জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্যদের জন্য প্লট চেয়ে অধিবেশনে হাততালি পেলেও বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, সংসদে দাঁড়িয়ে জনগণের চাওয়া পাওয়ার বদলে যখন সাংসদদের নিজেদের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন বেশি ঘটে তখন সেটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে নীতি-নৈতিকতারও পরিপন্থী।
তাদের মতে, নির্বাচনের আগে ভোট চাওয়ার সময়ে অনেকেই শুধু জনগণের সেবার কথাই বলেন। কিন্তু সময় পেরোলে দেখা যায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগকে তারা নিজেদের সম্পদ উন্নয়নের একটি পথ হিসেবেই বেছে নেন।
দশম জাতীয় সংসদের অষ্টম অধিবেশনের সমাপনী দিনে সোমবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পার্লামেন্টের নতুন সদস্যদের জন্য প্লট চেয়ে আর্জি জানান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। তিনি বলেন, যারা সংসদের নতুন সদস্য তাদের প্লট নেই। তাদের প্লট বরাদ্দ দিন। এই বিষয়ে আমি মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তার এমন দাবীকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির নৈতিকতা বহির্ভূত হিসেবে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর এমন দাবী নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই দেশে ধারাবাহিকভাবে এই সংস্কৃতি চলে আসছে।
‘জনগণের সেবার কথা বলে ভোট চাওয়া হলেও পরে জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগকে অনেকেই সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করেন। সেটারই প্রতিফলন এই দাবী। এই ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একই কথা বললেন নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরিফ।
তার মতে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জনগণের সেবার জন্য, সেটা করতে গিয়ে তিনি বাড়তি সুবিধা নিতে পারেন না। ‘তারা নিজেরা প্লট নেবেন এই বলে তো আর জনগণের ভোট নেন না, বলেন জনগণের সেবা করবেন। তাহলে সংসদে জনগণের সুযোগ-সুবিধার কথা না এসে নিজেদের সুবিধার কথা তোলেন কেনো?’
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এভাবে সুযোগ সুবিধা নেওয়ার নামে দুর্নীতিও হচ্ছে প্রচুর। তারা শুধু নিজের নামেই নয়, বেনামেও প্লটসহ নানারকম সুবিধা নিচ্ছেন।
বিরোধীদলীয় নেতার মতো একটি পদে থেকে এমন চাওয়া নৈতিকতা পরিপন্থী বলে মনে করেন শরিফুজ্জামান শরিফ। তিনি বলেন, ঢাকায় তো আর বরাদ্দের মতো প্লট নেই। এই চাওয়ার পর হয়তো দেখা যাবে ঢাকার আশেপাশে যেসব নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জায়গা আছে সেসব অধিগ্রহণ করে সাংসদদের দেওয়া হবে।
‘এতে করে জনগণের উপর নিপীড়ন হবে। এরকম দাবী করাটাও তাই অনৈতিক,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স স্টাডিজ এর চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. সুলতান হাফিজ রহমান এমপিদের এমন আচরণকে রাজনৈতিক নীতিমালার পরিপন্থী বলে মনে করেন।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, সংসদে দাঁড়িয়ে এভাবে নিজেদের জন্য সুযোগ সুবিধা চাওয়া রাজনৈতিক নীতিমালার পরিপন্থী। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও নেতিবাচক প্রভাব আসবে। যারা জনগণের প্রতিনিধি তাদের নজর থাকা উচিত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের দিকে, কিন্তু সেটা না করে তারা যদি শুধু নিজেদের দিকেই নজর দেয় তাহলে তা দেশের জন্য কখনোই ইতিবাচক হবে না।
‘আর তাছাড়া দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। কে প্লট পাবে, কে ফ্ল্যাট পাবে সেজন্য আইন আছে। নিয়ম আছে। এসব কথা মাথায় রেখে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই এমপিদের চেষ্টা করা উচিত। সংসদকেও সেভাবেই পরিচালিত করা উচিত,’ বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. সুলতান হাফিজ।
নাগরিক সমাজের এই প্রতিনিধিরা বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচাতে সাংসদদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। সেটা যেমন আচরণে হতে হবে তেমনি সংসদে দেওয়া বক্তৃতা-বিবৃতিতেও।