ভবিষ্যৎ বক্তা বা জ্যোতিষীরা যে শুধু মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করেন তা নয়। এমন অনেক ‘জ্যোতিষী’ রয়েছেন, যারা শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ও অগ্রগতি নিয়ে গবেষণা করেন এবং যুক্তিতর্ক ও বাস্তবতার ভিত্তিতে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু তত্ত্ব দেন। এদের বলা হয় ‘ফিউচারিস্ট’ বা প্রযুক্তি বিষয়ক ভবিষ্যৎ বক্তা।
বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ফিউচারিস্ট রে কার্জওয়েল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখা ‘দি এজ অব স্পিরিচুয়াল মেশিনস’, ‘দ্যা সিংগুলারিটি ইজ নিয়ার’ এবং ‘হাউ টু ক্রিয়েট আ মাইন্ড’র মতো বিখ্যাত বইয়ের রচয়িতা তিনি।
কার্জওয়েলের লেখা এবং চিন্তাধারা এতোটাই শক্তিশালী যে গুগল তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রকল্পের প্রধান হিসেবে তাকে নিযুক্ত করেছিলো।
কার্জওয়েল প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নিয়ে তার লেখা বইগুলোতে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যেগুলো ২০১৫ সালের মধ্যে সত্যি হওয়ার কথা। এর মধ্যে কিছু সত্যি হয়েছে, কিছু আংশিক সত্যি হয়েছে, আর কিছু ‘হয়তো’ এখনো সত্যি হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
জেনে নেওয়া যাক ফিউচারিস্ট রে কার্জওয়েলের এমনই কিছু ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে–
অনলাইনে পোশাক ডিজাইনিং
ভবিষ্যদ্বাণী: ১৯৯০ সালে কার্জওয়েল বলেছিলেন, ১৯৯৯ সালের মধ্যে মানুষ ঘরে বসে কম্পিউটারে বিশেষ ধরণের ডিজাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিজেদের জন্য ঠিকঠাক মাপ এবং পছন্দের স্টাইল অনুযায়ী পোশাক ডিজাইন করতে পারবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যবহারকারী সফটওয়্যারকে ‘পোশাক তৈরি করো’ কমান্ডটি দিলেই ব্যবহারকারী প্রদত্ত মাপ ও স্টাইল অনুযায়ী সফটওয়্যারটি একটি স্বয়ংক্রিয় পোশাক কারখানায় তা জানিয়ে দেবে। তখন সেখান থেকে পোশাক তৈরি হয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যাবে।’
বাস্তবতা: কার্জওয়েলের এই ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে এখনো অনেক দেরি আছে বলে মনে হয়। তবে স্যুট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক টাক্স অনলাইন টেইলারিং শুরু করেছে।
সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যদ্বাণী ভুল।
বিভিন্ন আকার-আকৃতির কম্পিউটার
ভবিষ্যদ্বাণী: ১৯৯৯ সালে কার্জওয়েল বলেছিলেন, ২০০৯ সালের মধ্যে পার্সোনাল কম্পিউটার হরেক রকম আকার-আকৃতিতে পাওয়া যাবে। ঘড়ি, আংটি, কানের দুলসহ বিভিন্ন গয়না, পোশাক এবং অনুষঙ্গের মধ্যেও থাকবে কম্পিউটার।
বাস্তবতা: ২০০৯ সালের দিকে আইপড ন্যানো জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এই কম্পিউটারটিকে ক্লিপের সাহায্যে পোশাকের সঙ্গে আটকে রাখা যায়। অন্যদিকে ২০০৮ সালে বাজারে আসে ‘ফিটবিট’, যার মধ্য দিয়ে ফিটনেস ট্র্যাকারের প্রচলন শুরু হয়।
তাছাড়া এখন মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ট্যাবলেট, ফ্যাবলেট, স্মার্টওয়াচসহ বিভিন্ন আকার ও প্রয়োজনীয়তার কম্পিউটার মানুষ ব্যবহার করছে।
সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক।
বেশিরভাগ লেখা হবে ‘স্পিচ রেকগনিশন’র সাহায্যে
ভবিষ্যদ্বাণী: কার্জওয়েলের ১৯৯৯ সালের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০০৯ সালের মধ্যে মানুষ লেখার ক্ষেত্রে ‘স্পিচ রেকগনিশন’ বা ‘ভয়েস কমান্ড’র ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। পরে এর প্রমাণ হিসেবে ২০০৯ সালে বাজারে আসা ড্রাগন ডিকটেশন সফটওয়্যারের কথা তিনি উল্লেখ করেন।
বাস্তবতা: কম্পিউটার ছোট হয়ে এখন স্মার্টফোনের মাঝে চলে এসেছে, যার ফলে আমরা সহজেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টেক্সট মেসেজে নিজেদের কথা জানিয়ে দিতে পারি। পাশাপাশি ওয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপগুলোও আমাদের সহজেই টেক্সট, ভয়েজ এবং ভিডিও মেসেজের সুযোগ করে দিয়েছে।
এছাড়াও ‘সিরি’ আর ‘গুগল টক’র মতো স্পিচ রেকগনিশন অ্যাপগুলো ঠিকমতো কাজ না করায় এগুলোর ওপর ব্যবহারকারীরা চরম বিরক্ত। তাই স্পিচ থেকে টেক্সট তৈরির কষ্টে কেউ যায় না।
সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যদ্বাণী ভুল।
সবসময় উচ্চ ব্যান্ডউইথের ইন্টারনেট
ভবিষ্যদ্বাণী: ২০০০ সালে কার্জওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ২০১০ সালের মধ্যে আমরা সর্বক্ষণ উচ্চ ব্যান্ডউইথের ওয়্যারলেস ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবো।
বাস্তবতা: ২০১০ সালের দিকে মোবাইল অপারেটর ভেরিজন প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে এলটিই প্রযুক্তির মোবাইল ইন্টারনেট সেবা শুরু করে। গতি মন্থর হলেও তা ছিলো ওয়্যারলেস ইন্টারনেট, যা দিয়ে যখন তখন জরুরি কাজগুলো করা সম্ভব হতো। পরে ওয়্যারলেস ইন্টারনেট প্রযুক্তি সময়ের সাথে আরো অনেক উন্নত হয়।
সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় ঠিক।
রোগীদের চিরকালের মেডিকেল ডাটা সংরক্ষণ
ভবিষ্যদ্বাণী: ১৯৯০ সালে রে কার্জওয়েল বলেন, ২০০০ সাল বা তার পরবর্তী কিছু সময়ের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা হবে, যেখানে জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে রোগীদের চিরকালীন মেডিকেল হিস্ট্রি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা থাকবে।
বর্তমানের অগোছালো ব্যবস্থাকে গুছিয়ে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা হবে এবং রোগীদের হাতের হাতঘড়িতেও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
বাস্তবতা: বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং মেডিকেল হিস্ট্রি সংরক্ষণ ব্যবস্থা এতোটাই অগোছালো, যে এখন পর্যন্ত তা ভবিষ্যদ্বাণীর ধারেকাছেও যেতে পারেনি। অ্যাপল ওয়াচ’র মতো হেলথ মনিটরিং কিছু ঘড়ি জাতীয় ডিভাইস বাজারে আসলেও সরকারিভাবে ডাটা সংরক্ষণে তা ব্যবহার করার মতো কোনো প্রযুক্তি এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে না।
সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি ভুল।
বহনযোগ্য কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধি
ভবিষ্যদ্বাণী: ১৯৯৯ সালের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০০৯ সালের মধ্যে মানুষ মূলত বহনযোগ্য কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। সাধারণ কাজগুলোর জন্য এসব কম্পিউটারই হবে মানুষের অনুষঙ্গ।
বাস্তবতা: ২০০৮ সালে প্রথম ডেস্কটপ কম্পিউটারের পরিবর্তে ল্যাপটপ বেশি বিক্রি হয়। আর স্মার্টফোন আসার পর মানুষ এখন ছোটখাটো সব কাজই করে ফোন থেকেই।
সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক।
সব কম্পিউটার মিলে তৈরি হবে বিশাল মেমোরি ব্যাংক
ভবিষ্যদ্বাণী: কার্জওয়েল ২০০০ সালে বলেন, ২০১০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব কম্পিউটার একটি সাধারণ যোগাযোগ সার্ভারে যুক্ত হবে। এতে এক কম্পিউটারের মেমোরি থেকে তথ্য প্রয়োজনে সহজেই অন্য কম্পিউটারে নেওয়া যাবে। সব মিলে ব্যবস্থাটি একটি সুপার কম্পিউটারের মতো কাজ করবে।
বাস্তবতা: কার্জওয়েল যা কল্পনা করেছিলেন, তা মূলত বর্তমানের ক্লাউড কম্পিউটিংয়েরই একটি পরিণত এবং সম্পূর্ণ সংস্করণ। ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবস্থায় এক এলাকার কম্পিউটার থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের অন্য প্রান্তের কোনো কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেখান থেকে তথ্য নেওয়া যায় বা সেটি দূর থেকে পরিচালনা করা যায়।
সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যদ্বাণী অবিশ্বাস্যভাবে ঠিক।