কারখানা এবং ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) নামক আইনে অনেকগুলো আত্মঘাতি প্রস্তাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ আইন আন্তর্জাতিক অগ্নি নিরাপত্তা আইনেরও পরিপন্থি। তাই এগুলোর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, নতুবা দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না।
বুধবার রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে শ্রমিক নিরাপত্তা ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-২০১৭ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ ও অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
ওই সভায় প্রস্তাবিত বিএনসিবি অগ্নি নিরাপত্তার জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হাসমতুজ্জামান বলেন: এই আইনে অবশ্যই সংশোধন করা জরুরী। খসড়া এই আইনে কারখানায় ফায়ার হাইড্রেন্টের (রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল) পরিবর্তে এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র) ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে দুটোই দরকার।
‘অগ্নি বিপদ সতর্কীকরণের জন্য ম্যানুয়েল ফায়ার এলার্ম সিস্টেম রাখতে বলা হয়েছে আইনে, যা ধোঁয়া বা আগুনের সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো সতর্কতা সংকেত দিতে পারবে না। এতে অনেক প্রাণহানী ঘটবে,’ এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এই অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন: ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে ৮০ মিটিার বা ২৬ তলা পর্যন্ত উঁচু ভবনে ফায়ার হাইড্রেন্ট তথা- ফায়ার পাম্প, জলাধার লাগবে না। শুধু ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলে চলবে। একতলা ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা কোড লাগবে না। কিন্তু এই প্রস্তাবগুলো আন্তর্জাতিক অগ্নি আইনের পরিপন্থি।
এ ধরনের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া উচিত বলে জানান তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন: ভবনের নিরাপত্তার সাথে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। অতএব শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্নি নিরপত্তা বা ফায়ার সেফটি জরুরি। দেশের পোশাক পণ্যের ব্র্যান্ড ধরে রাখতে হলে এর বিকল্প নেই।
তাই ভবিষ্যতে শ্রমিক নিরাপত্তা শুধু পোশাক কারখানায় নয়, ব্রয়লার, প্লাস্টিক কারখানাসহ সব খাতে নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান এই গবেষক।
বর্তমানে কারখানাগুলোতে নিরাপত্তার বিষয়গুলো আগের মত মনিটরিং হচ্ছে না মন্তব্য করে সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন: যেসব কারখানায় অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স তদারকি করেছে, এখন সেগুলোতে নিয়মিত তদারকি হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। এজন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ও ন্যাশনাল ইন্সপেকশন ঠিকমত কাজ করছে কিনা তা দেখা দরকার। আর যেন আগুনের ঘটনা না ঘটে, কোনো শ্রমিক যেন মারা না যায়। সেজন্য তদারকি নিয়মিত রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডকে (বিএনবিসি) সংশোধন করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন: এই আইনকে আরো যুগোপযোগী করতে হবে। এটিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। ব্রয়লার, টেক্সটাইল, লেদার, হাইরেঞ্জ ভবনসহ সব ধরনের ভবন ও কারখানায় নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস সম্পর্কে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন: ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বের বিষয়ে ২০০৩ সালের যে আইন রয়েছে তা সংশোধন করা দরকার। কারণ আগুনের ঘটনা ঘটলে বর্তমানে ১ থেকে ৬ তলা পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের অধীনে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করা হয়। আর ১০ তলার ভবনের বিষয়ে সরাসরি পরিচালনা করে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু ৭ থেকে ৯ পর্যন্ত এই ভবনের দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের সম্পাদক কবির হোসেন বলেন: পোশাক মালিকদের অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে ধারণা কম। এ কারণেই বারবার দুর্ঘটনা ঘটে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের চাপে সবাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু নিজ থেকে কেউ উদ্যোগে নেয়নি। এটাতে মালিকেরা আগ্রহী নয়। অথচ তারা বুঝে না যে, তাদের টিকে থাকার জন্য এটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নতুন কারখানাগুলোকে অবশ্যই ভবন নির্মাণের কোড মেনে স্থাপন করতে হবে।
কারখানায় শ্রমিকদের বিভিন্ন হয়রানির কথা তুলে ধরে শ্রমিক নেত্রী শান্তনা ইসলাম বলেন: যতদিন মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ইউনিয়ন গঠিত না হবে ততদিন পর্যন্ত কারখানায় আগুন লাগবেই। এজন্য দরকার সঠিক ট্রেড ইউনিয়ন।
তিনি জানান: নিয়োগের সময় মালিকেরা বলেন, তুমি কি কোনো ট্রেড ইউনিয়নে আছ? সত্য কথা বল। তোমাকে ২শ’ টাকা বেতন বাড়িয়ে দেব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যখন শ্রমিক স্বীকার করে যে, হ্যাঁ ইউনিয়নে যুক্ত আছি। তখন আর তাকে নিয়োগ দেয়া হয় না।
অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম, পোশাককর্মী, পোশাক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এনজিও ও স্থার প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।