সাত বছরের কর্মস্থল থেকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে বিদায় নিলেন ড. আতিউর রহমান।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সমর্থনে উদ্যোগ (এসএমই খাত), ‘গরীবের
ব্যাংকার’, ব্যাংকিং খাতকে অন্তর্ভূক্তিমূলক করাসহ বিভিন্ন অবদানের জন্য
খ্যাত সদ্য সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রখ্যাত
গভর্নরের ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখলেও দায়িত্বের জায়গায় তার
ব্যর্থতার চিত্রটিও তুলে ধরেছেন দেশের প্রখ্যাত দুই অর্থনীতিবিদ।
মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র জমা দেন আতিউর রহমান। নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক অর্থ সচিব ফজলে কবির। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নরকে অপসারণ করা হয়। এরপর ওএসডি করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমকেও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়ে যাওয়ার এই কলঙ্কজনক মুহুর্তে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তার দায় নিয়ে আতিউরের পদত্যাগের পর তাকে নিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা সমালোচনা।
আর্থিক নীতিমালা প্রণেতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্বপালনে কতটা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পেরেছেন তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন ছুড়েছেন অর্থনীতিবিদরা তেমনি হ্যাকিংয়ের বিষয়টাকে ‘হালকাভাবে’ নেওয়ার অভিযোগও দ্য ইমার্জিং মার্কেটস কর্তৃক ২০১৫ সালে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত এই গভর্নরের বিরুদ্ধে।
পদত্যাগে সাধুবাদ, কিন্তু… বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করায় সাধুবাদ জানালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থচুরি যাওয়ার দীর্ঘ সময় পরে অর্থমন্ত্রীকে জানানোটা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন।
“বিষয়টিকে এতোটা হালকাভাবে নেয়া উচিত হয়নি। অর্থমন্ত্রী অনেক সিনিয়র একজন মানুষ। বিষয়টি ফাঁস হওয়ার সাথে সাথে অর্থমন্ত্রীকে জানানো উচিত ছিলো।”
আরেক অর্থনীতিবিদ রাশেদ তালুকদারও পরোক্ষভাবেই এই ঘটনার সমালোচনা করেছেন। পদত্যাগ ঘটনার কার্যকরণ অর্থাৎ একে ত্বরাণ্বিত করার বিষয়গুলোকেই বেশি গুরুত্ব পায় তার বক্তব্যে।
‘স্বচ্ছ তথ্য প্রবাহ’ এর মধ্যে বড় গলদের দৃষ্টান্ত এই হ্যাকিং পরবর্তী ঘটনা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ৫ই ফেব্রুয়ারি হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি মার্চের ৭ তারিখে পত্রিকা মারফত অর্থমন্ত্রী জেনেছেন। ২৩ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ১ মার্চ অডিট কমিটির সভায় উপস্থিত থেকেও বিষয়টি জানেননি ব্যাংকিং ও আর্থিক বিভাগের সচিব।
অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা, দরিদ্রবান্ধব ভূমিকা, ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করাসহ জনবান্ধব পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য আতিউরের প্রশংসা করেছেন আবু আহমেদ। এক্ষেত্রে অর্থনীতিকে গতিশীল ও স্থিতিশীল করার জন্য স্বীকৃত আতিউর রহমানের তদারকিরও প্রশংসা করেন তিনি। তবে তার পদত্যাগের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ইতিবাচক চরিত্রের পরিবর্তন হবে না বলেই তিনি আশাবাদ জানান।
নতুন গভর্নর অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ফজলে কবির ব্যুরোকেট হওয়ায় তার নতুন দায়িত্ব আরও ভালোভাবে পালন করতে পারবেন বলেও মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ। আতিউর রহমানের পদত্যাগে কোন ধরণের শূণ্যতাও সৃষ্টি হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, কোন পদে কেউ আবশ্যিক নয়।
‘জনবান্ধব’ শব্দটির প্রতি আপত্তিসহ সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়াই পাওয়া যায় রাশেদ তিতুমীরের কাছ থেকে। “বাংলাদেশে এখনও এমন কোন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি যাকে আপনি বলতে পারেন জনবান্ধব।”
এমন মন্তব্য করে এর যৌক্তিকতা প্রমাণে তিনি বলেন, কৃষক, ক্ষুদ্র শিল্পকে বা মাঝারি শিল্প নয় সুবিধা পায় বড়রাই। ৫০০ কোটি টাকার উপরে হলেই সুদের হারে, সময় প্রদানসহ তিনটা জিনিসে মাপ পাওয়া যায় উল্লেখ করে বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল।
তিনি বলেন, ৫০০ কোটি টাকার উপরে ঋণ নিলে সাধারণ মেয়াদী ঋণের যে সময় তার চেয়ে বেশি সময় পাওয়া যায়। তার সুদের হার সবচেয়ে কম। অথচ এই লোকরাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ঋণ খেলাপী।
পদত্যাগের পর আতিউর রহমান সংবাদ সম্মেলনে সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি নিয়ে আসার পেছনে নিজের আত্মত্যাগ, পরিশ্রমের উল্লেখের বিপরীতে আবু আহমেদ আর্থিক খাত বড় হওয়া, প্রবাসী শ্রমিকদের শ্রম, পোষাক খাতসহ আর্থিক বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে গভর্নরের সাপোর্ট ছিলো স্বীকার করে তার ভূমিকার চেয়ে উল্লিখিত বিষয়গুলোকেই মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বলে তিনি দাবি করেন।
আর্থিক খাতে ভয়াবহ অরাজকতা: বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা নিয়েও বড় ধরণের প্রশ্ন ছুড়ে আবু আহমেদ বলেন, আমাদের রেমিটেন্স ‘আর্থিক শকুনের’ কু-দৃষ্টিতে পড়েছে। হলমার্ক (আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ), বেসিক ব্যাংক (সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ) কেলেঙ্কারির পর এই ধরনের হ্যাকিংও বড় নিরাপত্তাহীনতার চিত্র তুলে ধরেছে যে কেউ চাইলেই আমাদের অর্থ নিয়ে যেতে পারবে। সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি আরও জোড়দার করতে হবে বলেও অভিমত দেন তিনি।
আর্থিক নীতি প্রণয়ন, তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নে ব্যাংক খাত, মুদ্রা নীতির নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক আতিউর রহমানের অধীনে সফলতার পরিচয় দেননি বলেই রাশেদ তিতুমীরের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়।
আর্থিক খাতের বিভিন্ন অরাজকতার দৃষ্টান্ত এবং ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। আর্থিক খাতে বর্তমানে রেগুলেটরি লেকস (নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা) আর বিচারিক ভাষায় কালচার অব ইমপিউনিটি (দায়মুক্তির সংস্কৃতি) চলছে মন্তব্য তার।
এর উদাহরণ হিসেবে তিনি শেয়ার মার্কেটের ধ্বসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক ধরনের নীতিকাঠামো তৈরি করার পর বিনিয়োগকারীরা এই মার্কেটে গেলো। মার্কেটে ধস নামলে তা তদন্তে গঠিত কমিটির আহবায়ক বলেন, আমার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই। ব্যক্তিখাতের এবং সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক খাতে একের পর জালিয়াতি ধরা পড়লো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক কি ব্যবস্থা নিয়েছে? অর্থমন্ত্রণালয় কি ব্যবস্থা নিয়েছে?
রেগুলেটরি ক্যাপচার: অর্থনীতিতে ভাষায় ‘রেগুলেটরি ক্যাপচার’ অর্থাৎ যিনি তদারক করেন তিনি দখল হয়ে যেতে পারেন কিনা প্রশ্নেও অশুভ বার্তাসূচক মন্তব্যই ধ্বণিত হয় ঢাবি অধ্যাপক রাশেদ তিতুমীরের কন্ঠে।
নীতিমালা না মানার জোড় প্রবণতায় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে পড়ছে উল্লেখ করে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে একই পরিবার থেকে দুই জনের বেশি পরিচালক হতে পারবে না’ এবং এক্ষেত্রে এক বছর সময় দিয়ে পার্লামেন্টে আইন পাশ হলেও বিভিন্ন ব্যাংকে তার ব্যতিক্রমই দেখা যায়।
বেসিক ব্যাংক, হলমার্কসহ সর্বসাম্প্রতিক হ্যাকিংয়ের ঘটনার আবর্তে ‘লুটপাটের সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাচ্ছি কিনা?’ প্রশ্ন ছুড়ে ‘যেকোন পন্থায় এখানে লুটপাট করা যায়’ এমন বার্তাই জনসাধারণ পাচ্ছে বলে অভিমত তার। ব্যাংক রয়েছে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও অর্থ লোপাটের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি
ব্যক্তি আতিউরের প্রশংসা: “উনি ব্যক্তি হিসেবে খুবই সজ্জন, আমুদে মানুষ। খুবই চমৎকার মানুষ তিনি।” সংগ্রাম করে এই পর্যায়ে আসার জন্য তিনি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য বলেও মন্তব্য রাশেদের। ‘তিনি মাইক্রো ক্রেডিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তার সাক্ষর তিনি রেখেছেন।’
সাম্প্রতিক হ্যাকিংয়ের প্রেক্ষিতে দুই ডেপুটি গভর্নরকে (নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাশেম) অব্যাহতি, সাবেক গভর্নর ডক্টর ফরাসউদ্দিন করে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলাসহ গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানান আবু আহমেদ।