আমার প্রাণের শহর রাজশাহী। আমার জীবনের সকল ভালবাসার মধ্যে রাজশাহীও অন্যতম। আমার জীবনের ২০টি বছর কাটে এই শহরে। বিশেষত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস; আমার ক্রমবিকাশের ধারায় সবুজে ঘেরা বিস্তীর্ণ মুক্তাঙ্গনের অবদানকে আমি কোনভাবেই অবহেলা করতে পারি না। আমার জীবনের প্রতিটি চলাচল থেকে শুরু করে আমার চাহনিতেও রয়েছে এই অঞ্চলের এবং এই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের প্রভাব।
এখনো মনে পড়ে, ওইদিনটির কথা যেদিন আমি দীর্ঘদিনের জন্য প্রিয়প্রাঙ্গন ছেড়ে ঢাকায় পড়তে আসি। এখনো ওই দৃশ্যটি আমার মনের ভেতর রঙিন যখন বাসের জানালা দিয়ে দেখতে পাই আমার বাবা চোখ মুছছে আর হাত নাড়ছে। তখনই আমার উপলব্ধিতে আসে এই যাওয়াই শেষ যাওয়া, এরপর আসতে হলে তা শুধু ছুটি-ছাটায় বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। হয়তো ব্যস্ততার চাপে ভবিষ্যতে তাও হবে না। এই ভেবেই অর্ধেকটা পথ পর্যন্ত ফুঁপিয়ে কাঁদি। বলতে একটুও দ্বিধা নেই – আমি রাজশাহীকে এখনো আমার প্রথম প্রেমের মতই ভালবাসি আর দূরত্বের অনুভূতির কারণে হয়তো এই ভালবাসাটা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বাবার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পরিবারের সকলের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে প্রায় জেদের বশেই আমি রাজশাহীর ভাড়া বাসাটা রেখে দেই কারণ কোনভাবেই রাজশাহীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। যে স্থানে নিজের থাকার জন্য একটা কুটিরও অবশিষ্ট থাকে না, সেই স্থানের সাথে আসলে সম্পর্ক রাখাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে যদিও পরবর্তী সময়ে আর্থিক কষ্টের কারণে বাসাটা ছাড়তে বাধ্য হই এবং নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রাজশাহীর সাথে সম্পর্কটিকে শিথিল হতে প্রশ্রয় দেই। সেটা বাধ্য হয়েই। এখনো আমার ইচ্ছা শেষ বয়সে মাতৃতুল্য এই শহরের কোলে ঘর করার আর এটা নিয়ে প্রায়ই আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে তর্ক করতে হয়।
রাজশাহীতে সব কিছু ভালই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু কেমন যেনো বদলে গেলো। হয়তো এই বদলটা অনেক আগেই ঘটেছে যা আমি উপলব্ধি করতে পারিনি কিংবা অবচেতন মনে উপলব্ধি করতে চাইনি।
অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুদিন পরই ব্যক্তিগত কিছু কাজে আমাকে রাজশাহী যেতে হয়। এরইমধ্যে প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর এই শহরের মতো জায়গায় হয়ে গেছে অধ্যাপক রেজাউলসহ চার-চারটি খুন। আমি থাকতে থাকতেই হয়ে গেল স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে ভয়াবহ ডাকাতি।
রাজশাহীতে নেমেই শহরটির যে রূপ আমাকে দেখতে হলো তা কল্পনাতীত। এরকম থমথমে রাজশাহীকে আমি কখনো দেখিনি, এই রাজশাহীকে আমি ভালবাসিনি। বাবা– অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের পরও রাজশাহীতে অবস্থান করতে কখনো আতঙ্ক বোধ হয়নি, কেন তা জানি না। এই প্রথম যেন রাজশাহীকে মনে হলো সম্পূর্ণ অচেনা এবং ভয়ঙ্কর।
শহরের বাইরে থেকে ধর্মভিত্তিক কিছু ছাত্রসংগঠনের তৎপরতার কথা অনেককে বলতে শুনেছি। অধ্যাপক ইউনুস হত্যার আগে তাদের তৎপরতা যে কখনো কোন অধ্যাপককে হত্যা পর্যন্ত যেতে পারে তা কেউ কল্পনা করেনি।
আমার বাবাসহ প্রগতিশীল ধারার শিক্ষকদেরকে ভাবতে দেখেছি যে এদের কর্মকাণ্ড শুধু হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, শিক্ষককে আঘাত করার মতো সাহস হয়তো তারা করবে না। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষকসমাজের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়াতে দেখেছি কিন্তু সমগ্র রাজশাহীর এই রূপ কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
একটা সময় এই শহরের অপরাধ বলতে ছিঁচকে চুরিই প্রধান ছিল। অঘটন ছিল– কোন বাড়ির পর্দা চুরি, চাদর চুরি আর খুব বেশি হলে গরাদ কেটে খালি বাসার জিনিসপত্র চুরি। সেসময় মনে আছে, কারো ছিনতাই হলে লোকে তাকে দেখতে যেত। হ্যাঁ আমি এই রাজশাহীরই কথা বলছি যে রাজশাহীতে ৪৮ ঘণ্টায় ঘটে যায় ৪টি হত্যাকাণ্ড, যেখানে ব্যস্ত এলাকায় ঘটে যায় ডাকাতি, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, যেখানে কোপানোটা বর্তমানে মুখের কথা মাত্র। কিন্তু হঠাৎ করে বসবাসের জন্য সর্বোপযোগী এই অঞ্চলটি এরকম অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠলো কেন, তা কি ভেবে দেখেছি?
এক্ষেত্রে বাবার একটা কথা খুব মনে পড়ছে। তখন ছোট ছিলাম, রাজশাহীর এই আপেক্ষিক উন্নয়নকে অনেক বড় কিছু মনে হতো। বাবাই একদিন বললেন রাজশাহীর এই উন্নয়নটা অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে। একদিকে উঁচু-উঁচু দালানকোঠা উঠছে আর অন্যদিকে সমাজের একটি শ্রেণিকে বর্জন করা হচ্ছে। বস্তুত ঢাকার মতো অবস্থা না হলেও ক’দিন পর এই শহরে আকাশ দেখতে হলে উঁচু দালানের ছাদে উঠতে হবে। চারিদিকে উঠছে সব অ্যাপার্টমেন্ট, কন্ডোমিনিয়াম, শপিং কমপ্লেক্স, ডুপ্লেক্স, ট্রিপ্লেক্স ইত্যাদি নানা ধাঁচের দালানকোঠা আর একই তালে বাস্তুহারা হচ্ছে এই শহরের ঐতিহ্য ও একশ্রেণীর মানুষ। যেভাবে রেশমপট্টির পুরোনো সব বাড়িঘরগুলো সিটি কর্পোরেশনের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভেঙে ফেলা হচ্ছে তা দেখে মনটা কেঁদে ওঠে।
আবার অন্যদিকে প্রকৃতি, মাঠঘাটকে অবহেলা করে বর্তমান প্রজন্মের সময় কাটানোর এবং আড্ডা দেওয়ার স্থান হয়েছে নগরের বিভিন্ন কোণে গজিয়ে ওঠা রেস্তোরাগুলো। খাবার কিংবা রেস্তোরার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই, নিশ্চিত করে বলতে পারি যদি তা শুধু ভোজনের উদ্দেশ্যকেই রক্ষা করে। রাজশাহীতে এসকল রেস্তোরার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। প্রকৃতি আর তার সান্নিধ্যে শরীর ও মনের সুষ্ঠু বিকাশটিও নিশ্চিত হয়। অথচ ঢাকার দেখাদেখি আধুনিকতা ও স্ট্যাটাসের সহায়ক বলে গৃহীত হচ্ছে এসকল ব্যাপার-স্যাপার। এগুলোর সাথে সরাসরি জড়িয়ে রয়েছে অর্থ বিনিময়ের সম্পর্ক আর এই লেনদেনে সক্ষম হতে প্রয়োজন পরিকল্পিত কর্মক্ষেত্র যেখানে সকল শ্রেণীর অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, যা রাজশাহীতে নেই বললে ভুল হবে না। সেক্ষেত্রে এরকম একটি বৈষম্যপূর্ণ সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
এবার আসি দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে। আমি সারা দেশের পরিস্থিতির কথা বলতে পারব না, যৌক্তিকভাবে তা বলতে গেলে হয়তো একটি বই প্রকাশ করতে হবে। আমি আপাততঃ রাজশাহীতে ঘটে যাওয়া অধ্যাপক হত্যাকাণ্ডের কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করব।
আমার বাবা- অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের পরপরই একদিকে পুলিশ বলেছে, এই ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততার ব্যাপারে তারা সুনিশ্চিত। অপরদিকে হঠাৎ র্যাব কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে জানালো এরাই খুনি। মেনে নিলাম এরাই এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত কিন্তু খুনের উদ্দেশ্যটা তো তারা পরিষ্কার করেতে পারছে না, আমার জীবনকালে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। অন্যদিকে বাবাকে বহন করা অটোরিক্সাচালকের কাছে জানতে পারি তাঁকে আহত অবস্থায় র্যাবের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু সেখান থেকে কাটা স্থানে একটি কাপড় জড়িয়ে দেওয়া ছাড়া কোন সাহায্য করা হয়নি। আবার অনেকক্ষেত্রে তারা এই হত্যাকাণ্ডটিকে “accidentally killed” বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।
আচ্ছা, একজন মানুষের শরীরের অন্য কোথাও না, মাথা এবং ঘাড়ে ৫টি কোপ দেওয়ার পর ঘটনাটিকে আর যাই হোক “দৈবক্রমে হত্যা” বলা চলে না। সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা ও দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতার ব্যাপারে কিছু বলা উচিত।
বাবার হত্যা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এরকম দায়সারা আচরণ অধ্যাপক রেজাউল হত্যাকাণ্ডকে অনুপ্রাণিত করে বলে আমার সচেতন ও সুচিন্তিত অভিমত। হয়তো সে মুহূর্তে আমার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজে থেকে এই বিষয়ে মামলা করে এবং তারপর থেকেই দেখা যায় তাদের দায়সারা আচরণ। সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্য প্রশাসন থেকে নেই কোন চাপ, বিভিন্ন সময়ে আমাকেও প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকার পরামর্শ দেন। সেটা কি করে সম্ভব! যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি আমার বাবা আর তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়াটা অযৌক্তিক?
যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে সুবিচারের আশা করাটাও অপরাধ বলে মনে হয় মাঝেমাঝে। খবর থেকে জানতে পারলাম এই মামলার জন্য রা.বি প্রশাসনের লিগ্যাল সেল থেকে কোন আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলার বাদী রেজিস্ট্রার এনতাজুল হক জানান, একজন বাদী প্রয়োজন বলেই তিনি মামলার বাদী হয়েছেন, কিন্তু মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এরকম অবস্থায় সুষ্ঠু তদন্ত এবং সুবিচারের আশা করাটা একটি আকাশকুসুম চিন্তা।
অন্যদিকে অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের পর ইংরেজি বিভাগের অনেক শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে পারি, বিভাগ আয়োজিত এক শোকসভায় উপাচার্য হয়তো শোকার্ত ও আবেগ তাড়িত হয়ে বলেছেন, এই বিচার আদালত করতে না পারলে, প্রকৃতি এর বিচার করবে। যারা এই খুনের সাথে জড়িত তারা শেষ বয়সে পাগল হয়ে মারা যাবে। কতদিনে খুনিদের শেষ বয়স আসবে আর কতদিনে প্রকৃতি তাদের বিচার করবে, সেই অপেক্ষায় রাজশাহীবাসী বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় পাগল হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
উপাচার্যের এরকম অসচেতন বক্তব্য অনেকক্ষেত্রে তদন্তে গাফিলতি ও প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতে প্রশ্রয় দান করে। তাছাড়া এ ধরণের বক্তব্য দেশের বিচারহীনতাকে সমর্থন করে, এ ধরণের হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা বাড়ায় যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)