পশ্চিমা বিশ্বে ফাস্টফুডকে রসিকতা করে বলে, আলসে খাবার। আধুনিক জীবনে ইঁদুর দৌড়ে যারা হাঁপিয়ে ওঠেন, তারাই সময় বাঁচাতে বেছে নেন ফাস্টফুড। এই গড্ডালিকায় আমরাও অনেক আগে গা ভাসিয়েছি। নব্বই দশকেও রাজধানীজুড়ে এত এত ফাস্টফুড দোকানের মিছিল ছিল না। এখন শুধু বড় নয়, শিশুদের কাছেও ফাস্টফুড যেন বহুল কাঙ্ক্ষিত খাবার।
ফাস্টফুডে ঝক্কি নেই। রান্নার ঝামেলা নেই। অর্ডার দিলেই ঝটপট টেবিলে হাজির। খেতেও মন্দ নয়। শিশুদের খাওয়াতে অভিভাবকদের যে কুরুক্ষেত্র রচনা করতে হয়, তারচে ফাস্টফুড তো বেজায় ভালো। চিকেন-বিফ বার্গার, স্যান্ডউইচ, গরম তেলে ভাজা ফ্রেঞ্ছফ্রাই, সেইসাথে রকমারি সস শিশুদের কাছে যেন অমৃত। উফ! কোল্ড ড্রিঙ্কসের কথা তো ভুলেই গেছি। কোনো কোনো শিশু প্রতিদিন আবার কেউ সপ্তাহে এক-দুবার ফাস্টফুডের
স্বাদ নেন।
এতে অসুবিধা কোথায়? অনেক অভিভাবককে একটু আদুড়ে গলায় অভিযোগ করতে শোনা যায়, বাচ্চারা একটু আধটু এমন খাবেই। এত চিন্তার কী আছে? বিশ্বজুড়ে এমন মা-বাবার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা। গবেষকরা বলেন, ফাস্টফুডে আছে মাত্র ৩% পুষ্টিগুণ। এত টাকা খরচ করে মাত্র একরত্তি পুষ্টি! চেঞ্জিং ডায়াবেটিক ইন চিলড্রেন (সিডিআইসি)- এর পরিচালক ড. বেদুরা জাবিন আরও খোলসা করে বলেন, ফাস্টফুডে আছে উচ্চমাত্রার ক্যালরি, চর্বি, সম্পৃক্ত চর্বি, চিনি ও লবণ। সব মিলিয়ে এর পুষ্টিগুণ নেই বললেই চলে।
শিশুদের স্বাদগ্রন্থির গঠন এমন যে, চর্বি, চিনি ও লবণযুক্ত খাবার তাদের বেশি ভালো লাগে আর ফাস্টফুডে তো এসব ষোলোআনায় ভরপুর। এছাড়া ফাস্টফুডে রয়েছে এমন কিছু উপাদান যা ব্রেইনে এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে। ইচ্ছে করলেই তাই ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা যায় না। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ফাস্টফুড গ্রহণ করে, তাদের ডায়াবেটিস টু, হৃদরোগ, হাইপারটেনশন, স্ট্রোকসহ কয়েক ধরণের ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শিশুদের মুটিয়ে যাবার অন্যতম কারণও ফাস্টফুড।
সম্প্রতি শিশুদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আরেকটি গবেষণায় পাওয়া গেছে আরও চমকপ্রদ তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, যেসব শিশুর ফাস্টফুডে আসক্তি আছে, তাদের বুদ্ধিবিকাশ স্বাভাবিক নয়। একাডেমিক পড়াশোনায় তারা মনযোগী নয়। নিয়মিত ফাস্টফুড গ্রহণকারী শিশুদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, তারা সবাই স্কুলে অংক, বিজ্ঞান এবং মুখস্থবিদ্যায় দুর্বল।
গবেষকরা বিশ্লেষণ করেছেন যে, ফাস্টফুড যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি হয়, তা শিশুর ব্রেইন গঠনে সহায়ক নয়। বিশেষ করে লবন-চিনি-চর্বি আর এক ধরনের ক্যাফেইন মিশে এমন এক মিক্সচার তৈরি হয়, যা গ্রহণে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে। হজমে সমস্যা তৈরি হয়। টয়লেট স্বাভাবিক হয় না। এসব জটিলতার ধারাবাহিকতায় শিশুটি হয়ে পড়ে অসহায়। অনেক সময় গুছিয়ে অসুবিধার কথা বলতে পারে না। ধীরে ধীরে লেখাপড়া তো বটেই সামাজিক মেলামেশাতেও পিছিয়ে পড়ে।
শিশু মনস্তাত্ত্বিক পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ ড.ওসমান গনি শিশুদের এসব জটিলতার ব্যাখ্যায় বলেন, যখন একজন শিশু ফাস্টফুডে কামড় বসায় তখন তার মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম ডোপামিন থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠে। যা শিশুর আনন্দ ও উত্তেজনার জন্য জন্য প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত স্নায়ু। এর ফলে শিশু আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং তার মস্তিষ্ক ফাস্টফুডের প্রতি তীব্র চাহিদা অনুভব করে।
ফাস্টফুড নিয়মিত গ্রহণের ফলে আরেকটি বড় ক্ষতির কারণ হলো, রক্তনালীতে স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশু ইচ্ছে করলেও শারীরিক নড়াচড়ায় সক্রিয় হতে পারে না। শিশুদের প্রতি কখনো অতি আহ্লাদের কারণে আমরা একরকম বাধ্য হয়ে ফাস্টফুড তুলে দেই। কখনো শিশুটির ইমোশনাল অত্যাচারের শিকার হই।
কেউ একেবারে মনের অজান্তে, অজ্ঞতায় শিশুর হাতে তুলে দেয় অস্বাস্থ্যকর এসব খাদ্য। কারণ যাই হোক,ফলাফলটি কিন্তু আমাদের শঙ্কিত করে। সুষম খাবার শিশুর সবরকম বিকাশের সহায়ক। নিয়মিত শাকসবজি আর ফলমূল খেলে শিশু যেপুষ্টি লাভ করে,তাতে শুধু মেধা নয়-বিকশিত হবে এক সুস্থ ও সামর্থ্যবান মানুষ।
ছবি: প্রতিকী