মানুষ হিসেবে নিজেকে আমি বোকাসোকা ক্যাটাগরিতে ফেলি, এর কারণ হিসেবে বলতে পারি নিজের যাপিত জীবনের দৃশ্যচিত্র যদি রিউয়াইন্ড করি তাতে নানা রকম ভুল এবং বোকামি দেখতে পাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সকল ভুল বা বোকামিগুলো পঁয়তাল্লিশ বছরে প্রান্তে দাঁড়িয়ে খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি।
আমার বয়স তখন খুব সম্ভব পাঁচের কাছাকাছি, আন্দাজ নয় ছোট বোনের জন্মের তারিখ হিসেব করেই বলছি। সেই সময়েই শহুরে বাচ্চাদের গুঁড়ো দুধের উপর নির্ভরশীলতা শুরু হয়। আমার নবজাতিকা ছোট বোনের জন্য নানা ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধের কৌটা তখন আমাদের বাসার তাকে শোভা পেত। আমার ধারনা আমি একা নই অনেকই ছোটবেলায় আমার মতো এই গুড়ো দুধের ভক্ত ছিলেন। লুকিয়ে গুঁড়ো দুধ মুখে পুরে নিয়ে আমি মাঝে মাঝে দীর্ঘসময় থাকতাম। চেষ্টা করতাম যাতে কথা বলতে না হয়,কথা বললেই যে রহস্য প্রকাশ পেয়ে যেতো। লুকিয়ে খেতে হতো বা আরো প্রিসাইসলি বললে বলতে হয় চুরি করে খেতে হতো কারণ এই মূল্যবান দুধ ছিলো শুধু আমার নবজাতিকা বোনের জন্যই। কিছু দুধ ছিলো চিনি ছাড়া কিন্তু আমার বোনের জন্য তখন যেটা বাসায় আসতো তাতে মিহিদানার চিনির অস্তিত্ব ছিলো, তাই এর স্বাদ ছিলো বেহেশতি। সেই কৌটায় সুন্দর গোলগাল একটা প্লাস্টিকের ছোট্ট চামচ থাকতো। আমি সুযোগ খুঁজতাম কখন কারো অনুপস্থিতিতে সেই কৌটা খুলে সন্তর্পণে এক চামচ দুধ মুখে পুড়তে পারবো।
এক দুপুরে মা যখন ভাত ঘুমে ব্যস্ত, আমি কোন শব্দ না করেই রান্না ঘরের দুধের কৌটা সাজিয়ে রাখা তাকের কাছে পৌঁছে গেলাম। তাক বেশ খানিকটা উঁচু যা আমার নিজের উচ্চতা সীমার বাইরে, উচ্চতার সমস্যা সমাধানের জল চৌকি নামক চার পেয়ে কাঠের উঁচু পিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নামিয়ে নিলাম আমার আরাধ্য কৌটা। কোন রকম শব্দ না করেই খুলে ফেললাম কৌটার মুখ। সেকি ! এতো কম কেন ? গতকালও ছিলো প্রায় পূর্ণ কৌটা, তাছাড়া সেই গোলগাল প্লাস্টিকের চামচই বা কই? অত ভাবার সময় নেই, হাত ডুবিয়ে মুঠো করে নিয়ে চালান করে দিলাম এক মুঠো।
আমার চিৎকারে মা তো ঘুম থেকে দৌড়ে এলেনই, পাশের বাসার খালাম্মা (তখনো আন্টির যুগ চালু হয়নি) পর্যন্ত চলে এলেন। ঘটনা আর কিছু নয়, আমার মা অন্য অনেকের মতো দুধের খালি কৌটা ফেলে বা বিক্রি না করে তা রান্না ঘরে রান্নার এবং অন্যসব ব্যবহার্য উপকরণ রাখার কাজে ব্যবহার করতেন। দুধের কৌটায় দুধ ভেবে আমি যা মুখে দিয়েছিলাম, তা ছিলো আসলে কাপড় কাচার সোডা।
আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র, বাস করি তখন পুরনো ঢাকায়। কোন এক বিচিত্র কারণে তখন আমার বন্ধুদের প্রায় বেশিরভাগই ছিলো আমার চাইতে বয়সে অনেক বড়। এই বন্ধুদের জীবন বিচিত্র গতি পেয়েছিলো পরবর্তীতে। সেই বন্ধু দলে ছিলো ঘটি বাবু (শীলা হত্যা মামলায় ফাঁসির আসামি ), নাদের (১৯৮৭ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত), রমজান (সায়দাবাদ টার্মিনালের দখল নিতে যেয়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত),কাজল ভাই (এখন স্টেটসের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা শিক্ষক), টুটু বা টুইট্যা নামের বন্ধু যে ছিলো “মহা প্রেমিক”। উপরের সব বন্ধুর প্রেম ঘটিত বিষয়ে আমার একটা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। বয়সে ছোট হলেও কোন এক বিচিত্র কারণে আমি খুব সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারতাম এবং সেই চিঠি প্রাপকদের বাবা মা বা গুরুজনদের এড়িয়ে প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিতাম। বিনিময়ে আমি পেতাম কখনো মানিক নগরের খাসির চাপ, গোলাপ বাগের কাঞ্চনের তোহারি, অথবা সিদ্দিক বাজারের তন্দুর নেহারি। একবার অভিসার সিনেমা হলের উপরের চাইনিজে একটা ট্রিটও পেয়েছিলাম।
বাদ দিলাম খাওয়ার গল্প। কিন্তু বাদ দিলে হবে কিভাবে, আমি কেন এইসব বড় ভাইদের প্রেমের গোয়েন্দা, সহকারী থেকে পরিচালকের পদ নিলাম তার রহস্য এই খাওয়ায়। কেউ আমাকে ভাল কিছু খাওয়ানোর কথা বললে আমি প্রায় গলে গিয়ে তার কাজ করে দিতাম। অনেকেই বলতে পারেন কুকুর স্বভাব। ঠিক তাই, অভাবের সাথে আপনার পরিচয় হয়তো নেই, তাই ভাল খাবারের লোভ আপনি টের পাননা, আমি পেয়েছিলাম আমার শৈশব এবং কৈশোরে। শিবের গীত বন্ধ চলুন গল্পে ফিরি।
টুইট্যা নামের সেই বয়সে বড় বন্ধু প্রেম করতো বীণা নামের এক মেয়ের সাথে। বীণার চার ভাই তখনকার টিকাটুলি থেকে ধলপুর পর্যন্ত এলাকার ঘুম হারাম করা ত্রাস। সেই ত্রাস ভাইদের বোনের সাথে টুইট্যার গভীর প্রণয় যখন শুধু চিঠি আদান প্রদানের সীমায় আটকে থাকতে রাজি নয়, তখন আমার উপর নির্দেশ এলো কি করে দেখা করা যায় তার ব্যবস্থা করার। সফল হলে চাংপাই নামের খুব এক দুর্দান্ত রেস্তোরায় আমার খাবারের ব্যবস্থা হবে।
চাংপাই তখন আমার মতো খাদ্য রসিকের জন্য মঙ্গলগ্রহ। সাধ্যের অতীত কিন্তু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা শতভাগ। এমন সুযোগ হেলায় হারানো অসম্ভব। শুরু করে দিলাম কাজ । মাস দুয়েকের চেষ্টায় ব্যবস্থা করে ফেললাম একটা দেখা করার। কিভাবে তা বলার দরকার দেখিনা। সেই ব্যবস্থা এমন, দেখা হবে বীণার বাসায়, তার বড় ভাবির উপস্থিতিতে যখন বীণার কোন ভাই থাকবেনা বাসায় বা এলাকাতে। টুটুকে সব জানালাম। বীর পুঙ্গব বীণার বাসায় যেতে হবে শুনেই কেমন মিইয়ে গেলেন। আমি নানাভাবে তাকে উদ্দীপ্ত করে রাজি করালাম। তবে শর্তহীন নয় ।শর্ত আমাকেও সাথে যেতে হবে।
শুভ সময়ে আমরা দুইজন উপস্থিত হলাম বীণাদের ড্রয়িং রুমে। এক দিকের সোফায় আমি আর টুটু, আরেক দিকে ভাবি আর বীণা মাঝে একটা সেন্টার টেবিল। সেই টেবিলে নানা রকম ফল এবং মিষ্টি। সৌজন্য কথা বার্তার পর বীণার ভাবি টুটুর পরিবারের খোঁজ খবর নিচ্ছেন তো নিচ্ছেনই। বীণাও ব্যস্ত কথা বলায়। ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে, কেউ নিজেরা কিছু খাচ্ছেনা আবার আমাকেও খেতে বলছেনা। এতোসব উপাদেও খাবার সামনে নিয়ে ক্ষুধায় বসে আছি কিন্তু কৈশরের লজ্জা এবং আরোপিত সামাজিক শিষ্টাচারের খাতিরে খেতেও পারছিনা।
টেবিলে রাখা রসগোল্লা, হট প্যাটিস,আপেল আর দুই রঙা সন্দেশ আমায় যেন হাতছানি নয়, চিৎকার করে আহ্বান জানাচ্ছে উঠিয়ে নিতে, কিন্তু সঙ্কোচে পারছিনা। বিশেষ করে দুই রঙা সন্দেশ যা স্কুলে যাতায়তের পথে নিত্য দেখি কনফেকশনারির কাঁচের আড়ালে সাজানো, তা আজ আমার জিভের মাত্র কয়েক ফুট দূরে থাকার পরেও স্বাদ নিতে পারছিনা, এ যে কি নরক যন্ত্রণা, খাদ্য রসিক মাত্রই বুঝবেন।
দয়াময় যেন আমায় দয়া করলেন। বুঝলেন এই অভাগার প্রাণ না গেলেও চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে, আত্মা কষ্ট পাবে এক্ষুনি এই সন্দেশ না গিলতে পারলে। দয়াময় তার কারসাজীতে সারা এলাকা অন্ধকার করে দিলেন। বিদ্যুৎহীন হতেই মুহূর্ত দেরিনা করেই চালান করে দিলাম আস্ত একটা সন্দেশ। মুখে দেয়ার সাথে সাথেই যেন আমার মুখের ভেতর আমি তখনকার সায়দাবাদ ময়লার ডিপোর অস্তিত্ব টের পেলাম। আমার নাড়িভুঁড়ি যখন বের হবার উপক্রম এবং আমি মুখের ভেতর থেকে সেই আজাব ফেলে দেয়ার জন্য উদ্যত, ঠিক সেই সময় দয়াময় তার দয়া আমার উপর থেকে উঠিয়ে নিয়ে শাস্তি দিয়ে মুহূর্তেই চারধার উজ্জ্বল আলোয় ভরে দিলেন। মুখের মধ্যে সেই ময়লার ডিপো নিয়ে আমি না পাড়ছি গিলতে না পাড়ছি উগরাতে। সামনে দুইজন রূপবতী নারী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং তাদের মুখভাব বলে দিচ্ছে তাদের একটাই প্রশ্ন, “এই আহাম্মকের হইছেটা কি?”
এক ক্ষুধার্তের সঙ্গে সেটা ছিলো প্রকৃতির এক নির্মম রসিকতা। রসিকতাইতো, নইলে সারা শহরে সবাই যখন দুই রঙা সন্দেশ পায়, তখন আমার ভাগ্যে কেন পরবে দুই রঙা পুরনো ঢাকার বিখ্যাত জনপ্রিয় রথখোলার পনির, কিন্তু ভাগ্য দোষে প্রায় পচে যাওয়া।