পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি। এই যুদ্ধের বেশির ভাগ যোদ্ধাই ছিল তরুণ। যাদের বয়স ছিল ১৫-৪০ এর মধ্যে। সুখী-সমৃদ্ধশালী, শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য অস্ত্রহাতে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছিল এসব মহান মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের কাছে এসে কতটুকু পূরণ হয়েছে এসব যোদ্ধাদের স্বপ্ন? কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?
শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয়, বাঙালির সকল গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণরা। বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় এসেছে তরুণদের ভোটেই। তরুণরা যেটা প্রত্যশা করে বর্তমান সরকার সেটা অনুধাবন করেই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে দেশে তরুণদের অংশই বেশি আর এটাই সবচেয়ে আশার কথা। একারণে যে, এই তরুণরা সেই বাংলাদেশ চাই, যেটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু চেয়েছিল, যেটি মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ে দেবার জন্যেই দেশের বিশাল অংশ তরুণ ভোটের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। বর্তমান সরকার সেটার অনেই কিছুই পূরণ করেছে। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের মাধ্যমে দেশকে কলঙ্গমুক্ত করেছে, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শেষ করেছে, অন্যদেরগুলো চলমান রয়েছে, দারিদ্র ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তথ্য- প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে সরকার। বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিন তুলে দেওয়া হচ্ছে নতুন বই, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝড়ে পড়ার হার রোধ করা সম্ভব হয়েছে অনেকাংশে, দেশের সর্বত্র শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নতুন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০০৮ সালের স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবে রুপ নিয়েছে, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলমান। এসব অর্জনে তরুণরা গর্ব বোধ করে। এসব অর্জন তরুণদের সাহসী হতে শেখায়। এসব অর্জন তরুণদের মাথা উচু করে বাঁচতে শেখায়।
নানা অর্জনের মাঝে কিছু ত্রুটিও রয়ে যাচ্ছে। যেগুলো ব্যথিত করে তরুণ সমাজকে। তরুণ সমাজ ব্যথিত হয়- যখন দেখে অস্ত্রহাতে জীবন বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করছে আর অন্যদিকে কিছু অসাধু, হীন, শিক্ষিত ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে মুক্তিযুদ্ধের সনদ নিয়ে নিজের চাকরির মেয়াদ বাড়াচ্ছে। সরকারের চেষ্টা থাকার পরও দেশ এখনো দুর্নীতিমুক্ত হয়নি, খুব কম অফিস-আদালতই পাওয়া যাবে যেটি দুর্নীতিমুক্ত। যেগুলো দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে সেগুলোও সম্ভব হয়েছে কিছু তরুণ দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের কারণেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা অর্জনের মাঝেও দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। প্রাথমিকের গণ্ডিও পার হতে হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁস করে! ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা আবার ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মজীবনে প্রবেশ!
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পর নতুন যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস। দেশের মানুষ এখনও যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে বলে গণমাধ্যমে তথ্য-প্রমাণসহ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তারা মেধাতালিকায় স্থানও পেয়েছে প্রথমদিকেই। যাদের নাম ও মেধাক্রমসহ বিস্তারিত প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। ইতিমধ্যে তারা ভর্তির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষার্থীও হয়েছে!
একটি প্রাইভেট টেলিভিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্দিষ্ট ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে যারা ভর্তি হয়েছে তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষে অধ্যায়নরত। এত কিছুর পরও সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। যারা বিভিন্ন সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হোক। এটা সময় সাপেক্ষ বিষয় সেটা সত্য। কিন্তু, যাদের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনা সত্য হলে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এসব শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেলে পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির প্রবণতা হ্রাস পাবে। কেননা, তারা বুঝতে পারবে- জীবনের যে কোন পর্যায়ে তাদের কুকর্ম প্রকাশ পেলে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাবে। অন্যদিক তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা না নিয়ে যদি বলা হয়, প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, তারা প্রকৃতপক্ষেই মেধাবী, তাহলে তাদের কুকর্মকে পুরস্কৃত করা হবে। যেটি দেখে অন্য শিক্ষার্থীরাও এই পথ বেছে নিতে আগ্রহী হবে।
আমাদের শিক্ষা পরিবারের অভিভাবক মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সব সময়ের মতো কয়েকদিন আগেই বললেন প্রশ্ন ফাঁস করে শিক্ষকগণ। আমরা জানি শিক্ষকগণ প্রশ্ন হাতে পায় পরীক্ষা শুরু হবার অধা ঘন্টা আগে। অন্যদিকে পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষার আগের রাতেই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। যেটার সংবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে শিক্ষকরা প্রশ্ন ফাঁস করে কীভাবে? এরপরও যদি শিক্ষকরা প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত থাকে তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে না কেন?
আমরা সবাই একজন আরেকজনের উপর দোষ চাপাচ্ছি। কেন চাপাচ্ছি সেটা সাধারণ মানুষও যেমন জানে যারা দোষ চাপাচ্ছেন তারা নিজেরাও জানেন। দায় কেউ নিজের কাঁধে নিচ্ছে না। কেননা, দায় নিলে দায়িত্ব পালনের বাধ্যতা থাকে। ঘটনার গভীর প্রবেশ করুন। যারা জড়িত দয়া করে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনুন। একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করার অধিকার আপনাদের কারো নেই। পাকিস্তানি হায়নারা ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করেছিল। আর বর্তমানে প্রশ্ন ফাঁস করে পুরো প্রজন্মকে মেধাশূন্য করার চেষ্টার পার্থক্য কোথায়? এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ও উন্নয়নের বিপক্ষে কাজ করছে বললে ভুল হবে না। কেননা, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা যেটা করতে পারেনি তারা খুব কৌশলে সেটা বাস্তবায়ন করছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)