সাতকাহন উপন্যাসের দীপাবলীর কথা হয়তো অনেকরই জানা। উপন্যাসের দীপাবলীর জীবনের চেয়েও কঠিন বস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গাবসার এলাকার দুর্গম চরের দরিদ্র ঘরের নয় বছরে শিশু বর্ণার। অবৈধ সস্পর্ক ঠিক রাখতে শিশু কন্যার সাথে তার নিজের প্রেমিকের বিয়ে দিয়েছেন মা!
তবে উপন্যাসের দীপাবলীর চেয়েও দৃঢ়চেতা এই বর্ণা। সমাজের নিদারুণ অন্ধকারকে পদদলিত করে বর্ণার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে, ‘রফিকুল আর মা আমাকে অন্ধকার জীবনে ঠেলে দিয়েছিলো। আমি তাদের বিচার চাই। আমাকে আপনারা লেখাপড়ার সুযোগ করে দিন। আমি অনেক লেখাপড়া করতে চাই।’
বর্ণার অভিযোগ: মা নিজের অবৈধ সম্পর্ক ঠিক রাখতে এলাকার চিহ্নিত লম্পট ও মাদক ব্যবসায়ী প্রেমিক রফিকুল ইসলাম নামের ২৫ বছরের এক যুবকের সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছেন!
বৃহস্পতিবার ওই শিশু কন্যা তার বাবার মাধ্যমে অবৈধ বিয়ে বাতিল ও জড়িতদের শাস্তি চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদন করলে বেড়িয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। মায়ের এমন ভূমিকা নিয়ে এলাকায় যেমন তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি শিশুটির সাহসী ভূমিকার জন্য হচ্ছে প্রশংসা।
সরেজমিনে জানা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা চরের ছোট নলছিয়া পাড়ার ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী বাবলু শেখ। আত্মীয়তার সূত্র ধরে ১৯ বছর আগে বিয়ে করেন রংপুরের আমাসু কলোনীর নূর ইসলামের মেয়ে নূর বানুকে। বিয়ের কয়েক বছর পরে তাদের জম্ম হয় ছেলে নূর আলমের। এরও দুই বছর পরে জম্ম হয় কন্যা শিশু বর্ণার। বর্তমানে শিশু দু’টি স্থানীয় জুংগিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম ও চতুর্থ শ্রেণীর পড়াশোনা করছে। এলাকায় এলাকায় কাপড় ফেরি করে বিক্রি করা বাবলু শেখের তার পেশা। এ সুবাধে দীর্ঘদিন ধরে চট্রগ্রামে অবস্থান করেছেন তিনি।
যে কারণে বিয়ে
বাবলু শেখের ভাই আব্দুল কাদের বলেন: আমার ভাই দীর্ঘ সময় ধরে বাইরে অবস্থান করার সুযোগে স্ত্রী নূর বানু’র সাথে পরিচয় হয় গাবসারা হাটের মোবাইলের দোকনী রফিকুল ইসলামের। পরিচয় থেকে তাদের সম্পর্ক গড়ায় শারীরিকে। বিভিন্ন সময় নূর বানু ও রফিকুলের এ অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে এলাকায় একাধিক ঘরোয়া শালিসী বৈঠক হলেও থামানো যায়নি তাদের মেলামেশা।
‘এক বছর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে রফিকুলের সাথে নূর বানুকে মেলামেশা না করার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়। তারপরেও তাদের অবৈধ মেলামেশা বন্ধ করা যায়নি। গত সাত মাস আগে প্রেমিকের হাত ধরে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায় নূর বানু। পরেরদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে নূরবানুকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনি। ফিরিয়ে আনার ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে কন্যা শিশু বর্ণাকে নিয়ে বাবার বাড়ি রংপুরে চলে যায় নূর বানু। সেখানে বসেই তাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসাবে ফন্দি আটে নাবালিকা কন্যা শিশুর সাথে রফিকুলের বিয়ে দেয়ার।’
যেভাবে বিয়ে
বাবলু শেখের ভাই আব্দুল কাদের আরো বলেন: বাবার বাড়ী রংপুরের আমুসা কলোনীতে গিয়ে অবৈধ এ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অভিনব পন্থা অবলম্বন করে শিশু বর্ণার মা ও তার কথিত প্রেমিক রফিকুল। গত ৮ জুন টাকার বিনিময়ে রংপুর সিটি করর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ গোলাম কবীর কাজলের সাক্ষরিত নাগরিকত্ব সনদ ও সিটি করপোরেশনের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধক অনিজা হাসানের স্বাক্ষরিত জন্মসনদ সংগ্রহ করে তারা।
পরে ১১ জুন রবিবার মার্কেট থেকে নতুন কাপড় কেনার কথা বলে বর্ণাকে রংপুর কোর্টে নিয়ে যায় তার মা ও প্রেমিক রফিকুল। সেখানে বর্ণার বয়স ১৮ বছর দেখিয়ে রংপুর জজ কোর্টের এডভোকেট এ আর মাইদুল ইসলামের মাধ্যমে নোটারী পাবলিক করে নুর বানুর কথিত প্রেমিক রফিকুলের সাথে শিশু বর্ণার বিয়ে সম্পন্ন করা হয়।
কে এই রফিকুল
এলাকাবাসী জানায়: ২৫ বছরের রফিকুল উপজেলার গোবিন্দাসী এলাকার শাজাহান মিয়ার ছেলে। গোবিন্দাসী এলাকায় তার নামে রয়েছে একাধিক নারীঘটিত ঘটনা। তার লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনি তিন সন্তানের জননী তার এক খালাও। খালার সাথে অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হয়। বিতাড়িত রফিকুল আশ্রয় নেন দুর্গম চর গাবসার হবির ছেলে হামিদের বাড়িতে। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে স্থানীয় গাবসারা হাটে চালু করেন মোবাইলে গান, ভিডিও ও ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা। তবে এসবের আড়ালে চলতো পর্নোগ্রাফি ও মাদকের ব্যবসা।
‘সেই সাথে চলতো এলাকার কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের সাথে প্রেমের নাটক করে তাদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে গোপনে ভিডিও ধারণ করে পর্নোগ্রাফি করে তা বিক্রি করা।’
এমন একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার খবরে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাবসারা হাটের ব্যবসায়ী ও গোবিন্দাসী এলাকার বাসিন্দারা বলেন: রফিকুল দীর্ঘদিন ধরেই বেপরোয়া জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। গান, ভিডিও ও ফ্লেক্সিলোডের দোকানের আড়ালে মূলত সে বড় মাপের একজন মাদক ও পর্নোগ্রাফি ব্যবসায়ী। দুর্গম চরে এসব অপকর্ম চালানোর ফলে দীর্ঘদিন ধরেই অজানা ছিলো তার ভয়ঙ্কর অন্ধকার দিক।
যেভাবে ঘটনার প্রকাশ
সম্প্রতি শিশু বর্ণা মায়ের রক্তচক্ষু উপক্ষো করে তার করুণ দশার কথা বাবাকে অবহিত করে। আকুতি জানায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের। মেয়ের অনিশ্চিত জীবনের কথা চিন্তা করে বাবা বাবলু শেখ সাহায্য প্রার্থনা করেন স্থানীয় ইউপি চেয়রম্যান মনিরুজ্জামানের কাছে। তিনি ঘটনা শুনে এগিয়ে আসেন তাদের সাহায্য করতে। বাবা-মেয়েকে নিয়ে যান ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। অবৈধ ও বেআইনীভাবে বাল্য বিয়ে বাতিল ও জড়িতদের শাস্তির দাবী করে নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের নিকট একটি লিখিত আবেদন করেন। সেখান থেকেই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বর্ণার বাবা বাবলু শেখ জানান: আমাকে না জানিয়ে ৯ বছরের শিশু কন্যাকে রংপুর নিয়ে গিয়ে তার মা রফিকুল নামের এক যুবকের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। অবৈধ ও বেআইনী বিয়ে বাতিল করে জড়িতদের বিচার চেয়ে বৃহস্পতিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
গাবসারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনির রফিকুলের বিভিন্ন অপকর্মের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন: এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রফিকুলের বিরুদ্ধে মাদক,পর্নোগ্রাফির মতো যে অপকর্মের কথা ছড়িয়ে পড়ছে তা আতঙ্কের বিষয়। তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা জরুরি। নয়তো সমাজে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে।
সাহসী শিশু বর্ণা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: রফিকুল ও মা আমাকে যে অন্ধকার জীবনে ঠেলে দিয়েছিলো, আমি তাদের বিচার চাই। আমাকে আপনারা লেখাপড়ার সুযোগ করে দিন। আমি অনেক লেখাপড়া করতে চাই।
ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ জানান: ৯ বছরের ওই শিশু কন্যাটিকে দেখেছি এবং তার ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তদন্ত করে এর সাথে জড়িতের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।