ফিলিপিনো ভোটাররা বেশ কয়েকটি আসনে প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে যাচ্ছে ৯ মে। তবে ২০১৬ সালের পর প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের পর কে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আগামী ৬ বছর এই আসনে বসতে যাচ্ছে, তা সবচেয়ে বড় আগ্রহের বিষয়।
সেদেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে মিথ্যে এবং ভুল তথ্য ছড়ানোর খেলা। নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখলে নিয়ে নিয়েছে সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং বিভাগ। কীভাবে কাজ করে যাচ্ছে এই বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর তা জানা যায় বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে।
জন (ছদ্ম নাম) যে নিজেকে এই বিভাগের একজন বলে দাবি করে, তার ভাষ্যমতে, ‘সে নিজেকে ট্রল (ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনাকর, অপ্রাসঙ্গিক, আপত্তিকর মন্তব্য বা অন্যান্য বিঘ্নকারী সামগ্রী পোস্ট করে অনলাইনে অন্যদের বিরোধিতা করা) হিসেবে গণ্য করে কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে বলতে গেলে সে একজন সোশাল মিডিয়া কনসালটেন্ট।’
সে জানায়, নিজের ক্লায়েন্টকে সেবা দিতে বেশিরভাগ দিন একটানা ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করছেন, তার ক্লায়েন্টদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং তাদের প্রচারণার সুবিধার জন্য শত শত ফেসবুক পেজ এবং ভুয়া প্রোফাইল পরিচালনা করছেন তিনি।
জন বলেন তার গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে গভর্নর, কংগ্রেসম্যান এবং মেয়রও।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং ভুয়া তথ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দুতার্তেও এসব মিথ্যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতায় এসেছিলো। তারপর থেকে এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বরং এবার তা আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
ডিসইনফরমেশন সিস্টেম:
জন এই ডিসইনফরমেশন ইকোসিস্টেমেরই অংশ। তিনি বলেন, তার প্রায় ৩০টি ‘ট্রল’ তার জন্য সরাসরি কাজ করে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য হল তাদের ক্লায়েন্টদের সমর্থন বাড়াতে কাজ করা, এ কাজের জন্য মিথ্যা ছড়াতেও আপত্তি নেই তাদের।
বছরের পর বছর ধরে এই রাডারের অধীনে কাজ করা জন কীভাবে তার ক্লায়েন্টের প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলে সেই অতীত অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘২০১৩ সালে আমি যে প্রদেশগুলো নিয়ে কাজ করছিলাম সেগুলোর একটিতে আমরা মিথ্যে খবর ছড়িয়ে দেই। সেখানে আমরা শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদের ফোন নম্বর জোগাড় করি এবং ফটোশপ করি, তারপর তার নাম্বার থেকে একটি টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে লিখি ‘তিনি একজন উপপত্নী খুঁজছেন’। যার ফলাফল, আমার ক্লায়েন্ট জিতে যায়।’
জন অন্য একটি কৌশল ব্যবহার করেন, যা হলো অরাজনৈতিক পেজ এবং গ্রুপ তৈরি করা যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রচারণাকে মুখ্য করে তোলে।
ফেসবুকের মালিক মেটা বলছে তারা ফিলিপাইনে মানুষকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করায় বেশ কয়েকটি নেটওয়ার্ককে বাতিল করে দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে চারশ’টিরও বেশি অ্যাকাউন্ট, পেজ এবং গ্রুপ৷
ওপেন সিক্রেট:
একটি ফিলিপিনো নিউজ চ্যানেলের সাক্ষাত্কারে, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী লেনি রব্রেডো বলেন ভুয়া খবরের সমস্যা সম্পর্কে তার প্রাথমিক পদ্ধতি ছিলো তা উপেক্ষা করা। কিন্তু এটি কাজ করেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি বলেন, বারবার বারবার বলা মিথ্যা সত্য হয়ে উঠে।
আরেকজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী প্রাক্তন বক্সার ম্যানি প্যাকিয়াও ভুয়া এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলেছেন।
“আমরা যা দেখছি তা হল একটা প্ল্যাটফর্ম, ফ্যাক্ট-চেকার এবং শিক্ষাবিদদের মধ্যে একটি ইঁদুর, বেড়ালের খেলা।যা এই ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য অপারেটরদের শনাক্তকরণ করার উপায় খুঁজছে যেখানে সেই অপারেটররা তা থেকে নিজেদের উদ্ধার করার উপায় বের করে নিয়েছে” বলে জানান জোনাথন কর্পাস ওং, একজন সহযোগী হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং ডিসইনফরমেশন গবেষক।
ওং দাবি করেন এই বিষয়গুলো এখন একটি “ওপেন সিক্রেট” অর্থাৎ এই ব্যক্তিগুলো কারা, এমনকি তাদের অর্থ প্রদান করা সবকিছুই সকলের জানা।
সমন্বিত আচরণ:
তবে ফিলিপাইনে এসব ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আইনজীবী, গির্জার নেতা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণমাধ্যম সংস্থাগুলোর একটি দল রয়েছে।
বিবিসি ডিসইনফরমেশন জোটের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ভেরা ফাইলস-এর প্রধান ফ্যাক্ট-চেকার, সেলিন স্যামসন, ফ্যাক্ট-চেকিং কোয়ালিশন টিসেক.পিএইচ-এর অংশ এবং একজন আইনজীবী টনি লা ভিদা’র সাথে এসব বিষয়ে কথা বলেন।
তারা উভয়ই সমন্বিত আচরণের সম্ভাব্য লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। এই লক্ষণগুলো হলো প্ল্যাটফর্ম জুড়ে একাধিক পেজ থেকে বারবার পোস্টগুলো শেয়ার করা এবং একটি কঠোর টাইম-ফ্রেমের মধ্যে এগুলো আপলোড করা।
এই বছরের শুরুর দিকে, টিসেক.পিএইচ একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এবং ভোটের সামনের সারিতে থাকা ফার্দিনান্দ ‘বং বং’ মার্কোস জুনিয়র ভুয়া খবরের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী, এবং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, লেনি রোব্রেডো, এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
মার্কোস সিনিয়র ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটির শাসনে থাকাকালীন ব্যাপক বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং বিরোধীদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ৭০হাজার জনকে কারাবন্দী, ৩৪হাজার জনকে নির্যাতন করা হয় এবং ৩হাজার ২৪০জনকে হত্যা করা হয়েছিলো সে সময়ে।
স্যামসন বলেন ২০২১ সালে নির্বাচন-সম্পর্কিত যতো বিভ্রান্তিকর তথ্য যাচাই করা হয় সেগুলোতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে বং বং মার্কোসকে সমর্থন করে এবং তার পরিবারকে সমর্থন করে কন্টেন্টের ব্যাপক ছড়াছড়ি। যেখানে তার বাবা কখনোই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেননি বলে প্রচার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, কিছু কন্টেন্টে অযৌক্তিক বিবৃতি দিয়ে বিরোধী প্রার্থী রব্রেডোকে আক্রমণ হয়।
ফ্যামিলি রিব্র্যান্ডিং:
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ব্রিটানি কায়সার ২০২০সালে ফিলিপাইনের নিউজ আউটলেট র্যা পলারের সাথে একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “ফ্যামিলি রিব্র্যান্ডিং” করার জন্য ২০১৬সালে মার্কোস জুনিয়র তার কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। বং বং মার্কোসের একজন মুখপাত্র সেই সময়ে এই দাবিগুলোকে অস্বীকার করে বলেছিলেন, এসব মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য।
অথচ এই বছরের শুরুতেই টুইটার ঘোষণা করছে তারা স্প্যামের নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য বং বং মার্কোসের প্রচারকারী শত শত অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে দিয়েছে।
প্ল্যাটফর্মগুলো উদ্যোগ কি যথেষ্ট?
জনের ভাষ্যমতে, তার এক বন্ধু এ বছরের নির্বাচনের একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য ভুয়া তথ্য ছড়াতে তার সাহায্য চায়, যা সে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানায়।
জন কে সেই প্রার্থী তা নিশ্চিত না করলেও এটুকু জানায় যে সে প্রার্থী বং বং মার্কোস নয়।
টুইটার এবং ফেসবুক ছাড়াও ইউটিউব জানিয়েছে তারা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ এর জানুয়ারি পর্যন্ত ফিলিপাইনের আপলোড করা ৪ লাখেরও বেশি ভিডিও সরিয়ে নেয়।
তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, ভুয়া পেজ, কন্টেন্ট সরিয়ে ফেলার মতো এসব উদ্যোগ কি এই সমস্যা নির্মূল করতে যথেষ্ট?
সামসোন বলেন, এসব ভুয়া তথ্য তৈরি করতে যে সময় লাগে তার চেয়েও বেশি সময় লাগে তা যাচাই করতে এবং সরিয়ে ফেলতে।