‘ভুঁইফোড় একটি অনলাইন পত্রিকার ভিত্তিহীন সংবাদকে’ কেন্দ্র করে ফেসবুকে ‘উস্কানিমূলক’ পোস্টের মাধ্যমে একটি মহল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এএম আমজাদ। এই মহলটিকে খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন প্রক্টর।
প্রক্টর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘গত শুক্রবার একটি ভূঁইফোড় অনলাইন পত্রিকা শারিরীক শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক শওকতুর রহমান চিনুর বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে ভিত্তিহীন এক সংবাদ প্রকাশ করে। পরে ফোন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে এর ভিত্তিতে গুজব ছড়িয়ে দিয়ে উস্কানি দেয় একটি মহল।যার ফলে আমাদের কিছু শিক্ষার্থী টিএসসিতে সড়ক অবরোধ করে এবং একটি বাসে ভাঙচুর চালায়।’
‘এই মহলটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। চিহ্নিত হওয়া মাত্রই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পেছনের ইন্ধনদাতা হিসেবে কাদেরকে সন্দেহ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। আমরা চেষ্টা করছি ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করার।’
তাদের একটি বাস ভাঙচুর করার জেরে রোববার সকালে নিজেদের ক্যাম্পাসের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নবীনগর থেকে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী পরিবহন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমন্ত বাসে ভাঙচুর চালায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে আবারও টিএসসিতে জড়ো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে তাদেরকে ‘বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে’ বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ।
শিক্ষার্থীদের আন্দেলন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘অধিভূক্তকরণ বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট করার পরও তাদের কাছ থেকে এ ধরণের আচরণ দুঃখজনক।’
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম (লোগো) ব্যবহার করতে পারবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে শারিরীক শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক চিনুকে উদ্ধৃতি করে একটি সংবাদ প্রকাশ করে একটি ‘নাম সর্বস্ব’ অনলাইন পোর্টাল। খবরটি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক একাধিক ফেসবুক গ্রুপে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। ফলে শনিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে বিভিন্ন হলের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী উপাচার্যর বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে টিএসসির দিকে মিছিল নিয়ে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এসময় বঙ্গবাজার থেকে ছেড়ে আসা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাস সেখান দিয়ে যেতে চাইলে সেটিকে বাধা দিয়ে পেছনের গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে কয়েকজন উত্তেজিত শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে প্রক্টর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের ঘটনা শুনে আমি সঙ্গে সঙ্গে টিম পাঠাই। পরে টিমের মাধ্যমে ফোনে আমার সঙ্গে দুজন শিক্ষার্থীর কথা হয়। এরা হলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের সিরাজুল ইসলাম রুবেল এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের জাহিদুল ইসলাম সজীব। তাদের আমি বোঝানোর চেষ্টা করি। তারপর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলে নিজে সেখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিবৃত্ত করি। এসময় আমার সঙ্গে ছিল ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স।
শারিরীক শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন না উল্লেখ করে তিনি অভিযোগ করেন ‘সংবাদটিতে পরিচালকের বক্তব্যকে টুইস্ট করা হয়েছে।’
যেভাবে ছড়ায় গুজব
‘ফেসবুকের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছে’ প্রক্টরের এমন বক্তব্যের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক একাধিক ফেসবুক গ্রুপে অনুসন্ধান চালায় চ্যানেল আই অনলাইন। এতে দেখা যায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ এবং ‘ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, ২০১৬-১৭ সেশন’ নামে দুটি গ্রুপে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্ট রয়েছে।
‘গুজব ছড়ানো’ সংবাদের লিঙ্কটি শেয়ার দেওয়ার আগে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ৪ মিনিটে একটি পোস্ট দেন জাহিদুল ইসলাম সজীব নামে একজন। এ পোস্টে শারিরীক শিক্ষাকেন্দ্রের পরিচালক শওকতুর রহমান চিনুকে উদ্ধৃত করে তিনি লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কার্যক্রম ছাড়া অন্য যেকোন কার্যক্রমে তাদের (অধিভুক্ত কলেজগুলোর) অংশ নিতে বাধা নেই। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সার্টিফিকেট পাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়েও খেলতে পারবেন।’ ‘বিস্তারিত আসছে’ লিখে এ সংক্রান্ত আরও পোস্টের আভাস দেন। এই পোস্টের নিচে তিনি মন্তব্য লেখেন ‘ খবরটা সবাই জানানো দরকার ছিলো। ভেবেছিলাম অনেক বড় রিঅ্যাকশন আসবে। ৪০ হাজারে মাত্র ১০/১২ জন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বাকিরা চুপ। যার অর্থ নো প্রবলেম উইথ দিস।’
পরেরদিন শুক্রবার রাত ৮টা ৪১ মিনিটে জাহিদুল ‘অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরাও ঢাবির হয়ে খেলতে পারবে’ শিরোনামে আলোচিত ওই ‘সংবাদ লিঙ্কটি শেয়ার করেন। লিঙ্কটি শেয়ার দেওয়ার পরে আরও অনেকেই একই লিঙ্ক শেয়ার করে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান।
চ্যানেল আই অনলাইন নিশ্চিত হয়েছে, যে পোর্টালের লিঙ্ক শেয়ার দেওয়া হয়েছে সে পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদকও জাহিদুল ইসলাম।যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০০৬-৭ সেশনের শিক্ষার্থী।
পোর্টাল থেকে নাম্বার সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে জাহিদুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নিউজটি আমিই করেছি। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় টিমের একজন খেলোয়াড় ছিলাম। তাই অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরাও টিমে খেলতে পারবে জেনে খারাপ লাগার ফলে আমিই নিউজটি করি।’
তবে আগের একটি ঘটনা থেকেই জাহিদুল ইসলামকে ‘সন্দেহ হয়’ বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়ে প্রক্টর বলেন, ‘ কিছুদিন আগের একটি ঘটনা থেকেই জাহিদুল ইসলামকে আমার সন্দেহ হয়।গতকাল (শনিবার) টিএসসিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধের সময়ও তার সঙ্গে কথা হয় আমার।’
‘গুজব’ থেকে রাজপথে ভাঙচুর, জড়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামক ফেসবুক গ্রুপে ওই নিউজের লিঙ্ক শেয়ার দেওয়ার পরে আরও অনেকেই লিঙ্কটি শেয়ার দেয়। আলাদা পোস্টেও অনেকে এ বিষয় নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া লেখে।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ থেকে লিঙ্কটি শেয়ার হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ‘ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, ২০১৬-১৭ সেশন’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে। যে গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ৫ হাজারের ওপরে। এভাবে দুই গ্রুপেই ‘অধিভুক্ত কলেজগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম ব্যবহার এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ’ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেওয়া পোস্টে ভরে যায়। আন্দোলনের ডাকও দেয় অনেকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার সন্ধ্যায় টিএসসিতে অবরোধ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায় শিক্ষার্থীরা যার মধ্যে অধিকাংশই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রক্টর।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ ফেসবুক গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামে এ ফেসবুক গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা রোববার বিকেল পর্যন্ত ৪৩ হাজারেরও বেশি। এই গ্রুপের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন ইস্যুতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ এর আগেও ছিল এই গ্রুপ পরিচালনাকারীদের (এডমিন) বিরুদ্ধে। বিশেষ করে রাজধানীর সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তকরণের পর থেকে অনেক ভুল এবং আংশিক তথ্য ছড়ানোর নমুনা পাওয়া যায় গ্রুপের বিভিন্ন পোস্টে।
গ্রুপটিতে একটি এডমিন প্যানেল এবং মডারেটর প্যানেল রয়েছে। ছয় সদস্যের এই প্যানেলের অনুমোদন ছাড়া কেউ এই গ্রুপে পোস্ট করতে পারে না। সুতরাং তারা যে পোস্ট পছন্দ করেই কেবল সেগুলোরই অনুমোদন দেয়। এই গ্রুপকে এডমিনরা ব্যক্তিগত পরিচিতির প্লাটফরম হিসেবে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ আছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে।
ফেসবুক গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে যারা
সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামক ফেসবুক পোস্টটি চালু করলেও গত বছরের শুরুর দিকে এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। এরপর নিজেদের পছন্দ মত এডমিন এবং মডারেটর নিয়োগ করে।
এডমিন প্যানেলে রয়েছেন বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করা মোতাকাব্বির খান প্রবাস, একই বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার প্রামাণিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এসএম রাসেল। মডারেশনে রয়েছেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের এসএম রাকিব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাদমান শাকিল এবং তথ্যবিজ্ঞান এবং গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপণা বিভাগের রিমানা সেতু।
এর মধ্যে মোতাকাব্বির খান প্রবাস বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ‘কটুক্তির’ জেরে কাস্টম কর্মকর্তা সুশান্ত পালের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার বাদীও প্রবাস। এছাড়া সাদমান শাকিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক।