বিয়ের জন্য আগের মতই মেয়েদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর আর ছেলেদের ২১ বছর বয়স হওয়ার শর্ত রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ করার প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
তবে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে এবং বাবা-মায়ের সমর্থনে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ রাখা হচ্ছে এই আইনে।
বিশ্বের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ মেয়েদের বিয়ের বয়স ২১ করার কথা ভাবলেও ১৮ নিয়ে খুব বেশি আপত্তি নেই কারো। কিন্তু মূল আপত্তির জায়গা ওই ‘তবে’ অংশটুকু নিয়েই।
এই অংশটুকুর মধ্যে দিয়ে বাল্যবিবাহকেই আরো বেশি প্র্রশ্রয় দেওয়া হলো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আইনে নারীর সুরক্ষায় অনেক অনেক বিধান আছে। কিন্তু আইনে বিধান থাকা সত্বেও আইন চাইলেও যখন নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না, সেখানে এই বিশেষ বিধানতো নারীদের আরো বেশি অরক্ষিত করবে।
“আমরা শত চেষ্টা করেও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হারের লাগাম টানতে পারছি না। বিয়ে হচ্ছে মানেই ওই শিশুটি প্রসূতি হয়ে পড়ছে, ফলে অনাগত শিশুটিও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই একটা জায়গায় আমরা থমকে গেলাম।”
বিয়ে দিয়ে কখনোই নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বাল্যবিয়ের কত শতাংশ প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে হয়? বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি পরিসংখ্যান বলছে ৮০ শতাংশ নারী ঘরের ভেতরেই নির্যাতিত হয়। সেখানে বিয়ে দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করার যুক্তি খুবই খোঁড়া যুক্তি। এই আইনটি সবধরনের নারী অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা নারীর জন্যও একটি পশ্চাৎপদ একটি পদক্ষেপ।
মানবাধিকার আইনজীবী এলিনা খান মনে করেন- আইনটা এভাবেই রাখলে সেটা একটা কালো আইন হবে। ১৮তেই মানুষ ভোটাধিকার পায়। ১৮এর আগেতো সবাই শিশু। তাহলে সেখানে বিশেষ বিধানে বিয়ের সুযোগ থাকবে কেন? এই সুযোগের অপব্যবহার অনেকেই করবে। বাল্যবিয়ের ফলে শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি হতে পারে। এই ধরনের বিয়েকে তাই একবাক্যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখতে হবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র দ্বিনীতি প্রকাশ করলে সেটার অপব্যবহার হবেই।
নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক বলেন, ১৯২৯ সালে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ ধরা হয়। এত আগে দেশ এত প্রগতিশীল একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাহলে এই পর্যায়ে এসে এত পশ্চাৎপদতা কেন? আমি তো মনে করি এই সময়ে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ২১ হওয়া উচিত। ১৮ এর আগে কোনো মেয়ের বিয়ে কিভাবে হতে পারে! এর আগে সবাই শিশু। এই বয়সে এসেই তো মানুষ প্রথম ভোটাধিকার পায়। এই ধরনের আইন তৈরিতে যেসব বিশেষ পরিস্থিতির কথা বলা হচ্ছে, যেমন প্রেম করা, পালিয়ে বিয়ে করা বা প্রসূতি হয়ে পড়া সেই হার কিন্তু খুবই কম। বাল্যবিয়েটা মূলত ঘটে থাকে তিনটি কারণে, এক পরিবারের চিন্তার পশ্চাৎপদতা, দুই অর্থনীতি, অর্থাৎ এই চিন্তা করা যে পরিবারে খাওয়ার লোক অন্তত একজন কমলো। এবং তিন সামাজিক অবক্ষয় যেমন বখাটের অত্যাচার ইত্যাদি কারণে। সেসব থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হবে। ১৮ বছর বয়সের আগেই একটি মেয়ের বিয়ে মানে বিয়ে হওয়া ওই শিশুকন্যাটি একটি অপরিণত শিশুর জন্ম দিবে। সরকার নিজেই আইন করবেন আর সরকারই সেটা লংঘন করবে সেটা কেমন কথা!
বিয়ের বয়স ১৮ই হোক। কিন্তু সেখানে কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় বিয়ের সুযোগ না থাক সেটাই চান সংশ্লিষ্টরা। তা না হলে বিগত সময়গুলোতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুগের পর যুগ ধরে করে চলা চিৎকার নিমেষেই ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে।