প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সরকার ভীষণরকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও ফাঁস রোধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী কৌশল সরকারের পক্ষ থেকে উদ্ভাবন বা গ্রহণ করা হয়েছে বলে দৃশ্যমান নয়। প্রতিদিনই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। পাওয়া ফেসবুক, ভাইবার, টুইটারসহ সব জায়গাতে। একেবারে পুরোটাই যেনো হোমসার্ভিস। সবমিলিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয়টি যেনো এখন নিছক এক ধরনের বিনোদনে পরিণত হয়েছে।
এ নিয়ে শুধু এখন কথা চালাচালি হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে এই সরকার অনেক কিছু পারলেও প্রশ্নফাঁস রোধে কিছুই করতে পারছে না। উল্টো প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল অনেকেই সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। একই সাথে এও প্রমাণিত হয়েছে যে সরকার জঙ্গিদমনে সফল হলেও প্রশ্ন ফাঁস দমনে একেবারেই বিফল। প্রশ্নের নিরাপত্তা সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি।
প্রতিদিনই মহাশক্তিধর প্রশ্ন ফাঁসকারী সিন্ডিকেট আড়ালে আবডালে থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে। সরকার, মন্ত্রী, পুলিশ, র্যাব সবাই যেনো তাদের কাছে পরাস্ত। তারা কারো ধারও ধারে না, কাউকে পরোয়াও করেনা। ফাঁস নিয়ে মিডিয়াতে রিপোর্ট হচ্ছে। লেখালেখি হচ্ছে, টেলিভিশনে টকশো হচ্ছে। ফেসবুকে মশকরা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে হুমকি ধমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস হয়েই চলছে। এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রশ্নফাঁস নাটক চলমান রয়েছে। গণমাধ্যম বলছে নানা প্রক্রিয়ায় প্রতিদিনই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ বা প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এখন পর্যন্ত যা যা বলছেন সেখানে চরম অপরিপক্বতাই লক্ষণীয়ভাবে ফুটে উঠেছে। ফাঁস রোধে শিক্ষামন্ত্রীসহ ঢাকা বোর্ডের প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক যা বলছেন তা অগ্রহণযোগ্যই। সবচেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত বলে চলেছেন, ‘ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সাথে মূল প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়নি।’ এই মুখস্থ বুলি তা বলেই যাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহারথীরা এই একই বক্তব্য প্রতিদিনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন। দেখা যাচ্ছে, যে কথা তাঁরা বাংলা পরীক্ষার দিন বলেছেন সেই একই কথা তারা গণিতের দিনেও বলেছেন।
শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় বড় কর্মকর্তাগণ স্বীকার করুক বা না করুক প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এ নিয়ে দ্বিমতের কোনো কারণ নেই। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিগণও স্বীকার করেছেন তারা অনেকদিন ধরেই এই অপকর্মের সাথে যুক্ত। সবমিলিয়ে সারাদেশে প্রশ্ন কেনাবেচার এক বিরাট সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আর এই সিন্ডিকেটের কাছে যেনো সবকিছু ভেঙে পড়েছে বা আত্মসমর্পণ করেছে।
ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দেওয়ার বড় মাধ্যম ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসআপ, ইমোসহ সামাজিক মাধ্যমসমূহ। এই সব মাধ্যমে দ্রুতই প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এসএসসির বাংলা, ইংরেজি, গণিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার অন্তত দু ইবা তিনঘণ্টা আগে ফেসবুক, ভাইবারে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে। শুধু এসএসসি বলে নয়, গত বছর জেএসসি পরীক্ষার সময়ও এই একই কৌশলে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে তাই আদর্শহীনভাবে গড়ে উঠা এক ধরনের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের দেখা গেছে মোবাইল স্ক্রিনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে। এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর এই একই চিত্র দেখা গেছে পরীক্ষা কেন্দ্রের আশেপাশে। যেহেতু আগে থেকেই সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি রাখা হয়নি বা দ্রুত নিয়ন্ত্রণের কৌশলও বের করা হয়নি সেহেতু এবারও প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্র ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমকেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে। এই চক্র বিকাশ নাম্বার দিয়ে উৎসাহী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে আগাম টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। এ সবকিছুই হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একথা সত্য যে সব স্কুলের শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকরা এ কাজটি করছে বা এই কাজের সাথে যুক্ত মোটেও তা নয়। দেখা গেছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরাই এই জঘন্য ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র পাওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে।।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দ্রুত ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এ বছরই ঘটছে তা নয়। গত কয়েক বছর ধরেই ঘটছে। পত্রপত্রিকাতেও সেটাও লেখা হয়েছে। যত পত্রিকা রিপোর্ট করেছে সবাইই ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্যতম উৎস হিসেবে সনাক্ত করেছে। শিক্ষামন্ত্রণালয় যদি শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কঠোর নজরদারি রাখতো তাহলে নিশ্চিত কিছুটা হলেও ভালো ফলাফল পাওয়া যেতো। উল্টো ঘোষণা দিয়ে ইন্টারনেট কখন শ্লো থাকবে এমন কথা বলায় সরকারি কর্মকর্তাদের চরম অপরিপক্ব বলে মনে হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কর্মকর্তাগণ যদি মনে করে থাকেন সামাজিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল প্রশ্নফাঁস রোধে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে তাহলে সেটা তারা দায়িত্ব নিয়ে করতেই পারতেন। এটির জন্যে আগাম কোনো ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি শুরু থেকেই গোপন কৌশলে সামাজিক গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি অব্যাহত রাখতো তাহলে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়তো না। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন সত্য-মিথ্যার এক মহা আখড়াতে পরিণত হয়েছে। সব ভালোর বাইরে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, প্রলুব্ধ করা, উস্কানি দেওয়া- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই এখন দ্রুত গতিতে করা সম্ভব।
প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে এখনই নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে শুরু করে যে সব জায়গাতে সংস্কার করা দরকার সেগুলো করতে হবে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার দরকার হলে সেটাও নিতে হবে। সবচেয়ে সত্যটা হলো তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিষয়গুলো কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে-এর জন্যে কৌশল তৈরি করা না হলে শিক্ষামন্ত্রীর সততা দিয়ে দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণ হবে না। আবার বর্তমান পরিস্থিতি কেউ পদত্যাগ করলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে তাও নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই সঠিক কৌশল উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গড়িমসি এবং সময়ক্ষেপণ করা হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদন চলছে সেটা বন্ধ হবে না। আর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে শিক্ষার্থীদের এক ভয়াবহ ক্ষতি হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)