প্রিন্সেসের এখন নতুন সংসার। সে আবার মা হয়েছে। ডিম থেকে ফুটেছে ছানা। দূর্লভ ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও প্রজাতির পাখি প্রিন্সেস। প্রিন্সের সাথে প্রিন্সেসের সুখের সংসার ভেঙেছে তিন বছর আগে। একাকী জীবন ছিল প্রিন্সেসের। প্রায় দুই বছর আগে আর্জেন্টিনা থেকে আনা হয় আলেকজান্ডারকে। প্রিন্সেস প্রথমে মেনে নেয়নি আলেকজান্ডারকে। ম্যাকাও পাখি সাধারণত আজীবন একই সঙ্গীর সাথে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা ভুল প্রমানিত হয়েছে। আর সেই ভুল প্রমান করেছেন পাখি গবেষক ড. আবদুল ওয়াদুদ।
নানা ছলাকলায় প্রিন্সেস ও আলেকজান্ডারকে এক করতে হয়েছে। নানা আয়োজন করে নতুন করে জুটি বাধিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রিন্স ও প্রিন্সেস আলাদা হওয়ার পর এই ছলাকলার আশ্রয় নিতে হয়। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছেন। দুঃচিন্তা ছিল প্রিন্সকে নিয়ে যাওয়ার পর। প্রিন্স এখনও একাই রয়ে গেছে। কিন্তু সঙ্গী বেছে নিয়েছে প্রিন্সেস। আর সেই নতুন ঘরেই ফুটলো নতুন ছানা। নতুন সংসার শুরু করেছে প্রিন্সেস।
প্রিন্সেস ও আলেকজান্ডারের অভিভাবক বা পরিচালক ড. ওয়াদুদ। চ্যানেল আইকে ড. ওয়াদুদ বলেন, প্রিন্সেস বাংলা ভাষা বোঝে, আর আলেকজান্ডার বোঝে স্পেনিশ। নতুন পরিবেশ ও ভাষাগত পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়তে অনেক বেগ পেতে হয়ছে। সহসা বন্ধুত্ব হয়নি। এ প্রজাতির পাখির মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। তাদের সকাল বিকাল কাউন্সিলিং করতে হয়েছে। আলেকজান্ডারকে প্রথমে প্রিন্সেস শব্দটি শেখানো হয়। সে স্ত্রী পাখির নাম ধরে ডাকত। প্রিন্সেস আড় চোখে তাকাত। দুই খাঁচায় পাশাপশি কিছুদিন রাখার পর তাদেরকে যখন এক খাচাঁয় আনা হয় তখন একে অপরকে আক্রমণ করত। তখন বাতাস ও ঝরনার মাধ্যমে পানির সমন্বয় ঘটিয়ে কৃত্রিম ঝড়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। তারা আতংকিত হয়ে এক অপরের কাছে আশ্রয় খুঁজত। এ ভাবে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ায়।
আলেকজান্ডারের সঙ্গী হওয়ার দুই বছর পর প্রিন্সেস ২০১৫ সালের মে মাসে এক সাথে সাতটি বাচ্চা দিয়েছিল। তারপর অসুস্থ হয়ে পরে প্রিন্সেস। এ জাতীয় পাখি বছরে দু থেকে তিন বার ডিম থেকে বাচ্চা দেয়। কিন্তু প্রিন্সেস গত দু বছর ডিম দেয়নি। এজন্য পাঁচ সদস্যের চিকিৎসক বোর্ড গঠন করা হয়। হংকং এর ভেটেনারী সার্জন লি চিন এর পরামর্শে খাবারে পরিবর্তন আনা হয়। এতে প্রিন্সেস আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে। ডিম পাড়ে। আঠাশ দিন পরে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে।
মা ও ছানা বর্তমানে সুস্থ আছে। তাদের দেশি ও বিদেশী বিভিন্ন খাবার দেয়া হচ্ছে। খাবারের তালিকায় আছে, বিভিন্ন চীনা বাদাম, কাঠ বাদাম, পেস্তা, কাজু বাদাম, সূর্যমূখী ফুলের বীচি, ভেজানো ছোলা, সেদ্ধ ভুট্টা। ফলের মধ্যে আছে, আপেল, আঙ্গুর, আখ, খোরমা, নেশপতি, পেপে, তরমুজ, পাকা পেয়ারা, কলা। তরল খাবারের মধ্যে আছে, ক্যাটেল ফিস বোন, গ্রীট, বেলে মাটি ও বিদেশী প্যাকেটজাত খাবার।
এখন প্রিন্সেস ও আলেকজান্ডার ব্যস্ত সার্বক্ষণিক ছানাদের নিয়ে। দুজনেই বার বার বাসা থেকে বের হয়। মুখে খাবার নিয়ে আবার বাসায় ঢুকে বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাসার আশেপাশে কাউকেই ভিড়তে দিচ্ছে না। খাঁচার মধ্যে কেউ প্রবেশ করতে গেলেই তেড়ে আসে।
২২/২, হাতিরপুলে অবস্থিত ফিকামলি সেন্টারের মিনি চিড়িয়াখানায় অন্য অনেক পাখি ও প্রাণির সাথে ভালই দিন পার করছে প্রিন্সেসরা। প্রিন্স ও প্রিন্সেস এর মালিক দুজন। পুরুষ পাখি প্রিন্সের মালিক ইকরাম সেলিম ও মেয়ে পাখি প্রিন্সেসের মালিক ড. ওয়াদুদ। ঘটনা শুরু ২০১০ সালে। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ইকরাম সেলিম তার পাখিটি ড. আবদুল ওয়াদুদকে উপহার দেন। তিনি প্রিন্সের জন্য একটি সঙ্গী খুঁজে নিয়ে আসেন ব্রাজিল থেকে। মিল রেখে তার নাম রাখেন প্রিন্সেস। সেই থেকেই সংসাদ শুরু করে প্রিন্স ও প্রিন্সেস। তিন বছরের সুখের সংসারে তাদের চার বারে মোট সাতটি বচ্চা হয়। শুধু বাংলাদেশে নয় দক্ষিণ এশিয়ায় এর আগে ম্যাকাও পাখির বাচ্চা হওয়ার কোন নজির জানা নেই। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান অববাহিকার গভীর জঙ্গলের পাখি ম্যাকাও বড় বড় পাইন গাছে বাসা বাধে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও তাপমাত্রায় বিশেষ ব্যবস্থায় ড্রামের মধ্যে বাচ্চা ফোটানো হয়।
ইকরাম সেলিম উপহার হিসাবে দেয়া প্রিন্সকে তিন বছর পর ফেরত চায়। আর তখনই বাধে জটিলতা। প্রথমে থানায় পাল্টাপাল্টি সাধারণ ডায়েরি। পরে ঘটনা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। নির্বাহী মেজিষ্ট্রেটের আদেশ বলে প্রিন্সেসের কাছ থেকে তার প্রিয় সঙ্গী প্রিন্সকে নিয়ে যায় ইকরাম সেলিম। পাখির সংসার রক্ষায় উচ্চ আদালতে রিভিশন মামলা দায়ের করেন ড. ওয়াদুদ। আদালত আদেশ দিয়ে পাখি দুটিকে আলাদা করেছে। পাখির সংসার রক্ষায় হলো আইনী লড়াই। বর্তমানে প্রিন্সের বাস বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এবং প্রিন্সেসের ২২/২, হাতিরপুলের ফিকামলি সেন্টারের মিনি চিড়িয়াখানায়। একই শহরে থেকেও মালিকানার দন্দ্বে ও আইনী জটিলতার কারণে তারা একত্রে বসবাস করতে পারছে না।
ড. আবদুল ওয়াদুদ প্রিন্সেসের জন্য উপযুক্ত বয়সী পুরুষ পাখির খোঁজ করতে থাকেন। অবশেষে আর্জেন্টিনা থেকে নিয়ে আসেন পাখি। নাম রাখেন আলেকজান্ডার। প্রথম দিকে প্রিন্সেস আলেকজান্ডারকে একেবারেই সহজভাবে গ্রহন করেনি। তাকে প্রথম দেখেই রুদ্র মূর্তী ধারন করে। স্বভাবে আলেকজান্ডার অত্যান্ত নিরীহ প্রকৃতির। প্রিন্সেসের অনেক জ্বালাতন সহ্য করতে হয়েছে তাকে। প্রিন্সেস প্রায়ই তাকে আক্রমন করত। তার পা ও পালক অনেকসময় কামড়িয়ে জখম করে দিত।
রং, রূপ সৌন্দর্য্যরে জন্য ম্যাকাও পাখি প্রেমিকদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকাংক্সিখত পোষা পাখি। এদের আয়ুস্কাল ষাঁট থেকে সত্তর বছর। একবার জোড়া বাধার পর আমৃত্যু এক সঙ্গে থাকে। তাই প্রিন্সের সাথে বিচ্ছেদের পর আবার নতুন করে আলেকজান্ডারের সাথে জোড়া বাধায় যথেষ্ট সংশয় ছিল। যা এখন কেটেছে।