‘বাস্তবে আমি ফজলুল হকের কাছাকাছি না যেতে পারলেও, পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে তার কাছাকাছি আসতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে’ বললেন চলচ্চিত্র সাংবাদিক নরেশ ভুঁইয়া। ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার ২০১৭ গ্রহন করে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্তির পর তিনি আরও বলেন, ‘আমি চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত আছি প্রায় ৩০ বছর। কিন্তু জীবনে কখনও কোনো পুরস্কার পাইনি। তাই আমি যখন শুনলাম আমি এ পুরস্কারের জন্য এ বছর মনোনীত হয়েছি, তখন না পাওয়ার বেদনা এবং পাওয়ার আনন্দ মিলে এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়েছিল আমার মাঝে।’
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলের বলরুমে ‘ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার ২০১৭’আয়োজন করা হয়। প্রতি বছরের মতো এ বছরও একজন চলচ্চিত্র সাংবাদিক এবং সেরা চলচ্চিত্রের পরিচালককে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে এবছর পুরস্কৃত হন আব্দুল লতিফ বাচ্চু। পুরস্কার পেয়ে তার অনুভূতি প্রকাশ করে বাচ্চু বলেন, ‘আমার বাবা বলতেন, যা করবে তা ঈমানদারীর সাথে করবে তাহলে সুফল আসবেই। এই তার সুফল।’ তিনি তার সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমাদের সময়ে মফস্বল থেকে এসে চলচ্চিত্রে কাজ করাকে কেউ সহজভাবে নিতেন না। কিন্তু আমি সেই বাধাগুলোকে অতিক্রম করে সামনে যাবার চেষ্টা করেছি।
এবারের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উপস্থিত ছিলেন প্রবীন অভিনেতা হাসান ইমাম। বক্তব্যে তিনি বলেন, ফজলুল হক জীবনে ‘প্রথম’ শব্দটাকে খুব মেনে চলতেন। তাই সেসময়ে যা কিছু প্রথম তার অনেক কিছুর সাথেই তার নাম জড়িয়ে আছে। শুধু প্রথম সিনেমা বিষয়ক পত্রিকা বা শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মাঝেই তা সীমাবদ্ধ ছিল না। এফডিসিতে একসময়ে খাবার দাবার পাওয়া বেশ কষ্ট হয়ে যেত। সেই কষ্ট অনুভব করে তিনি সেখানে প্রথম আধুনিক ক্যান্টিন গড়ে তোলেন। এছাড়া তিনি-ই প্রথম গুলশানে একটি ফিল্ম ক্লাব গড়ে তোলেন।
‘রূপবান’ ছবির স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ছবিটি নির্মাণ করা ছিল ফজলুল হকের চিন্তার-ই একটা অংশ। যদিও পরবর্তীতে নানা জটিলতায় তিনি সেটা নির্মাণ থেকে সরে এসেছিলেন। তিনি নির্মাণ করলে হয়তো সেখানে থাকা কিছু অসামঞ্জস্য বিষয়গুলো থাকতো না।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আরেক অতিথি ও নাট্যকার, নির্মাতা মামুনুর রশীদ বলেন, কলকাতায় আমি ও ফজলুল হক একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। তিনি নানান ধরণের দুঃসাহসিক কাজের উদ্যোগ নিতেন, যেটাতে সাফল্য ও ব্যর্থতার মিশ্রন থাকতো। ব্যর্থতা হলেও তিনি কখনও পিছপা হতেন না।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ফজলুল হকের মেয়ে বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসী বলেন, ‘ফজলুল হক পুরস্কার প্রদান কমিটি তাদেরকেই পুরস্কৃত করার চেষ্টা করে, যারা সারাজীবন সত্যিকারের কাজ করার চেষ্টা করে গেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যে আজ একজন রন্ধনশিল্পী হয়ে উঠেছি তা আমার বাবার গুণেই। মা কথাসাহিত্যিক রারেয়া খাতুনের কাছে থেকে অনেক রান্না শিখলেও বাবাই ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা। আমি দেখতাম ছুটির দিনগুলোতে কিংবা কোনো পিকনিক এবং অনুষ্ঠানে বাবা কত আনন্দ নিয়ে রান্নায় নেমে পড়তেন।’
ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার ২০১৭ তে পুরস্কার প্রাপ্তদের উত্তরীয় পড়ে দেন মামুনুর রশীদ, ক্রেস্ট প্রদান করেন হাসান ইমাম, অর্থসূচক মূল্য প্রদান করেন কেকা ফেরদৌসী এবং ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান মুকিত মজুমদার বাবু।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা কণা রেজা বলেন, ‘আমি ফজলুল হক সাহেবের পুত্রবধু হিসেবে গর্বিত। শুধু পুত্রবধু-ই নয়, আমি তার পরিবারের সবচেয়ে বড় বৌমা। আমি তার নির্দেশিত পথে সামনের পথে চলাকে গর্বের মনে করি।’ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আলী ইমাম, নাট্যকার ও নির্দেশক নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমান, সঙ্গীতশিল্পী কোনাল, নুরুল আলম বাবু, চলচ্চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম, আল-মানসুর, আবু সাইয়ীদ প্রমুখ।
প্রসঙ্গত ১৯৩০ সালে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফজলুল হক। পঞ্চাশের দশকে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করেনি চলচ্চিত্রশিল্প, সে সময় বগুড়ার মতো মফস্বল শহর থেকে ‘সিনেমা’ নামে চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। পত্রিকাটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাবিষয়ক সাময়িকী। সারা দেশেই এটি আলোড়ন তুলেছিল। তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত মানসম্পন্ন এবং জনপ্রিয় পত্রিকা সিনেমা। এ সূত্রে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ফজলুল হক।
এছাড়া ষাটের দশকে ‘প্রেসিডেন্ট’ নামে দেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্রটিও নির্মাণ করেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ‘প্রেসিডেন্ট’ ছবিতে শিশুনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন আজকের স্বনামধন্য টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলুল হকের সন্তান ফরিদুর রেজা সাগর।
১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন এই গুণী মানুষটি। এরপর ২০০৪ সাল থেকে ফজলুল হক স্মৃতি কমিটির পক্ষ থেকে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। ফজলুল হক স্মৃতি কমিটির পক্ষে ‘ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার’ প্রর্বতন করেন ফজলুল হকের সহধর্মিনী কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন।
এর আগে ফজলুল হক স্মৃতি পদক পেয়েছেন কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, চিত্রপরিচালক আমজাদ হোসেন, সাইদুল আনাম টুটুল, চাষী নজরুল ইসলাম, আহমদ জামান চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, রফিকুজ্জামান, সুভাষ দত্ত, হীরেন দে, গোলাম রব্বানী বিপ্লব, আবদুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মোরশেদুল ইসলাম, চিন্ময় মুৎসুদ্দী, ই আর খান, অনুপম হায়াৎ, গোলাম সারওয়ার, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সোহেল রানা, শহীদুল হক, আজিজুর রহমান ও মোস্তফা জব্বার।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের শুরুতে তাকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘সম্মুখযাত্রী ফজলুল হক’ প্রদর্শন করা হয় এবং মধ্যাহ্নভোজের মাঝে দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মৌসুমী বড়ুয়া।
ছবি: জাকির সবুজ