ফরিদুর রেজা সাগরের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই কিশোর বয়স থেকে। মনে পড়ে ‘কিশোর বাংলা’ নামে কিশোরপাঠ্য একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো ১৯৭৬ সাল থেকে। সেই ‘কিশোর বাংলা’ পত্রিকাতেই তাঁর লেখা প্রথম পড়ি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। সেগুলোই অনেক পরে, আশির দশকে একবই গল্প (১৯৮৭) নামে সংকলিত হয়। বইয়ের সব গল্পই সায়েন্স ফিকশন।
যে-সময়ের কথা বলছি তখন বাংলাদেশে সায়েন্স-ফিকশন লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন লেখক ছিলই না বলতে গেলে। হুমায়ূন আহমদ সবে একটি সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন তোমাদের জন্য ভালোবাসা (১৯৭৩), মুহম্মদ জাফর ইকবালও লিখেছেন মাত্র দুটি সায়েন্স ফিকশন–মহাকাশে মহাত্রাস (১৯৭৭) এবং কপোট্রনিক সুখ দুঃখ (১৯৭৬); দুই ভাই-ই তখন প্রবাসী। এই দুই ভাই ছাড়া তখন আহসানুল হাবীব এবং স্বপনকুমার গায়েন সায়েন্স ফিকশন লেখেন। আহসানুল হাবীবের ছোটমামা দি গ্রেট (১৯৭৮), স্বপনকুমার গায়েনের স্বাতীর কীর্তি (১৯৭৮?), কামাল আরসালনের বঙ্গোপসাগরের শৈবাল হ্রদ (১৯৭৮?) আর লেখেন ফরিদুর রেজা সাগর। যে-কজন সায়েন্স ফিকশন লেখকের নাম বললাম, এঁরাই বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের উদ্ভব স্বাধীনতা-উত্তর কালে। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতকে মনে রেখে আমরা যদি এইসব লেখকের দিকে তাকাই তাহলে নবীনতার কারণে তাঁদের সাধুবাদ দিতে হবে। সেই দিক থেকে ফরিদুর রেজা সাগরও সাধুবাদের ভাগী।
ফরিদুর রেজা সাগর কেবল সায়েন্স ফিকশনেরই লেখক নন, নন কেবলমাত্র ছোটদের লেখক। তিনি বাংলাদেশের টেলিভিশন জগতের এক কৃতী পুরুষ। সেই কিশোর বয়স থেকেই লগ্নতা এই মাধ্যমটির সঙ্গে। নিজে বেসরকারী একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা। দেশের প্রথম টেলিভিশনের অগ্রযাত্রার নিকট-সাক্ষী। তাঁর কলমে এই যাত্রাপথের আনন্দগান শোনা গেছে।
ব্যবসাকর্মও উত্তেজনাময় সৃষ্টিশীল ক্ষেত্র। সে-রকম ক্ষেত্রের একজন মানুষের পক্ষে সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মে মনোনিবেশ করা অসম্ভব ব্যাপার এক। কারণ সাহিত্য সৃষ্টিতে যে নিমগ্নতা আবশ্যক তেমনই নিমগ্নতা আবশ্যক ব্যবসাকর্মেও। ফলে একপথের পথিকের অন্যপথ হারিয়ে ফেলারই কথা। কিন্তু আশ্চর্য যে, ব্যবসাক্ষেত্রে বিস্তৃতির কালেই তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিরও ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়ে চলেছে রচনার সংখ্যায় ও বিষয়ের বৈচিত্র্যে।
সেদিক থেকে শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিসত্ত্বা। আমাদের সাহিত্যের ভুবনে শিশুসাহিত্য চর্চাকে হৃদয়ের সবটুকুকে দিয়ে ভালোবেসেছেন, ছোটদের জন্য লিখেছেন অঙ্গীকারাদ্ধ হয়ে এমন মানুষ খুব বেশি নেই। আমাদের অতীত ইতিহাসে যে-সব ব্যক্তির উজ্জ্বলতা দেখা যায় তাঁদের মধ্যে সাহিত্য ও শিল্পের প্রতিনিধিত্ব বেশি হলেও শিশুসাহিত্য চর্চায় নিবিষ্ট মানুষ কমই উপস্থিত। সেদিক থেকেই তাঁকে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিসত্তা বলা যায়।
আরো একটি দিক থেকে সাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন ও বিকশিত হয়েছেন যেখানে অর্থনৈতিক উদ্যোগ ছিল সুদূর সাফল্যের স্বপ্ন, তুলনায় সাহিত্যিক ও শৈল্পিক পরিম-লের উজ্জ্বলতা ছিল বাস্তব। মা বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, বাবা ফজলুল হক এদেশে সিনেমা নির্মাণের আগেই সিনেমাপত্রিকা সম্পাদনার পথিকৃৎ ও নানামুখী সৃষ্টিশীল উৎসাহে কম্পমান স্বাপ্নিক এক মানুষ। হয়তো সেই সূত্রেই ব্যক্তি হিশেবে শিশুকাল থেকেই সাহিত্যিক ও উদ্যোক্তা – এই দ্বৈত সত্তার বিকাশ ফরিদুর রেজা সাগরের জীবনে ঘটেছিল। বর্তমানে তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে দুই সত্তার একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, বরং একটি হয়ে ওঠে অপরটির পরিপূরক। ফলে অবিকশিত অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে সমাজ মানসে কী ধরনের ভাবনাস্রোতের প্রবাহ চলে তার বাস্তবতা যেমন তিনি অনুভব করতে পারেন তেমনি পারেন বৈশ্বিক উন্নতির চূড়ান্ত অবস্থানের বাস্তবতাকেও অনুভব করতে।
এর পটভূমি যদি আমরা সন্ধান করতে চাই তাহলে আমরা দেখব যে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পরিমণ্ডলেই বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তিসত্তা বিকশিত হয়েছে। পাশ্চাত্যে শিল্পবিপ্লবের তুমুল বিস্তারের যুগে তার ঢেউ বাংলাদেশে প্রায় দেখাই যায় না। এমন কথা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে বাঙালির ব্যবসাবুদ্ধি নেই। একথা এখন আর কেউ মানতে চাইবেন না। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর কালে অর্থনৈতিক নানা খাতে জাগরণ ঘটেছে। বহু সৃষ্টিশীল মানুষের সম্মিলিত সামর্থ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আমাদের অর্থনীতির এই প্রবল প্রতাপান্বিত জাগরণের অনেক আগেই সমৃদ্ধ ছিল আমাদের সাহিত্য ও লোকায়ত শিল্পকলাসমূহ।
কৃষিনির্ভর অর্থনীতির সীমানার মধ্যেও ব্যক্তির অনুভূতিলোক ছিল সজীব। সে-কারণেই সাহিত্যের উজ্জ্বল ঐতিহ্য আমাদের গর্বের বিষয়। অন্যতর জাগতিক সাফল্যকে স্থূল ব্যাপার হিশেবেই বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন এ অবস্থার বদল ঘটেছে। আমাদের সমাজেও দেখা মিলছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিহ্ন। বুর্জোয়া-সংস্কৃতির প্রভাব সমাজকে এখনও যথেষ্ট পরিশীলিত করে তুলতে না পারলেও এর উত্তাপ আসতে শুরু করেছে। এই পটভূমিতেই ফরিদুর রেজা সাগরের সাহিত্য চর্চার মধ্যে আমরা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ঐতিহ্যানুসারিতা ও বর্তমান কালের বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির সাংস্কৃতিক আবহের এক ভারসাম্যময় প্রতিফলন পাই।
প্রথম দিকে শিশুসাহিত্যের আধুনিক সংযোজন কল্পবিজ্ঞান ছিল তাঁর চর্চার বিষয় – প্রথম বইটিই ছিল ওই ধারার। পরে মুক্তিযুদ্ধও প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশের কিশোর পাঠকেরা গত শতাব্দীর ঘনাদা-টেনিদা-ফেলুদা বা কাকাবাবুর ধারায় বা ব্যোমকেশ বক্সী-কিরীটি রায়ের ধারায় কোনো চরিত্র পায়নি। ফরিদুর রেজা সাগর গত এক দশক ধরে অন্তত দুটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন বর্তমান কালের বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে। একটি চরিত্র ‘ছোটকাকু’, অন্যটি ‘সাহেব’। ছোটকাকুর বিচরণক্ষেত্র বাংলাদেশে। কারণ এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক চান বাংলাদেশকে খুঁজে নিতে। ছোটকাকু চরিত্রটির মধ্যে একযোগে পাওয়া যায় দেশপ্রেম ও বুদ্ধির প্রতিভাস। সাহেব চরিত্রটির বিচরণ বাংলাদেশের বাইরে। কিন্তু এই চত্রিটিরও আরব্ধ বাংলাদেশের পক্ষে কোনো-না-কোনো অর্জন। কল্পবিজ্ঞানের জগৎ এই সিরিজের বইগুলোকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
ফরিদুর রেজা সাগর কিশোর বয়স থেকেই শিশু-কিশোর সংগঠনের নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করে চলেছেন। কিশোর বয়সেই অংশগ্রহণ করেছেন একই সঙ্গে চলচ্চিত্র অভিনয় ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাণে ও নানামুখি অংশগ্রহণে জীবনের প্রথমভাগকে যেমন তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি উত্তরভাগে হয়েছেন বাংলাদেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের পথিকৃৎ উদ্যোক্তা। টেলিভিশন সম্পর্কিত শ্রুতি ও স্মৃতি তাঁর সাহিত্য চর্চায় রেখেছে গভীর চিহ্ন। এ ছাড়াও তাঁর লেখা স্মৃতিমূলক রচনাসমূহ বহু নেপথ্য ঘটনার স্মৃতি ও উপলব্ধিকে পাঠকদের সামনে হাজির করেছে।
ব্যবসায়ের কাজে বা নিছক ভ্রমণের আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যেও তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁর সেই ভ্রমণও আর দশজন ভ্রমণকারীর মতো নয়। তাঁকে প্রধানত ভ্রমণ করতে হয় কর্মব্যপদেশে। কিন্তু ভ্রমণপথে চোখ-কান খোলা থাকে তাঁর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কথা কল্পনা করে। তাঁর ভ্রমণসাহিত্যে ভিনদেশ প্রায়শই বাংলাদেশের সঙ্গে তুল্য। কারণ এর স্বদেশী পাঠকদের তিনি উস্কে দিতে চান উত্তরণের অভিযাত্রায়।
উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্য পেতে হলে মানুষের জীবনকে গভীর ভাবে পাঠ করতে হয়। তিনি সেই গভীর জীবনপাঠের নিদর্শন রেখেছেন তাঁর জার্নালধর্মী সাহিত্যে। আর শিশুর জগতে পরিভ্রমণের আকাক্সক্ষা তো তাঁর জাগরুক থাকে সবসময়ই! বাবার সূত্রে ছোটবেলাতেই সিনেমার বর্ণঢ্যতাকে দেখেছেন। সেই বর্ণাঢ্যতার চিহ্নকেও ধারণ করে আছে তাঁর অনেক গল্প। সহজের সাধনা করে চলেছেন তিনি তাঁর সাহিত্যিক অভিযাত্রায়। তাই সমৃদ্ধির অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ফরিদুর রেজা সাগরের বয়স্কজনপাঠ্য রচনাবলি যেমন কিশোরদের পাঠ্য হিশেবে আনন্দময় তেমনি শিশু-কিশোরোপযেগী রচনাবলি হয়ে ওঠে বয়স্কজনেরও পাঠ্য।
ফরিদুর রেজা সাগরের লেখা ছোটদের গল্পে সায়েন্স ফিকশন জোরালোভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ তাঁর ছোটদের গল্পভুবনের সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে আছে সায়েন্স ফিকশন। আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকবার কারণেই হয়তো এই সূক্ষ্ম প্রযুক্তির সংস্পর্শে তিনি এসেছেন। এইসব প্রযুক্তিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে তাঁর কল্পবিজ্ঞানকাহিনির উদ্ভাবনীকল্পনা। চিরায়ত ফরাসি কল্পবিজ্ঞান-লেখক জুল ভার্ন তাঁর সামনে থাকলেও কিংবা ইংরেজি ভাষার লেখক আর্থার সি ক্লার্কের ছিঁটেফোটার সন্ধান থাকলেও এইসবের মধ্যে বাঙালিয়ানা হাজির করার দৃষ্টান্ত তাঁর সামনে কিন্তু তেমন ছিল না। তেমন ছিল না বলতে হল কেবলমাত্র সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রফেসর শঙ্কুর’ কারণে। বাংলাভাষার কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন কেবল তাঁর সামনে ছিল এই প্রফেসর শঙ্কু।
ফরিদুর রেজা সাগরের কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্য রচনার সমসাময়িক কালেই পশ্চিমবঙ্গেরও কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করেছে। মনে রাখতে হবে যে, কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ভিনগ্রহের প্রাণী বা মহাশূন্যের নানা বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড। আমাদের দুই প্রধান কল্পবিজ্ঞানকাহিনির লেখকও প্রথম দিকে মহাকাশ বা ভিনগ্রহ নিয়েই কারবার করেছেন। ফরিদুর রেজা সাগর সেদিকে পা বাড়িয়েছেন কদাচিৎ। অথবা সেদিকে গেলেও তার স্বভাব ভিন্ন হয়ে উঠেছে। আমাদের সাধারণ জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতার মধ্য থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর বিজ্ঞানকাহিনির কল্পনা। তবে বলতে দ্বিধা নেই, কাহিনি উপস্থাপনের যে কাঠামো তিনি ব্যবহার করেন তা সাহিত্য রসিকদের কাছে বহুল পরিচিত। কিন্তু ঘটনাকল্পনার নবীনতা সেই পুরনো কাঠামোর জরাজীর্ণতাকে ভুলিয়ে দেয়। এইখানেই তাঁর সার্থকতা।
তাঁর অধিকাংশ কল্পকাহিনিতেই প্রথমে থাকে ঘটনার আকস্মিকতা ও তার ফল। পরে ধীরে ধীরে এই ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে দেন তিনি। একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয় যে, শিশুসাহিত্যের প্রধান যে প্রবর্তনা শুভবোধ তাকে উচ্চে তুলে ধরেন ফরিদুর রেজা সাগর, আর বড় করে তোলেন দেশপ্রেমকে। অশুভ শক্তির সঙ্গে শুভবোধের সংগ্রাম চিরকালের মানবিক ধারা। এই সংগ্রাম সবচেয়ে উজ্জ্বল ও স্পষ্টভাবে থাকে শিশুসাহিত্যে। ফরিদুর রেজা সাগর যে সত্যিকারের শিশুসাহিত্যিক তার দৃষ্টান্ত তাঁর এই ধরনের গল্পগুলো। জীবনের সূক্ষ্ম মানবিক জটিলতাকে খুব বেশি বিশ্লেষণ করেন না তিনি। শিশুসাহিত্যের সরল পথ দিয়ে জীবন-সংকটের আভাসটুকু দেখিয়ে আনেন মাত্র। এর ফলে অনেক সময় তাঁর কোনো কোনো গল্পকে নান্দনিকতার বিচারে নিতান্ত অপরিণতও মনে হতে পারে। সে অর্থে হয়তো এগুলোকে সাহিত্যের ত্রুটি হিসাবেও চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু সমগ্র বিবেচনায় এ-ও মনে হতে পারে যে, তাঁর শিশুসাহিত্যিক সত্তার প্রাবল্যই হয়তো সেগুলোকে সর্বদা সুঠাম হয়ে উঠতে দেয়নি।
তাঁর গল্পগুলো সম্পর্কে এতক্ষণ যেসব কথা বলা হল তাতে মনে হতে পারে ফরিদুর রেজা সাগর কেবল কিশোরপাঠ্য কল্পবিজ্ঞানকাহিনিই লিখেছেন। প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কল্পবিজ্ঞান ছাড়া সবচেয়ে যে বিষয় প্রধান হয়ে উঠেছে তাঁর শিশুসাহিত্যে তা হল মুক্তিযুদ্ধ। কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশন আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প – এই দুটি ধারাই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে যুক্ত হয়েছে। ফরিদুর রেজা সাগরের শিশুসাহিত্যেও প্রাধান্য লাভ করেছে এই দুই ধারা। অবশ্য এই দুই ধারার মধ্যেই একটা ঐক্য রয়েছে গঠনগত বৈশিষ্ট্যে। দুই ধারার গল্পেই অ্যাডভেঞ্চার ও রোমাঞ্চ-এর ভূমিকা প্রবল হয়ে উঠেছে। এই দুই ধারার রূপায়ণে ফরিদুর রেজা সাগরের চেতনায় যে সত্তাটি সর্বদা ক্রিয়াশীল থাকে তা হল শুভবোধ ও দেশপ্রেম। কখনও কখনও এই শুভবোধ বা দেশপ্রেম তাঁর শিশুসাহিত্যের সাধারণ সূত্র হয়ে যেন ধরা দেয়।
প্রসঙ্গত আমরা দুটি গল্পের শেষভাগ হাজির করতে পারি দৃষ্টান্ত হিসেবে :
…এতো আনন্দের জীবন হয় না। কাল রাতে মায়ের বকা যদি না খেত তাহলে সকালবেলা মাকে দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে দেখতে এতো ভালো লাগত না। আসলে, মানুষের জীবনে সুখ আছে। আনন্দ আছে। কান্না আছে। হাসি আছে। আর কোনও প্রাণীর জীবনে নেই। এগুলো নাই। আর সবচেয়ে বড় কথা, অনতুর একটা সুন্দর পরিচয় আছে।
[‘অনতু ও একুইরিয়াম’, গল্পসমগ্র, পৃ. ৪১]
…মোহনার মনে হচ্ছে অনেক কথা। যে-কথা রূপকথার গল্পকে হার মানায়। যে মোহনা এখন ছোটখালার হাতধরে ফিরে যাচ্ছেÑসেই মোহনা নতুন করে আবার চারদিকে তাকিয়ে দ্যাখে। যে তাকানোর মধ্যে রয়েছে পুরো একটি দেশের ছবি। যে দেশের কথা সবাইকে জানাতে গেলে শুধু মোহনাকে নয়, মোহনাদের অনেক বড় হতে হবে।
[‘মোহনা ও ইটি’, গল্পসমগ্র, পৃ. ৯৯]
গঠনগত দিক থেকে ফরিদুর রেজা সাগরের ছোটদের গল্পগুলো প্রধানত মিলনাত্মক। একটা আশাবাদী মন সবগুলো গল্পে অন্তঃশীল। কিশোর মনের অনেক চাওয়া-পাওয়ার টানাপড়েন এই গল্পগুলোয় মিশে আছে।
আগেই বলা হয়েছে তিনি যখন সায়েন্স ফিকশন লিখতে শুরু করেন তখন তাঁর সামনে বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনের দৃষ্টান্ত ছিল কম। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা বা সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের গল্পগুলোই বলতে গেলে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের বিরল নিদর্শন তাঁর সামনে। ফলে গঠনগত দিক থেকে সত্যজিৎ রায় দ্বারা তিনি খানিকটা অনুপ্রাণিত তা বোঝা যায় ডায়েরির মতো করে গল্প উপস্থাপনের ভঙ্গিতে। সত্যজিৎ রায়ের যেমন প্রফেসর শঙ্কু তেমনি ফরিদুর রেজা সাগরের রয়েছে ছোটকাকু। ছোটকাকু চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন তিনি একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানী হিসাবে। প্রসঙ্গত বলে নেয়া যেতে পারে যে, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে যাঁরা দিকপাল শিশুসাহিত্যিক হিসাবে চিহ্নিত তাঁদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেছেন এই ছোটকাকু চরিত্রের স্রষ্টা।
শশধর দত্তের শুভচেতনার পক্ষের মানুষ দস্যু মোহন, প্রেমেন্দ্র মিত্রের বুদ্ধিদীপ্ত অভিযাত্রী ঘনাদা, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুশলী গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাস্যরসিক টেনিদা, সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা ফেলুদা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রাজ্ঞ কাকাবাবুর কথা প্রসঙ্গত আমরা মনে করতে পারি। বাংলাদেশের সাহিত্যেও এই ধরনের কয়েকটি চরিত্রের দেখা পেয়েছিলাম আমরা। যেমন রাহাত খানের ‘দিলু’ [দিলুর গল্প (১৯৮৬)], নিয়ামত হোসেনের ‘ফেলুমামা’ [মামাকাহিনী (১৯৮৭), ফেলু মামার হাসির গল্প (২০০১)], খান মোহাম্মদ ফারাবীর ‘কামাল ভাই’ [মামার বিয়ের বরযাত্রী (১৯৭৬)] – বিশেষ করে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার অনুকারী এসব চরিত্রের কথা উল্লেখ করা যায়।
কিন্তু রসিক, ভ্রামণিক এবং বিজ্ঞানী এই তিনগুণে সমন্বিত একটি টাইপ-চরিত্র আমাদের শিশু-কিশোর সাহিত্যে নেই। ছোটকাকুর পূর্বসূরী দিলু, ফেলুমামা বা কামাল ভাই – এরা প্রত্যেকেই একমাত্রিকভাবে হাস্যসৃষ্টিকারী। সর্বোপরি ছোটকাকু দেশপ্রেমিক। ব্যক্তিগত জীবনে ফরিদুর রেজা সাগরের অ্যাডভেঞ্চার-প্রধান জীবনের অভিজ্ঞতাকে এবং নিজের অভিযাত্রী মানসিকতাকে তাঁর সৃষ্ট গল্পের চরিত্রের মধ্যে পুরে দিয়েছেন। ব্যক্তি হিসাবে লেখকের মধ্যে যদি বড় জীবনদৃষ্টি না থাকে তাহলে তা সাহিত্যে প্রতিফলিত হবে কী করে? আমাদের শিশুসাহিত্যে সবচেয়ে বড় দীনতা বোধ হয় এই জীবনদৃষ্টির সংকীর্ণতা। অন্যবিধ গুণে লেখকেরা বেশ সমৃদ্ধ থাকলেও জীবনদৃষ্টির ক্ষীণতা শিশুসাহিত্যকে প্রসারিত দৃষ্টির কর্ম হিসাবে উত্তীর্ণ করতে পারে না। শিশুসাহিত্যিক হিসাবে ফরিদুর রেজা সাগর এগিয়ে আছেন তিনি উন্নত জীবনদৃষ্টির লেখক বলে।
শিশুকিশোর পাঠকদের কাছে তাঁর গল্পগুলো যথেষ্টই উপভোগ্য মনে হবে। যদি বলা হয় যে জীবনের অন্যতর ক্ষেত্রে ফরিদুর রেজা সাগরের সাফল্যের মাত্রা ও খ্যাতির ব্যাপকতা তাঁর শিশুসাহিত্যিক সামর্থ্যকে বিবেচনায় আনতে দেয় নি তাহলে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। বিশ্বায়ন প্রভাবিত জীবনযাত্রার উৎকর্ষের দিকে তাঁর দৃষ্টি আরও তীক্ষè হোক এই কামনা করি।
২০১০ [পরিমার্জনা: ২০১৬]
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ‘সৃষ্টি বুদ্ধি মুক্তি’ বইটি প্রকাশ করবে কথাপ্রকাশ, প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা।এতে উনিশ শতকের আক্ষয়কুমার দত্ত থেকে শুরু করে আমীরুল ইসলাম পর্যন্ত মোট ৩০ জন মানুষের সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। কৌতূহলীদের জন্য সূচি তুলে দিচ্ছি এখানে:
অক্ষয়কুমার চর্চা ও মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম ২০০৬ [পরিমার্জনা:২০১৬]
কামিনী রায় : রেনেসাঁসের কবি ও গদ্য লেখক ২০০৯
সফিয়া খাতুন বিএ : অজ্ঞাত এক মননশীলা ১৯৯৯
বাংলায় রেনেসাঁসের অভিঘাত: মোতাহের হোসেন চৌধুরীর চোখে ২০১১
কিংবদন্তির হুমায়ুন কবির: মনীষিতার সন্ধানে
জন্মশতবর্ষের আলোয় ২০০৬
বাঙলার কাব্য : দার্শনিক প্রত্যয় ২০০২
নদী ও নারী : প্রাপ্যবঞ্চিত উপন্যাস ২০০১
আহসান হাবীব : ব্যক্তি ও ঔপন্যাসিক ১৯৯৯
আবদুল হক : সামগ্র্যে ও বিশিষ্টতায়
যথার্থ বুদ্ধিজীবীর প্রতিকৃতি ২৭ অকটোবর ২০০০ [পরিমার্জনা:২০১৬]
তাঁর মনস্বিতা ২০০২
আবদুল হকের নজরুল ২০০৪
আবুল হোসেন: আবেগসংযমের কবি ২০১৪ [পরিমার্জনা:২০১৬]
ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন ২০১৫
চিত্তরঞ্জন সাহা : মরণে যাঁর কর্মময় জীবনের বিশ্রাম ২০০৭
আতাউর রহমান : কবি ও নজরুল সাহিত্যের বিশ্লেষক ১৯৯৯
শামসুর রাহমান: শোকলেখন ও স্মৃতি
শোকলেখন ২০০৬
স্মৃতির পাঠ ২০১৫
পত্রিকাসাধক মীজানুর রহমান ২০১৬
ওয়াহিদুল হক : মানবিক উৎকর্ষের আলো
কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন: সমাজ রূপান্তরের চিহ্ন ২০১২ [পরিমার্জনা:২০১৬]
সৈয়দ শামসুল হক: ব্যঞ্জনার সাধনা ২০১৬
যতীন সরকারের মানসভুবন: তিনটি বইয়ের আতসকাচে
পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন: আত্মজীবনীর আয়নায় ২০০৫
সমাজ ও রাজনীতি চিন্তা ২০০৮
আমার রবীন্দ্রাবলোকন ২০১১
রফিকুল হক: ছড়াকার ও শিশু-সংগঠক ২০১৬
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : সমগ্রসত্তা ও লেখকসত্তা
সমগ্রসত্তার পরিচয়
লেখকসত্তার সামগ্র্য ২০০৭
ভালোবাসার সাম্পান : সৃষ্টিকর্মের আস্বাদন ২০১৬
এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ: সম্পন্ন শিশুসাহিত্যিক ২০১৫
ফজলুল আলম: পাণ্ডিত্য ও রসিকতার সমন্বয় ২০১৬
আন্ওয়ার আহমদ : সাহিত্যের এক প্রেমিক-সত্তা ২০০৬
আবদুল মান্নান সৈয়দ: সত্তার সন্ধান
সৃষ্টিশীলতার খণ্ড ও সামগ্র্য ২০১৪
তাঁর আধুনিকতা ২০১৫
লিটল-ম্যাগাজিন সাহিত্য-পত্রিকা সৃজনশীলতা ২০১৪
আলী ইমাম: শিশুসাহিত্যের একনিষ্ঠ প্রেমিক ২০১৫
কথাশিল্পী শহীদুল জহির: অকালে ঝরে যাওয়া ফুল ২০০৮
ফরিদুর রেজা সাগর: তাঁর শিশুসাহিত্য ২০১০ [পরিমার্জনা: ২০১৬]
ইমদাদুল হক মিলন: এখনো তারুণ্যমত্ত ও বিকাশমান ২০১৫
আসলাম সানী: সার্বক্ষণিক সৃষ্টিশীল ২০১৫ [পরিমার্জনা: ২০১৬}
লুৎফর রহমান রিটন: ছড়ায় ও সৃষ্টিশীলতার সামগ্র্যে ২০১৬
আমীরুল ইসলাম: ব্যক্তি ও ছড়াকার ২০০৭ [পরিমার্জনা: ২০১৭]