ছাত্রলীগ, বাংলাদেশে বৃহত্তম ছাত্র সংগঠনের নাম। যার রয়েছে অত্যন্ত গৌরবময় উজ্জ্বল একটি ইতিহাস। সেই ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশের নানা সংকটময় মূহুর্তে ছাত্রলীগকে বরাবরই সামনের সারিতে পাওয়া গেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং এগারো দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাধীকার আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে, যুদ্ধে অংশগ্রহন করে এবং বাংলাদেশ বিজয় লাভে ভূমিকা পালন করে।
সেই ছাত্রলীগ বর্তমানে কি করছে? আমরা যদি অনলাইনে বা অফলাইনে বিভিন্ন খবরের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যতরকম অপকর্ম রয়েছে সবকিছুতে ছাত্রলীগের নাম জড়িত। যে ছাত্রসংগঠনটি গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী, যে সংগঠনের প্রগতিশীল ও সুস্থ রাজনীতি চর্চার অগ্রদূত হওয়ার কথা, প্রতিদিন সেই ছাত্রসংগঠনটির নানা কুকীর্তির কথা পড়তে, সমালোচনা করতে হতাশ লাগে আমার। অথচ আমি ছাত্রলীগের সৎ কাজের কথা, আদর্শের কথা মাথা উঁচু করে বলতে চাই। কিন্তু চাইলেই সব হয়না।
তবে কি ছাত্রলীগ ভালো কোন কাজ করে না? নিশ্চই করে। ছাত্রলীগে ভালো, যোগ্য, সৎ নেতাকর্মী কি নেই? অবশ্যই আছে। আজকের এই বন্যাকবলিত জনপদে ছাত্রলীগও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে পৌঁছে গেছে নানা জায়গায়। পাশে দাঁড়িয়েছে অসহায় মানুষের। তবে দেশে বন্যা নেই বলে ইমরান এইচ সরকার বা অন্য কোন দলের উপর আক্রমণ করছে কারা? কারা শিক্ষককে ক্লাশ নেয়ার অপরাধে হত্যার হুমকি দিচ্ছে? কারা ধর্ষণের মতো অপকর্মে লিপ্ত? হ্যা, তারাও ছাত্রলীগই। তারাই সেই কৃষ্ণগহ্বর যা ছাত্রলীগের সকল ঐতিহ্য, সকল সৎ প্রচেষ্টাকে শুষে নিয়ে কেবল অন্ধকার ছড়াচ্ছে। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব ভাবছেন কি এদের নিয়ে?
আজ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী। যত ধর্ষক, সন্ত্রাসী, হীনমন্য, আদর্শহীন, মতলববাজ সব দলে দলে জমায়েত হয়েছে ছাত্রলীগের পতাকাতলে। ছাত্রলীগে নেতা-কর্মীর সংখ্যা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বেড়ে গেছে/ যাচ্ছে পঙ্গপালের মতো। এই সেদিনও যে ছেলেটি জামাত শিবির করতো, ছাত্রদল করতো, সে আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গর্বিত সৈনিক। এদের দাপটে কোনঠাসা হয়ে আছে, সত্যিকারের আদর্শবান, সৎ ছাত্রলীগের কর্মীরা। বেঘোরে মার খাচ্ছে। এসব নতুন নয়, গত দশটি বছর ধরেই দেখছি।
এইতো সেদিনও সিলেটের জালালাবাদ কলেজে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে নির্মমভাবে কুপিয়েছে শিবিরের ছেলেরা। যাদের দ্বিখন্ডিত হাত পায়ের বিভৎস ছবির দিকে দ্বিতীয়বার তাকানো যায়না। এই অপূরণীয় ক্ষতির বিনিময়ে কি জুটছে ছাত্রলীগের কপালে? শুধুই গালি আর ঘৃণা। কিন্তু কেন? আমরা সাধারণ জনগন হয়ে যেটা খালি চোখে দেখতে পাই, ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কি সেটা দেখতে পায় না। যদি না পায়, কেন পায় না? আর যদি পায়, তবে এর প্রতিকারের জন্য তারা কি পদক্ষেপ নিয়েছে/ নিচ্ছে?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ছাত্রলীগ যেনতেন ভাবে তার কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর মিশন নিয়েছে! সেখানে নেই কোন জবাবদিহিতা, নেই কোন আদর্শের বাধ্যবাধকতা। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী নাম ধারন করে যেকোন কিছু করা জায়েজ। শস্যের চাইতে আগাছা বেশি হলে তাতে কৃষকের গোলা শুন্যই থাকে। ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই কোন।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আজ যদি বাংলাদেশের দল, মত নির্বিশেষে সব তরুণ নিজেদের ছাত্রলীগ বলে ঘোষণা করে, যদি সকলে বলে আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, তবে সেটা কি ছাত্রলীগের অর্জন বলে বিবেচিত হবে? ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কি খুশী হবে তাতে? এবং সেইসব কর্মীদের সকল কর্মকান্ডকে কি ছাত্রলীগ নেতৃত্ব অন্ধভাবে সমর্থন যুগিয়ে যাবে? কেউ বিরোধীতা করলে তাকে আক্রমন করবে?
অথচ, সেইসব তরুণদের আদর্শকে যাচাই বাছাই করার উচিত। তাদের ছাত্রলীগে যোগদানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোঁজ নেয়া উচিত। তাদের কর্মকান্ডকে প্রশ্ন করার উচিত। তাদের অপরাধকে অন্ধভাবে সমর্থন জুগিয়ে অথবা পিঠ বাঁচাতে তারা ছাত্রলীগের কেউ নয় বলে দায় এড়ানো যায় না। অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? ভাবুন, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব, একটু ভাবুন দয়া করে।
ছাত্রলীগের একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে আমার বিনীত অনুরোধ, আপনারা বন্ধ করুন এসব। ছেটে ফেলুন সকল আগাছা। ভুলে যাবেন না, আপনাদের কাজে অতিষ্ট হয়ে সেই ২০০৯ সালেই ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ঢাকা সহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সন্ত্রাস, দখলদারি মনোভাব, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তারপরও ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে খুব একটা পরিবর্তন আমরা দেখিনি।
মনে রাখবেন, সংখ্যা নয় বরং যোগ্যতাই আপনাদের জিয়ন কাঠি হতে পারে। এবং সেটাই হওয়া উচিত। ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন, ত্যাগী আদর্শবান কর্মীদের মূল্যায়ন করুন। তাদের নেতৃত্বে আসতে দিন। আর যারা অপরাধে জড়িত তাদের ত্যাগ করুন, শাস্তি দিন। প্রয়োজনে শুদ্ধি অভিযান চালান। নইলে ভরাডুবি কেউ আটকাতে পারবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)