তাকে গুরু ডাকি। নাট্যাঙ্গনের খ্যাত-অল্পখ্যাত সকলেই তাকে গুরু মানে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলা নাটকের সেবা করছেন। মঞ্চে, টেলিভিশনে, রেডিওতে এক অভূতপূর্ব সফল নাট্য ব্যক্তিত্ব তিনি। চালচলনে খুব সাধারণ। টুকটুক করে হাঁটেন। তরুণদের সাথে থাকেন। প্রতিদিন হুইস্কি পান করেন। সামান্য আহার। বয়সের ভারে কিছুটা শ্লথ। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্য নানা ধরনের আয়ুর্বেদিক ও ভেষজ ঔষধ গ্রহণ করেন। জাত অভিনেতা। শঙ্খচিল কিংবা মনপুরার অভিনয় কোনোদিন কি আমরা ভুলতে পারবো?
টেলিভিশনে অভিনীত শত শত নাটকে তার অভিনয় দর্শকদের কাছে এখন কেবলই স্মৃতি। মঞ্চের সফল ও সেরা নাট্যকার। বাংলাদেশে আধুনিক নাট্যধারার প্রবর্তক। তাদের অনুসরণেই সেলিম আল দীনের আবির্ভাব। মনে পড়ে, গিনিপিগ, জয়জয়ন্তি, মানুষ, ওরা কদম আলী, ওরা আছে বলেই, রাঢ়াঙ, শত্রুগণ, টার্গেট প্লাটুন, বঙ্গভঙ্গ এইসব বহুখ্যাত নাটকের তিনি নাট্যকার। ‘আরণ্যক’ তার প্রাণের নাট্যদল। এইসব নাটকের তিনি রচয়িতা, নির্দেশক। আরণ্যক দল নিয়ে তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। এই একটি দল যে দলে ভাঙন নাই। কেউ দল ছেড়ে গিয়ে আরেকটি আরণ্যক তৈরির অপচেষ্টা করেননি। আরণ্যক এ মামুনুর রশীদ বহু বিখ্যাত প্রতিভার জন্ম দিয়েছেন। মামুন ভাই বিশ্বাস করেন, নাট্যদলে গণতন্ত্র খুব জরুরি।
আরণ্যক দলের যারা নাটকে অভিনয় করেছেন মঞ্চে তাদের মধ্যে স্বনামখ্যাতদের তালিকা অনেক বড়। আজিজুল হাকিম, মোমেনা চৌধুরী, ফজলুর রহমান বাবু, শাহ আলম দুলাল, আবুল কালাম আজাদ, আ খ ম হাসান, তমালিকা কর্মকার, মাসুম আজিজ, তুষার খান, তাজিন আহমেদ, নাট্যকার মান্নান হীরা, নাট্যকার আবদুল্লাহ হেল মাহমুদ, বর্তমানে বিটিভির ডিজি হারুনুর রশিদ, আলোক বিন্যাসের ঠাণ্ডু রায়হান এরকম গুচ্ছ গুচ্ছ অসংখ্য নাম। প্রয়াত নাজমা আনোয়ারের কথাও স্মরণ করছি। অসম্পূর্ণ এই তালিকা। বাংলাদেশের নাট্য চর্চার ধারায় আরণ্যক পঁয়তাল্লিশ বছর পেরিয়ে এসেছে। মামুনুর রশীদ এর সঙ্গে প্রত্যেকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গেলেও সম্পর্কের কোনো অবনতি হয় না। মামুন ভাইয়ের সঙ্গে প্রত্যেকের সম্পর্ক অক্ষুণ্ন থাকে। যতো অভিনেতা অভিনেত্রী মামুন ভাইয়ের হাত ধরে জীবনে সফল হয়েছেন তার হিসাব মিলবে না। কিন্তু মামুন ভাই একজন নির্বিকার, উদাসীন কবি ধরনের মানুষ। নিজে নাট্যকার। কিন্তু শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির তিনি চিরসখা। চিরবন্ধু। সেই কারণেই মামুনুর রশীদ আমাদের বন্ধু। আমাদের গুরু। গুরু কোনো দক্ষিণাই গ্রহণ করেন না।
কেবলমাত্র সোমরসের পাত্র। হুইস্কি ও ভদকা তার বড় প্রিয়। সবচেয়ে বেশি প্রিয় তার বই। নানা ধরনের বই তিনি পড়েছেন। মামুনুর রশীদকে রাক্ষস পাঠক বলা যেতে পারে। হেন বিষয়ের বই নাই যে বই তিনি উল্টে পাল্টে দেখেননি। বাংলা কবিতা ও ছোটগল্প পড়েছেন অসম্ভব মনোযোগ দিয়ে। নাট্যসাহিত্যের কথা বাদ দিলাম। বাংলা নাট্যসাহিত্য প্রায় তার মুখস্ত। মাইকেল মধুসূদন, শম্ভু মিত্র, ডি এল রায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মনোজ বসু, গিরীশচন্দ্র ঘোষ, শাঁওলী মিত্র, উৎপল দত্ত এদের নাটকের বই ও ডায়লগ এখনও যেন মুখস্ত বলতে পারেন মামুনুর রশীদ। দেশ বিদেশে মামুন ভাইয়ের বন্ধুর অভাব নাই। বয়স বিভাজন করেন না। যাকে ভালো লাগে, যার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, পানাহার করে মন ভরে যায় তারাই মামুনুর রশীদের প্রিয়তম বন্ধু।
নির্মলেন্দু গুণ এর স্মরণীয় আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম আমার কণ্ঠস্বর। অসাধারণ অবশ্য পাঠ্য গ্রন্থ। এই বইয়ের সিংহভাগ বন্ধু মামুনুর রশীদ। অবর্ণনীয় দারিদ্র্যের সঙ্গে তাদের লড়াই। মামুনুর রশীদের সঙ্গে হাতিরপুলে থাকেন কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং কবি আবুল হাসান। এদের প্রতিপালন করেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। গল্পের মতো সত্যি কাহিনি। কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হবে। পাঠক, আমার কণ্ঠস্বর পড়ে নেয়াই উত্তম। মামুনুর রশীদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের অন্যতম প্রধান নাট্যকার। সময় অসময়, এখানে নোঙর এসব নাটক তো এখন ইতিহাসের অংশ। টেলিভিশনের অনেক সফল নাটকের সফল নাট্যশিল্পী তিনি।
এসব তো মামুনুর রশীদের দৃশ্যগ্রাহ্য উপরি কাঠামো। কিন্তু ভেতর কাঠামোর মামুনুর রশীদ অন্যরকম মানুষ। প্রচণ্ড সাংগঠনিক। প্রচণ্ড মানবিক। কেউ সাহায্যের প্রয়োজনে মামুনুর রশীদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছলে সহায়তা কিছু পাবেই। সারাজীবন পরোপকার করেছেন। ভর্তি ফি, মেস ভাড়া, চিকিৎসা ব্যয় এসব কতোজনের যে করেছেন তার কি কোনো হিসেব করা সম্ভব? নাটকের ছেলেমেয়েরা তার প্রাণ। যে দলেরই হোক যেখানেই নাটক করুক মামুনুর রশীদ প্রত্যেককেই অন্তর থেকে ভালোবাসেন। আমার সঙ্গে মামুন ভাইয়ের বন্ধুত্ব কি করে তৈরি হলো সে স্মৃতি মনে নেই। আমরা ছাত্রবয়স থেকেই মামুনুর রশীদের খুব ভক্ত। ‘আমার কণ্ঠস্বর’ পড়ার পর গভীর অনুরক্ত হয়ে গেলাম। আমার বন্ধু শিরীন বকুল তখন ‘মানুষ’ নামে রিপারটেরি নাটকে অভিনয় করে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটানা তিনদিন, পাঁচদিন ‘মানুষ’ মঞ্চস্থ হয়। আমরা তখন কর্মসূত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে জড়িত। মামুন ভাইয়ের সঙ্গে কখনও দেখা হয়। আড্ডা হয়। আহমেদ মাযহারের বাসায় শুক্রবারে মামুন ভাই আসেন। তুষার খান আসেন। পানাহার চলে। বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল।
মামুনুর রশীদ আপাদমস্তক কম্যুনিস্ট। প্রতি বছর পয়লা মে শহিদ মিনারে মে দিবস পালন করেন। একবার কুরবানির ঈদের পরদিন মে দিবস। আমি কুরবানি বিষয়টা ধরে একটা স্বরচিত ছড়া পাঠ করেছিলাম।
আরেকবার মামুনুর রশীদের সাথে তার জন্মস্থান টাঙ্গাইলে গিয়েছিলাম। ভাসানী হলে আরণ্যকের অনুষ্ঠান। টাঙ্গাইলে মামুনুর রশীদের বাসায় নৈশভোজ। মামুন ভাই অসাধারণ এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন ভাসানী মঞ্চে। সেদিনের কথা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। মনে পড়ে সেই স্মৃতি। মামুনুর রশীদ এর সঙ্গে বহু আড্ডার স্মৃতি আছে আমাদের বাসায়। আমি ছোটখাট এক বই সংগ্রাহক। মামুন ভাই এই বিষয়টা খুব পছন্দ করেন। মামুন ভাই স্বল্পাহারী। সর্বভূক। আমি নিজ হাতে মামুনুর রশীদকে নানা স্বাদের মাছ রান্না করে খাইয়েছি। এ আমার জীবনের অন্যতম সাফল্য। গুরুসেবা যাকে বলে। মামুনুর রশীদ আমার প্রকৃত গুরু।
এমন মানবিক সাংস্কৃতিক পরার্থপ্রিয় ব্যক্তিত্ব খুব বেশি নেই। গুরুর দীর্ঘজীবন কামনা করি।