একাধিক সন্তানের পিতা আর পিতার একাধিক সন্তানের হত্যাকারী মেজর রাশেদ চৌধুরী তার সন্তানদের সঙ্গে বিলাসী জীবন যাপন করছে যুক্তরাষ্ট্রে। এটা সম্ভব হয়েছে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার জন্য। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সেক্রামেন্টো থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে কন্ট্রা কস্তা কাউন্টির কনকর্ড শহরে থাকে রাশেদ চৌধুরী।
প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশী তার বিষয়ে খোঁজ করে জানিয়েছেন, রাশেদ চৌধুরী ছাড়াও তার স্ত্রী মমতাজ চৌধুরী, বড় ছেলে রূপম চৌধুরী এবং ছোট ছেলে সুনম চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে।
রূপম চৌধুরীর স্ত্রী কাজল চৌধুরী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান। কাজল চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বড় পদে চাকুরি করছে। বড় ছেলের স্ত্রীই খুনি রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে সহায়তা করেছে বলে ধারণা করেন ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু নাসের রাজীব।
রাশেদ চৌধুরীর ছোট ছেলের স্ত্রীও মার্কিন নাগরিক।
বড় ছেলে রূপম চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এওএল কোম্পানির মার্কেটিং ডিরেক্টর। রূপমের মতো ছোট ছেলে সুনম চৌধুরীও বাংলাদেশের করদাতাদের টাকায় বিদেশী নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছে।
সেখানকার বাংলাদেশী কয়েকজন জানতে পেরেছেন, বড় ছেলের দু’ সন্তান, আর ছোট ছেলের সন্তান সংখ্যা এক। সুনম চৌধুরীর বাড়ি এলগ্রোভ শহরে। এলগ্রোভ যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসবহুল শহরগুলো অন্যতম। এলগ্রোভে তার নামে কেনা বাড়িটি রাশেদ চৌধুরীর টাকাতেই কেনা। যুক্তরাষ্ট্রে যখন রাশেদ চৌধুরীর বৈধ কাগজপত্র ছিলো না, তখন বাড়িটি ছোট ছেলের নামে কেনা হয়।
তবে রাশেদ চৌধুরীরা নির্দিষ্ট একটি শহরে অবস্থান করে না বলে রাজীব জানান।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পর্যটক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় রাশেদ চৌধুরী। তখন থেকে মিসৌরি, ক্যালিফোর্নিয়া, ইলিনয়, মিশিগানসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে তার অবস্থান ছিলো।
‘তবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রে এই পরিবারের অবস্থান সম্পর্কে জানেন না,’ বলে মন্তব্য করেন আবু নাসের রাজীব। তিনি মনে করেন, রাশেদ চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা উচিত। যাতে পলাতক জীবনেও এরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
তারপরও মাঝেমধ্যে দুয়েকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে রাশেদ চৌধুরীর ধাওয়া খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে।
গত এপ্রিলে বাঙালিদের এক অনুষ্ঠানে তোপের মুখে পড়ে রাশেদ চৌধুরী। পরে ওই স্থান থেকে তাকে পালিয়ে যেতে হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সেক্রামেন্টোতেই ঘটে এ ঘটনা।
সেক্রামেন্টোর একটি লাইব্রেরিতে বাংলা বর্ষবরণের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া করছিল শিশু-কিশোররা। অনেকের বাবা-মাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রাশেদ চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হলে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু নাসের রাজীব তাকে চিনতে পেরে তার দিকে তেড়ে যান। এতে ভয় পেয়ে ওই জায়গা থেকে দ্রুত সে পালিয়ে যায়।
জাতির জনকের খুনিকে দেখে নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি বলে জানান একসময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করা এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবু নাসের রাজীব। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এই খুনিকে অবশ্যই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো।’
রাজনৈতিক আশ্রয়
যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরীর উপস্থিতির খবর কিছুটা পুরনো। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে মাত্র দু’দিন আগে।
গত বৃহস্পতিবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সহযোগিতা চান। রাষ্ট্রদূত তখন জানান, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রাশেদ চৌধুরী।
১৯৯৬ সালে পর্যটক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের জন্য আবেদন করে বলে জানা যায়। রাশেদ চৌধুরী ও তার পরিবারের অতীত কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রেখে ওই আশ্রয়ের আবেদন যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিকভাবে অনুমোদন করে। সবকিছু জেনেও সম্প্রতি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অবশ্য তার পরও রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদী।
‘উচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেলেও তা প্রত্যাহারের আবেদনের সুযোগ আছে। সেটাও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করতে হবে,’ বলে জানিয়েছেন তিনি।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি আশা করেন, সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনবে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ৩ নভেম্বর রাতে অন্য খুনিদের সঙ্গে রাশেদ চৌধুরীও বিদেশে চলে যায়। তার আগেই কারাগারে জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করে তারা।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে রাশেদ চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দলিল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মেজর ডালিম, মেজর নূর এবং ক্যাপ্টেন মাজেদের মতো রাশেদ চৌধুরীও ৭৫’র ১৫ আগস্টের অাগে সেনাবাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত ছিলো।
মামলার ২৪ নম্বর সাক্ষী হাবিলদার আমিনুর রহমান, ২৫ নম্বর সাক্ষী নায়েক ইয়াছিন, ২৯ নম্বর সাক্ষী নায়েক সিহাবউদ্দিন এবং ৩৫ নম্বর সাক্ষী সুবেদার মেজর আনিসুল হক চৌধুরীসহ অন্যদের সাক্ষ্যে দেখা যায়, রাশেদ চৌধুরী ১৪ আগস্ট রাতে টু ফিল্ড আর্টিলারি এবং ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের নাইট প্যারেডে উপস্থিত থেকে খুনিদের একটি দলকে নেতৃত্ব দেয়।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান এবং মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ষড়যন্ত্র এবং হত্যাকাণ্ডে রাশেদ চৌধুরীর জড়িত থাকার কথা নিশ্চিত করেছে।
হত্যাকাণ্ডের জন্য যাত্রা শুরুর আগে শাহরিয়ারের মতো রাশেদ চৌধুরীও সিভিল ড্রেসে ছিলো। শাহরিয়ার জানিয়েছে, বজলুল হুদার কাছ থেকে সে এবং আজিজ পাশার কাছ থেকে রাশেদ চৌধুরী ইউনিফর্ম নিয়ে তা পরে সৈনিকদের উদ্দেশে ব্রিফিংয়ে যোগ দেয়। পরে কয়েক দলে ভাগ হয়ে তারা ৩২ নম্বর, শেখ মনির বাড়ি, সেরনিয়াবাতের বাড়ি এবং রেডিও স্টেশনের দিকে যাত্রা করে।
সুকান্ত বাবুর খুনি রাশেদ চৌধুরী
সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, সেরনিয়াবাতের বাড়িতে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছয় বছরের নাতি সুকান্ত বাবুসহ ছয়জনকে সরাসরি খুন করেছে রাশেদ চৌধুরী।
পঁচিশ নম্বর সাক্ষী নায়েক ইয়াছিন বলেন, ট্রাকটি মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির পাশে থামলে রাশেদ চৌধুরীসহ অন্য অফিসাররা ফায়ার করতে করতে বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে ট্যাংক বাহিনীর সৈনিকরা দরোজা ভেঙ্গে দোতলায় উঠে সেরনিয়াবাতসহ অন্যদের নীচে নিয়ে অাসে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইয়াছিনসহ অন্যরা দেখেন, রাশেদ চৌধুরী এবং অন্য অফিসাররা সবাইকে এক করে গুলি করে। তখন একটি বাচ্চা ছেলে কেঁদে উঠলে একজন মহিলা তার দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় আবারো গুলি করা হয়।
নিহত ওই শিশুটি ছয় বছরের সুকান্ত বাবু। অার মহিলাটি ছিলেন তার মা শাহানা আব্দুল্লাহ। সৌভাগ্যক্রমে শাহানা আব্দুল্লাহ বেঁচে গেলেও দাদা, ফুপু এবং চাচার পরিণতি বরণ করে সুকান্ত বাবুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।
প্রসিকিউশনের ২৯ নম্বর সাক্ষী নায়েক সিহাব উদ্দিনও বলেছেন, মেজর রাশেদ চৌধুরীসহ অন্য অফিসাররা সেরনিয়াবাতের বাড়িতে সবাইকে এক করে ব্রাশ ফায়ার করে।
গুলিতে বাবুসহ ছয়জন নিহত হওয়া ছাড়াও আহত হন নয়জন।
সাক্ষীদের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মেজর শাহরিয়ারও একইরকম বর্ণনা দিয়েছে। সেদিন তার গাড়িটি রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেলে তার সেরনিয়াবাতের বাড়ি পৌঁছাতে একটু দেরি হয়।
শাহরিয়ারের তারপরের বর্ণনা: ‘ভোর অনুমার ৫টার দিকে মিন্টু রোডে মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পূর্ব পাশের রাস্তায় পৌঁছি। মেজর রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোস্তফা ও অার একজন আগে থেকেই দলবলসহ সেখানে উপস্থিত ছিলো। রাশেদ চৌধুরী তখন বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে ছিলো। বাড়ির পশ্চিম পাশে গুলির আওয়াজ শুনি। জিজ্ঞেস করলে রাশেদ জানায়, আমি লোক পাঠিয়েছি। আমি এখন নিজেও যাচ্ছি। এই বলে সে বাড়ির ভেতরে যায়। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শেষ হলে ভেতর থেকে রাশেদ চৌধুরীকে আসতে দেখি।
সেই রাশেদ চৌধুরীর এখনকার অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানকার রাজনৈতিক আশ্রয়ে।