চট্টগ্রাম থেকে: চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট শফিকুল ইসলাম। বাবা-মায়ের চাওয়া ছিল অন্য তিন সন্তানের মতো পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে শফিকুলও। কিন্তু এ তরুণের মন পড়ে থাকত ক্রিকেট মাঠে। বগুড়ার শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের নেটে প্রায়ই বোলিং করতেন। সেখান থেকেই ফরহাদ রেজার মাধ্যমে সুযোগ পান রাজশাহী বিভাগের নেটে বোলিং করার।
কোচ আব্দুল করিম জুয়েল ও প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন শফিকুলের মাঝে দেখতে পান সুপ্ত সম্ভাবনা। ২০১৮ সালে রাজশাহীর মাঠে রংপুরের বিপক্ষে জাতীয় লিগের ম্যাচ নামিয়ে দেন। প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে অভিষেকে নেন তিন উইকেট।
মুশফিকুর রহিম নিজ এলাকার টগবগে এই তরুণকে ডাকেন জাতীয় দলের নেটে। দ্রুতই বদলাতে থাকে এ বাঁহাতি পেসারের জীবন। ডাক পান বিসিবির হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) স্কোয়াডে।
২৪ বছর বয়সী শফিকুল নিজের প্রথম বিপিএল খেলছেন ফরচুন বরিশালের হয়ে। একাদশেও তাকে দেখা যাচ্ছে নিয়মিতই। মঙ্গলবার রাতের ম্যাচে খুলনা টাইগার্সের অধিনায়ক মুশফিককে আউট করে ম্যাচ জয়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এর আগে শফিকুল খেলেছেন বঙ্গবন্ধু টি-টুয়েন্টি কাপ। বেক্সিমকো ঢাকার হয়ে ৮ ম্যাচে নেন ১১ উইকেট। আসরের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে এই তরুণের কথা বলেন দলটির অধিনায়ক মুশফিক।
কোচরাও শফিকুলের মাঝে দেখছেন অমিত সম্ভাবনা। বরিশাল কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন ‘ভবিষ্যত টাইগার পেসার’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। ক্লাব ক্রিকেট খেলার আগেই সুযোগ আসে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। বিসিবির বয়সভিত্তিক কাঠামোতে না থেকেও বড় পর্যায়ে চলে আসার নজির খুব বেশি নেই। শফিকুল জানান যেভাবে চলে এলেন বিসিবির ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশে।
‘খেলতে অনেক পছন্দ করতাম। আমার ভাই আমাকে অনেক সাপোর্ট করত। যেখানেই খেলতে যেতো আমাকে নিয়ে যেতো। ওখান থেকেই আসলে ক্রিকেট খেলা শুরু। তারপরে বগুড়াতে রেজা (ফরহাদ) ভাইয়ের মাধ্যমে আমি আস্তে আস্তে রাজশাহী ডিভিশন টিমে আসি। ওখান থেকে পরবর্তীতে মুশফিক ভাই আমাকে জাতীয় দলের নেটে বোলিং করার সুযোগ করে দিয়েছিল। ওখানে বোলিং করার পর আমি এইচপি ক্যাম্পে ডাক পাই। ওখান থেকে গত তিন বছর এইচপি ক্যাম্প করতেছি। আর এখান থেকেই বিসিবির কাঠামোতে আছি।’
খেলার জন্য পড়ালেখা বন্ধ করেননি শফিকুল। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছেন। আছেন শেষ বর্ষে। ক্রিকেট নিয়ে শফিকুলের স্বপ্ন অনেক বড়। বিশ্বের সেরা বোলারদের কাতারে নিতে চান নিজেকে।
চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠানো প্রশ্নের উত্তরে শফিকুল বলেন, ‘সবাই তো চায় বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতে, আমারও ইচ্ছা আছে খেলব। শুধু জাতীয় দল না বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকতে চাই। আমার পরিবারও চায় আমি একটা ভালো জায়গায় যাই। আমি যেন দেশের জন্য অনেক ভালো কিছু একটা করতে পারি। আমিও এটাই চাই।’
‘প্রথম দিকে পরিবার ওরকম সমর্থন দিত না। আসলে তখন ওরকম খেলতামও না। মোটামুটি খেলতাম বগুড়ার ভেতরে। পরে যখন রাজশাহীতে, ঢাকায় খেলা শুরু করলাম তখন পুরো পরিবারই আমাকে সমর্থন দিয়েছে।’
‘বিপিএলই একমাত্র জায়গা যেখানে অনেক দেশের অনেক খেলোয়াড় আসে। তাদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করা হয়। সবার একেকরকম খেলার প্রস্তুতি থাকে। তাদের খেলার ধরণ, মাইন্ড সেটআপ অনেক কিছুই এখান থেকে শেখার আছে। আমি চেষ্টা করি তাদের কাছ থেকে প্রতিনিযত কিছু শেখার।’
‘স্টার্কের বোলিং আগে ভালো লাগতো এখন আমির, বোল্ট। তাদের অনেক লাগে। ওদের বল ভেতরে (ইনসুইং) আসে, আমার বলও এখন ভালো ভেতরে আসতেছে। চেষ্টা করি তাদের ভালো ভালো জিনিসগুলো দেখার। তাছাড়াও আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো বোলার আছে। মোস্তাফিজ ভাই, উনার ভ্যারিয়েশনগুলো যখন খেলা হয় টিভিতে দেখি, চেষ্টা করি যতটুকু পারি শিখে নেওয়ার। তারা অনুশীলনে কী করছে চেষ্টা করি তা দেখার।’
শুধু নিজ দলের কোচ নন মিনিস্টার ঢাকার কোচ মিজানুর রহমান বাবুলের কাছ থেকেও পাচ্ছেন দরকারি পরামর্শ, ‘বিপিএল এবং প্রিমিয়ার লিগে সুজন স্যর ও বাবুল স্যর আমাকে অনেকরকম সহায়তা করেছে। বোলিং নিয়ে অনেক টিপস দিয়েছেন। পাশাপাশি মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন, যেগুলো আমার খুব দরকার ছিল। তাদের সহযোগিতা অনেক কাজে দিচ্ছে।’
‘আমি চেষ্টা করি একটা গতিতে (১৩০-১৩৫) বল করার। স্লোয়ার চেষ্টা করি আর মূল স্কিল হলো, ডানহাতিদের সামনে ইনসুইং ভালো হয় আমার। আর ডেথ ওভারে কাটারটা মোটামুটি ভালো। ইয়র্কার, ওয়াইড ইয়র্কার ট্রাই করি।’
শফিকুলের বাবা আব্দুস সোবহান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে হিসাবরংক্ষণের চাকরি করেন। মা ফিরোজা বেগম গৃহিনী। গ্রামের বাড়ি বরিশালের বরগুনায়। তবে চাকরির সুবাদে বহু আগে তার বাবা বগুড়ার বাসিন্দা। সেই থেকে বগুড়াতেই পুরো পরিবারের বসবাস। শফিকুলের ক্রিকেটে খেলার ব্যাপারে ভাইদের উৎসাহ ছিল। এখন পুরো পরিবার ও শফিকুলের নিজের চাওয়া একই।
শফিকুলকে নিয়ে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন: ‘দুই বছর ধরে শফিকুলকে আমরা এইচপি’তে নার্সিং করছি। আমরা তো ওকে আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্য তৈরি করছি। কিছু কিছু জায়গায় সে উন্নতি করেছে। বিপিএলে ঢাকাতেও ও যথেষ্ট ভালো বোলিং করেছে। কিছু ভালো খেললে বোঝা যায় এইচপির প্রগ্রেসটা কীরকম হচ্ছে। বাঁহাতি বোলারের সবচেয়ে স্পেশালিটি হলো বল ভেতরে আনা। শফিকুলের মধ্যে এই গুণটাও আছে। আমি আশা করি এভাবে যদি উন্নতির মধ্যে থাকে উপরের দিকে যেতে পারবে।’