুরোভাগে থাকায় তিনি প্রায়শই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সে রকম স্মৃতিচারণ করে শেখ মুজিব উল্লেখ করেন- “রেণু কয়েক দিন আমাকে খুব সেবা করলেন। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছিল ছোট বেলায়, ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষা নিকটবর্তী।” শেখ মুজিবের প্রতি ফজিলাতুন নেছা মুজিবের স্বামীপ্রীতি ছিল অসীম শ্রদ্ধার, ভালোবাসার এবং আবেগের, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি তা বারংবার প্রমাণ করেছেন। অল্প বয়স থেকেই স্বামীর পরিবারে থাকায় পুরো পরিবারটিকে দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল ফজিলাতুন নেছা মুজিবের একজন দক্ষ অভিভাবকের ভূমিকায়।
স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। তিনি জানতেন, তার স্বামী ঠিক পথেই আছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি কখনো ভুল পথে হাঁটবেন না। শেখ মুজিবের কর্মকাণ্ডে ছিল তার দ্বিধাহীন সমর্থন ও বিশ্বাসযোগ্যতা। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তা এতটাই বেশি ছিল যে পারিবারিক কর্মকাণ্ডে খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না। তারপরও ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্বামীর আর্থিক বিষয়টাই নিয়মমাফিক জোগান দিতেন। নিজের খরচের হাত ছোট করে স্বামীর জন্য টাকা রেখে দিতেন। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, “আব্বা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। অমঙ্গল অশ্রুজল বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল- একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলে বাড়ি এস।”
ভালবাসা, আস্থা এবং বিশ্বাসের জায়গায় ফজিলাতুন নেছা মুজিব শেখ মুজিবকে কোথায় রেখেছিলেন তা এ উক্তি হতে স্পষ্ট। এ ধরনের মানসিক সমর্থন একজন ব্যক্তিকে কতটা সম্মোহনী জায়গায় নিয়ে যেতে পেরে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিদ্যমান। জগতের সকল প্রতিষ্ঠিত ও প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের প্রতি এমন বিরামহীন ভালোবাসা ও সমর্থন তাদের কাজকে সহজ থেকে সহজতর করে দিয়েছে।
রাজনীতির পাশাপাশি যে লেখাপড়াটা জরুরি সে বিষয়েও ফজিলাতুন নেছা মুজিব সচেতন ছিলেন এবং স্বামীর পড়াশোনার বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজখরব নিতেন। আইন পড়া ছেড়ে দেওয়াতে শেখ লুৎফর রহমান মুজিবের উপর রেগে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি সংসারের দিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। সে মুহূর্তেও ফজিলাতুন নেছা দৃঢ়চিত্তে স্বামীর পাশেই ছিলেন। শেখ মুজিব স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন- “রেণু বললো, এভাবে তোমার কতকাল চলবে। আমি বুঝতে পারলাম যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।”
কোন একজন মানুষের সফলতার জন্য যেমন সহযোদ্ধা প্রয়োজন শেখ মুজিবের পাশে ফজিলাতুন নেছা ধ্রুবতারা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য ভূমিকা রয়েছে শেখ ফজিলাতুন নেছার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে দিক নির্দেশনা দিতেন রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের।
স্বামীর প্রতি শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের আবেগের জায়গাটা ছিল সত্যিকারের ভালবাসার, বাংলার আদর্শ রমণীর ন্যায়। নিজে স্বামী সোহাগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কিন্তু সন্তানদের পিতার আদর থেকে কখনো দূরে রাখতে চাইতেন না। নিজে শত কষ্ট সহ্য করেও সবসময় চাইতেন ছেলেমেয়েরা যেন বাবার সঙ্গ পায়। যখনই সামান্য সুযোগ পাওয়া গেছে, তখনই তিনিসহ সন্তানেরা পাশাপাশি থাকার চেষ্টা করেছেন। সে বিবেচনাতেই শেখ মুজিব উল্লেখ করেছেন- “রেণু বলল, কতদিন দেখা হবে না বলতে পারি না। আমিও তোমার সাথে বড় বোনের বাড়িতে যাব, সেখানেও তো দু’একদিন থাকবা। আমি ও ছেলেমেয়ে দুইটা তোমার সাথে থাকবো। পরে আব্বা যেয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন।” শ্বাশত চিরন্তন বাংলার রমণী হিসেবে ফজিলাতুন নেছা স্বামীর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন সবসময়। জীবনের চলার বাঁকে বাঁকে তিনি স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন নিরলস চিত্তে। তাই স্বামীসঙ্গ কামনা করতেন অন্যান্য গ্রামীণ সমাজের নারীর বাসনার মত। প্রকৃত অর্থেই, স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কের রসায়নকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এ জুটি।
সাংসারিক টানাপোড়েনের মধ্যে থেকেও ফজিলাতুন নেছা শেখ মুজিবের জন্য খুব চিন্তা করতেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আর্থিকভাবে যেন কোনভাবেই হেনস্থায় না পড়ে সে দিকটি বিবেচনায় রাখতেন সমসময়। যখনই জেল ফেরত অবস্থায় অথবা কলকাতা থেকে বাড়িতে আসতেন তখনই ফজিলাতুন নেছা হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কোন সময়ের স্মৃতিচারণ করে শেখ মুজিব বলেন- “আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেণুকে বললাম, এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দু’জন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময়ে তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন? আমার টাকার বেশি দরকার নাই।” কাজেই বলা যায়, যুদ্ধের মাঠে সহযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ফজিলাতুন নেছা। মানসিক ও আর্থিকভাবে সাহায্যের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরে ফজিলাতুন নেছা স্বামীর প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। কারণ, রেণুর কাছে ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশের মানুষ ও দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের মূল্য ছিল অনেক বেশি।
চলবে…