রেফারি কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু। আমাদের সোনালী ফুটবল যুগের এক অনন্য নাম। ফুটবল ইতিহাসের পাতায় যে নামটি লেখা আছে স্বর্ণাক্ষরে। তারকাখচিত এক রেফারি হিসেবে তিনি অনন্য-অমর হয়ে আছেন।
আশির দশকে ফুটবলের বাধভাঙ্গা জনপ্রিয়তার কালে মোহামেডান-আবাহনীর হাইভোল্টেজ ম্যাচ সবচেয়ে বেশি পরিচালনা করেছেন তিনিই। প্রতিবারই যশোর থেকে এসে তিনি ম্যাচ পরিচালনা করতেন। সেসময় আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যেকার ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করাটা ছিল রেফারিদের কাছে সবচেয়ে দূরহ-দুঃসহ কঠিন এক কাজ।
মাথার উপর দর্শক-সমর্থকদের এতোটা কঠিন চাপ থাকতো যে একটু ভুল হলে মাঠে বড় ধরনের অঘটন ঘটতে সময় লাগতো না। কিন্তু পাহাড়সম উত্তেজনা ও চাপ জয় করে রেফারি কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টুই বারবার আস্থার প্রতীক হিসেবে খ্যাত হয়ে উঠেছিলেন সেসময়।
রেফারি কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু মাঠে বরাবরই পেশাদারিত্বকেই উর্ধ্বে তুলে ধরে দৃঢ়তার সাথে ম্যাচ পরিচালনা করতেন। ফুটবলের সেই স্বর্ণালী দিনে আস্থা আর বিশ্বাসে তিনি ছিলেন সবার উর্ধ্বে। সেই আস্থা ও বিশ্বাসের মর্যাদা তিনি বারবার পেয়েছেন বাফুফের কাছ থেকে। আর তাই মোহামেডান এবং আবাহনীর মধ্যেকার বেশিরভাগ উত্তেজনাময় ম্যাচই তিনি পরিচালনা করেছেন। নিজ বাসভূমি যশোর থেকে মোহামেডান-আবাহনীর মধ্যেকার ম্যাচ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব নিয়ে বারবার উড়ে এসেছেন তিনি। দর্শক সমর্থকদের পাহাড়সম চাপ স্বত্ত্বেও তিনি কখনই মাঠে নিয়ন্ত্রণ হারাননি।
৮৭ সালে আর্মি স্টেডিয়ামে দর্শকবিহীন আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যে যে ম্যাচটি হয় সেটিও তিনি পরিচালনা করেন। এ ম্যাচে তার সহকারি ছিলেন এম আর মুকুল এবং নাজির হোসেন। অনেকেরই মনে থাকার কথা এই ম্যাচের আগে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যেকার ম্যাচটি ফুটবলের নিয়ম কানুন উপেক্ষা করে দু’দলের অধিনায়ক আসলাম এবং রঞ্জিত নিজেরাই যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে।
আবার ৮৬ সালে আরও একটি উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচের অনন্য সাক্ষী আনসারুল ইসলাম মিন্টু। মোহামেডান ও আবাহনীর মধ্যেকার উত্তেজনাপূর্ণ এই ম্যাচের দিন সকালে ভারত থেকে আবাহনী শিবিরে এসে যোগ দেয় কলকাতা লীগের সেই সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্ট্রাইকার চিমাও কেরি এবং গোলরক্ষক ভাস্কর গাঙ্গুলি। ঢাকা স্টেডিয়ামে দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ এ ম্যাচে ২-০ গোলে জয়লাভ করে মোহামেডান ক্রীড়া চক্র। মোহামেডানের পক্ষে স্ট্রাইকার মনু এবং ইলিয়াস গোল করেন। এই ম্যাচ পরিচালনার পর ফুটবল ফেডারেশন কর্তৃক সেরা রেফারি নির্বাচিত হন আনসারুল ইসলাম মিন্টু । ঐ বছরই তিনি বাংলাদেশ ত্রীড়া লেখক সমিতির পুরস্কার পান।
আনসারুল ইসলাম মিন্টুর রেফারি জীবনে এরকম অনেক চ্যালেঞ্জময় ম্যাচের গল্প রয়েছে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও তিনি অনেক ম্যাচ পরিচালনা করেন। পাকিস্তান, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে ফিফার আমন্ত্রিত রেফারি হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন তিনি। ফিফা স্বীকৃত এই রেফারি ৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্নাঢ্য রেফারি জীবনের সমাপ্তি টানেন। তবে ভুলে যাননি ফুটবলের বর্ণময় স্মৃতি।
ঢাকা স্টেডিয়ামে লাখো দর্শকের ভীড়, চিৎকার-চেঁচামেচি, আবার বাঁশির এক ফুঁতে একপাশের গ্যালারিতে নীরবতা তো অন্য গ্যালারিতে আনন্দ-উল্লাস-এসবের কোনো কিছুই ভুলে যাননি। এখনও রেফারি জীবনের সেই গল্প, বিগম্যাচ পরিচালনার চ্যালেঞ্জ আর ফুটবলের মারকুটে দর্শকদের কথা মনে করে তিনি স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান। ফুটবলের আবেগ উত্তেজনাময় কালের অনেক ঘটনার সাক্ষী তিনি।
কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু পেশাদার রেফারি হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে যশোর মাঠের ফুটবলার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই যশোর লীগে নিয়মিতভাবে যশোর কালেক্টরেট ও যশোর টাউন ক্লাবের পক্ষে খেলতে শুরু করেন। ফুটবল খেলতে খেলতে একসময় সিদ্ধান্ত নেন রেফারি হিসেব আত্মপ্রকাশ করবেন। এই আকাঙ্খা একসময় যশোরের বাল্যবন্ধু আতাউল হক মল্লিকের কাছে ব্যক্ত করেন।
আতাউল হক মল্লিক ততদিনে যশোর থেকে এসে ঢাকা ফুটবল লীগে খেলা পরিচালনা শুরু করেছেন। ৭৫ সালের কোনো এক সময়ে ঢাকাতে বাংলাদেশ রেফারিজ এসোসিয়েশন নতুন রেফারি তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। আতাউল হক মল্লিকের অনুপ্রেরণায় রেফারি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন আনসারুল ইসলাম মিন্টু। প্রশিক্ষণে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে তৃতীয় গ্রেডের রেফারি হিসেবে স্বীকৃত হন।
প্রশিক্ষণ শেষে যশোরে এসে নিয়মিতভাবে স্থানীয় পর্যায়ের ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করতে থাকেন। এরপর ৭৬ সালে তিনি দ্বিতীয় গ্রেডের রেফারি হিসেবে স্বীকৃত হন। এর মাত্র একবছর পরেই ৭৮ সালে প্রথম শ্রেণীর রেফারিতে উত্তীর্ণ হন। বলা যায় এরপরই তার রেফারি জীবনের ভাগ্য দরজা খুলে যায়। ঐ বছরই তার ডাক পড়ে ঢাকা ফুটবল লীগে খেলা পরিচালনার জন্যে।
প্রথমে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব এবং ওয়ারির মধ্যেকার একটি ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পান। ঢাকায় জীবনের প্রথম ম্যাচে সহকারি হিসেবে পান রেফারি মহিউদ্দিন এবং আব্দুর রশিদকে। তখন রেফারিজ এসোসিয়েশনের সভাপতি জেড আলম আর সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। প্রথম ম্যাচ পরিচালনা করে সম্মানি হিসেবে তিনি মাত্র ১৫০ টাকা পান।
ঐ ম্যাচে যশোরে দৃই কৃতি ফুটবলার সাথী ও কালামও খেলেন। এর এক বছর পরেই তুলনামূলক বড় ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পান তিনি। জনপ্রিয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং ওয়ারি ক্লাবের মধ্যেকার ম্যাচ পরিচালনার মধ্যে দিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেন।
তবে ৮৪ সালে হঠাৎ করেই তার জীবনে আসে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। ঐ বছর অভিজ্ঞ সব রেফারিদেরকে বাদ দিয়ে তার উপর আসে মোহোমেডান ও আবাহনীর মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব। সে সময় মোহামেডান এবং আবাহনীর ম্যাচ মানেই সারাদেশ জুড়ে এক অসীম উত্তেজনা। গ্যালারিতে বসা রক্ত টগবগ হাজার হাজার মারকুটে দর্শকদের চাপ মাথায় নিয়েই রেফারিদের খেলা পরিচালনা করতে হতো। কিন্তু ঐ ম্যাচ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে যেনো অমরত্ব লাভ করেন তিনি।
উল্লেখ্য যে, এই ম্যাচ খেলার মধ্যে দিয়েই ফুটবল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন ফুটবলের কিংবদন্তী কাজী সালাহউদ্দিন। এই ম্যাচে বাদল রায়ের গোলে জয়ী হয়েছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। তবে এই ম্যাচের আগেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবাহনী ক্রীড়া চক্র।
এই ম্যাচের কথা স্মরণে এনে কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু বলেন, ‘আমি তখন যশোরে। হঠাৎ করেই রেফারিজ এসোসিয়েসন থেকে আমাকে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলা হলো। পরের দিন মোহামেডান-আবাহনীর মাঠ কাঁপানো ম্যাচ। আটজন রেফারি রয়েছেন প্যানেলে। কার উপর কী দায়িত্ব আসছে কারো জানা নেই। খেলা শুরু হওয়ার একটু আগে জানতে পারলাম গুরু দায়িত্বটা আমাকেই দেওয়া হয়েছে। আব্দুল আজিজ আর জহুরুল হককে সাথে নিয়ে আমি সফলতার সাথে ম্যাচটি পরিচালনা করি।’
৮৩ সালে কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পান। সে বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে মোট চারটি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন কলকাতা মোহামেডান এবং চায়নার একটি ক্লাবের মধ্যেকার খেলা। ৮৫ সালে তিনি পাকিস্তানে যান কায়েদা আজম ট্রফি ম্যাচ পরিচালনার জন্যে। এ টুনামেন্টে মোট ৩টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। ক্যারিয়ারে ১০টির মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন আনসারুল ইসলাম মিন্টু । ৮৭ তে ভারতে অনুষ্ঠিত সার্ক ফুটবলে ৩টি ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন। ফাইনাল ম্যাচেও রেফারি ছিলেন তিনি। ফাইনালে ভারত ১-০ গোলে নেপালকে পরাজিত করে।
কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু যশোরের মানুষ। যশোর শহরের ঘোপ এলাকায় তার বেড় ওঠা। এখনও ঘোপ এলাকাতেই থাকেন। রেফারি জীবনের সোনালী সময়ের কথা স্মরণে এনে তিনি আনসারুল ইসলাম মিন্টু বলেন, ‘যতদিন মাঠে বাঁশি হাতে দাঁড়িয়েছি ততদিনই নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কাার থেকেছি। দৃঢ়তার সাথে প্রতিটি ম্যাচ প্রতিদ্ব›দ্বীতাপূর্ণ করতে স্বচেষ্ট থেকেছি। প্রতিটি সিন্ধান্তই বিচক্ষণতার সাথে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
স্মৃতি হাতড়িয়ে বলেন, সে সময় অনেকে মনে করতেন আমি হলাম ‘মোহামেডান ফেভারিট রেফারি’। বিশেষ করে আবাহনীর সমর্থকেরা এমনটিই মনে করতেন। কিন্তু সেই ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি।
তিনি বলেন, ৮৮ সালে মোহামেডান-রহমতগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মোহামেডান কোনোভাবেই গোল পাচ্ছিল না। একসময় মোহামেডানের খেলোয়াড়রা একেবারে অর্ধৈয্য হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় খেলার শেষপ্রান্তে ইরানি ফুটবালার নালজেগার ফাউল করে। আমি লালকার্ড বের করি, নালজেগার মাঠের বাইরে চলে যায়। লালকার্ড দেখানোর পরে সে কী উত্তেজনা মাঠ জুড়ে। শেষপর্যন্ত ঐ ম্যাচে মোহামেডান ড্র করে। মনে আছে সেদিন আবাহনীর অনেক সমর্থকেরই আমার সম্পর্কে ভুল ভাঙে।
আশির দশকের দেশের সেরা তারকা ফুটবালদের কাছ থেকে দেখেছেন আনসারুল ইসলাম মিন্টু। সবার খেলা এখনও তার চোখে ভাসে। কাজী সালাহউদ্দিন, আসলাম, বাদল রায়, সালাম, চুন্নু, বাবুল, জনি, মুন্না, রঞ্জিত, রুমি, মনু-সবার খেলাই তার মুখস্ত। আসলামের গোল করার দক্ষতা এখনও তাকে টানে। বলেন, ওর ব্যক্তিগত স্কিল ততোটা উঁচুমানের ছিল না। কিন্তু ডি-বক্সের হিরো আসলাম। গোল কীভাবে করতে হয় ভাল জানতো। মুন্না মেজাজি হলেও কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করেনি। ফাউল করার পরও বল নিজ হাতে তুলে আনতো। কাজী সালাহউদ্দিন, বাদল রায়, চুন্নু, বাবুলের সেই আন্তরিক আচারণ এখনও মনে দাগ কেটে আছে।
আনসারুল ইসলাম মিন্টুর বর্তমান বয়স ৭৫। যশোরের ঘোপ এলাকায় নিজের বাড়িতে থাকেন। দুই সন্তানের জনক তিনি। তার দুই ছেলে কাজী ইমরান ওয়াহিদ ও কাজী এরফান ওয়াহিদ। স্ত্রীর নাম সাবিনা ইসলাম। জীবনের প্রান্তবেলাতেও ফুটবল তাকে টানে। যশোরে কোনো টুর্নামেন্ট হলে এখনও চলে যান মাঠে। যশোরের বেশ কয়েকজন তরুণ রেফারি তারই হাতে তৈরি।
দেশের বিবর্ণ ফুটবল দেখে অনেকের মতো তারও মন খারাপ হয়। বলেন, ‘যে ফুটবলের আমরা সাক্ষী, তার কিছুই এখন নেই। ফুটবলে সেই সোনালী দিন ফিরে আসুক এটিই কাম্য’।
সম্প্রতি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য ৮৮ জন ক্রীড়ব্যিক্তিত্বের নাম ঘোষিত হলেও সেখানে নেই কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টুর নাম। অথচ জীবদ্দশাতেই এই পুরস্কার দিয়ে তাকে আমরা সম্মানিত করতে পারতাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)