যাই হোক, দক্ষিণ ভারতের আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় হলো ভাষা। এরা প্রবল হিন্দি-বিরোধী! খুব ভালো করে হিন্দি এরা না বলতে পারে, না বুঝতে পারে। আমার ধারণা ছিল, আমি হিন্দি ভাষাটা মোটামুটি ৫০-৬০% বুঝি। কিন্তু কর্নাটকিদের হিন্দি উচ্চারণ এতোই জটিল যে, মনে হলো, আমি ১০% হিন্দিও বুঝি না! নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকেও নাকি হিন্দির প্রশ্নে এরা আরও কট্টর ছিল। যদিও, হিন্দির প্রভাব স্বীকার করে এরা ভাষাটা রপ্ত করছে মাত্র কয়েক বছর হলো; কিন্তু এরা উর্দুকেও যত সহজে নিতে পারে, হিন্দিকে পারে না!
এখানে পাঁচ রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, কেরালা ও তেলেঙ্গানা এবং কেন্দ্রশাসিত ইউনিয়ন টেরিটোরি আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ, লক্ষদ্বীপ ও পোডেচেরিতে – তামিল-তেলেগু-কানাড়া-মালায়লাম এই চারটা ভাষা মিলিয়ে-ঝিলিয়ে বলা হয়। নিজেদের মাতৃভাষার পরে এদের এখানে দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিন্দি নয়, ইংরেজি।
আরেকটা হলো, তামিল চলচ্চিত্র। ওদের সর্বত্র তামিল চলচ্চিত্রের প্রচার-প্রচারণা। সেই জানালা দিয়ে বলিউডি বাতাস ঢোকার সুযোগ খুবই কম। বলিউড নয়, এরা এখনও নিজেদেরই সেরা মনে করে। বলিউড ওদের ছবি থেকে ধারণা নিয়ে ছবি বানায় এমন কথাও প্রচলিত আছে বাজারে!
ভাবতে পারছেন! এতো কিছুকে সমগ্র ভারতের তুলনায় বৈপরীত্য বলবেন না আপনি? ভারতের মাটিতে কত বড় ‘ভারত-বিরোধী’ একটা গোষ্ঠী তাদের অস্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা নিয়ে টিকে আছে। রাম বিরোধী, হিন্দি বিরোধী, বলিউড বিরোধী! তবুও, ওরা ভারতীয়ই থাকতে চায়। ভারত থেকে পৃথক হয়ে একটা আলাদা দেশ হওয়ার চেষ্টা এরা অতীতে করেছে ঠিকই, কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনা প্রায় ক্ষীণ। হিন্দির বিস্তার ঘটা সেটারই ইঙ্গিত।
ব্যাপারটাকে ভাইস-ভার্সা হিসেবেও দেখতে পারেন। উপমহাদেশে যদি চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে উর্বর জায়গা কিছু থাকে তো সেটা এই দক্ষিণ ভারত। চেন্নাই ও ব্যাঙ্গালোরের একদম প্রায় মধ্যবর্তী দূরত্বে থাকা ভেলোরে অসংখ্য বাংলাদেশী আসেন। তারাই এখানকার চিকিৎসার মান কেমন সেটা ভালো বলতে পারবেন। কর্নাটক তো ভারতের তথ্য ও প্রযুক্তির প্রদেশ, ব্যাঙ্গালোর আইটি রাজধানী। পৃথিবীবিখ্যাত তথ্য-প্রযুক্তির কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির আদলে ব্যাঙ্গালোরকে এখনই ‘ভারতের সিলিকন ভ্যালি’ বলা হচ্ছে এবং বিশ্ববাজারে এর মূল্যায়ন দিন দিন বেড়েই চলছে।
ভারতের অন্যতম সেরা দুই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখানকার দুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে। চেন্নাইয়ে অবস্থিত মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ভারতের সেরা পাঁচটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে ভারত তার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব র্যাংকিয়ের সেরা ১০০’র মধ্যে নিয়ে যেতে চায়। এই দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই তালিকায় থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট প্রসঙ্গে আসেন। দেখেন কত বড় বড় ক্রিকেটার এই অঞ্চল থেকে উঠে এসে ভারতীয় ক্রিকেটে অবদান রেখেছেন। তথ্য-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র আর উপমহাদেশের নিক্তিতে ক্রিকেটে কোনো অঞ্চল সমৃদ্ধ হলে আর কী চাই! পাশাপাশি, সমুদ্র পার্শ্ববর্তী হওয়ায় পর্যটনও এখানে সমৃদ্ধ। আর আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে থাকা মানে বাণিজ্যও এখানে ফল্গুধারায় বহমান।
দক্ষিণ ভারত তবুও আলাদা হবে না, কারণ অখণ্ড ভারতই তার শক্তির জায়গা। এই অতি বিশাল বাজার কে হাত ছাড়া করতে চায়! অন্যদিকে, ভারত তো তাকে আলাদা হতে দিবেই না, কোনো অঞ্চলকেই যেমন দিবে না। ভারতীয় কেন্দ্র এই অঞ্চলের গুরুত্ব বুঝেই একে নানা ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ করে চলেছে। আর কেন্দ্রের আশীর্বাদধন্য হয়ে দক্ষিণ ভারতও তরতর করে উপরে উঠছে। এজন্যই বললাম, ব্যাপারটা ভাইস-ভার্সা। লেনাদেনা ঠিক হচ্ছে, সুতরাং সবই ঠিক হচ্ছে। রাম পূজ্য নাকি রাবণ, সেটা মূখ্য নয়!
দক্ষিণ ভারতকে নিয়ে এত কথা বলার কারণ, ভারত যে আগামী দিনে সারা বিশ্বের কাছে ‘কনসেপ্ট’ হয়ে উঠতে চায়, তাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা এই অঞ্চলই পালন করবে সম্ভবত। সারা বিশ্বের ভারতীয়দের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে দিতেই তাই এবারের কনফারেন্স ব্যাঙ্গালোরে আয়োজন করেছিল ভারত সরকার।
ভারতের কাছে তার ‘Diaspora’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। গুজরাটে তথা আহমেদাবাদে বসেই আমি সেটার প্রমাণ পাচ্ছি। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্ডিয়ান ডায়াসপরা রিসার্চ সেন্টার’ এখন সমগ্র ভারতের Diaspora গবেষণার মডেল। আরও অনেক ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডায়াসপরা বিষয়ক গবেষণা হচ্ছে বটে; তবে, ভারতের প্রথম ‘ডায়াসপরা গবেষণা কেন্দ্র’ হিসেবে এটাই পথ প্রদর্শক। এই কেন্দ্রেরই একজন সামান্য গবেষক হওয়ার সুবাদে প্রবাসী ভারতীয় দিবসের কনফারেন্সে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল আমার!
সে যাই হোক, নিজেকে বিশ্বের সামনে ‘কনসেপ্ট’ হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য প্রবাসীদের ভারত শুধু কাছেই টানছে না; ডায়াসপরা গবেষণার খাতে প্রচুর অর্থও লগ্নি করছে, গবেষণার মাধ্যমে প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণও করে তুলতে চাইছে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ভারতের ডায়াসপরা গবেষণা নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য আবেদন তৈরি হয়েছে। অনিবার্যভাবেই এই গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
৫.
এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, বাংলাদেশের এসব কচকচানি শুনে কী লাভ? ভারত নিজেকে ‘কনসেপ্ট’ হিসেবে গড়ে তুলুক, তার Diaspora গবেষণাকে বিশ্বমানের করুক তাতে বাংলাদেশের কী লাভ আদতে?
শুরুতেই বলেছি, ভারত কোথায় যেতে চায়, সেটা ভূ-রাজনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে যেতে চায়, তারও একটা ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভারতের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা রাষ্ট্রটি জানে ও মানে বলেই মনে করি। তাই, এসব বাইনারি অপজিশন বাংলাদেশ এড়িয়ে যেতেই পারবে না।
বাংলাদেশের মানুষকে বুঝতে হবে ভারত মানে শুধুই বলিউড আর ক্রিকেট নয়। ক্রিকেটের মোড়ল হওয়া আর বলিউডের চলচ্চিত্র দিয়ে বাজার ছেয়ে ফেলার গভীরেও একটা শক্তিশালী রাজনীতি আছে। এই রাজনীতিই ক্রিকেট আর বলিউডের অর্থ ও শক্তির যোগানদাতা। দক্ষিণ ভারত যদি তার স্বকীয়তা ভারতের মধ্যে থেকেও বজায় রাখতে পারে, তবে, আমরা কেন ‘সব গেল রে গেল রে’ রব করি!
কেন করি? নিশ্চয়ই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামর্থ্যের মধ্যে সদিচ্ছা-স্বচ্ছতার অভাব আছে। সদিচ্ছা-স্বচ্ছতার অভাব যখন নিজেদেরই, তখন ঘরে বসে ভারতকে গালিগালাজ করে লাভ আছে! ভারত তো তার ‘ধারণা’ বিস্তৃত করার চেষ্টা করবেই এবং পাশের দেশ বলে বাংলাদেশেও সেই হাওয়া স্বাভাবিকভাবেই সবার আগে লাগবে! আমরা বরং, যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে কিউবা যেমন, এই অঞ্চলে বাংলাদেশকেও তেমন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। আমাদের সেই বিপুল সম্ভাবনা আছে। আমাদের যে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানোগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন আছে, পৃথিবীতে আর কয়টা আছে এমন? রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতা তো যৌক্তিকই এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকও। আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীতে সবচেয়ে দীর্ঘ। পৃথিবীতে মোট রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের অনুপাতে সবচেয়ে বেশি উর্বর কৃষি জমি বাংলাদেশের। অর্থনৈতিকভাবে এসব অমিত সম্পদের সিংহভাগ আমরা সঠিক কাজে লাগিয়েছি বা লাগাচ্ছি বলে মনে হয়?
কাজের চেয়ে আমরা পরনিন্দা-পরচর্চা অনেক বেশি করতে পছন্দ করি। ভারত তার প্রবাসীদের কী চোখে দেখে, আর বাংলাদেশ কী চোখে দেখে সেটা একবার ভাবুন। ভারত এদের মনে করে জনশক্তি, যাদের কাছে টেনে রাষ্ট্রটি বিশ্বের দরবারে ‘কনসেপ্ট’ হিসেবে হাজির হতে চায়। আর আমরা আমাদের প্রবাসীদের মনে করি ‘উপদ্রব’; দেশের অর্থনীতিতে অসীম অবদান রাখা প্রবাসী শ্রমিকদের মনে করি, তৌকির আহমেদের অসামান্য চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাতনামা’র মতো ‘অচ্ছুৎ’! বিদেশে বসে কেউ কেউ দেশ নিয়ে সমালোচনা করলে বা পরামর্শ দিলে তাকে নিয়ে অনলাইন ট্রল কিংবা অশ্রাব্য গালিগালাজে ভরিয়ে ফেলি। এক কথায় বলে দেই, বিদেশে বসে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার অধিকার কারও নেই!
প্রবাসী বাংলাদেশীরা কিংবা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরাও বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের দূত হতে পারেন। বাংলাদেশকে নিজের প্রয়োজনেই সেদিকে ধাবিত হতে হবে। বাংলাদেশেও ‘প্রবাসী বাংলাদেশি দিবসে’র প্রচলন হতে পারে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’কে কেন্দ্র করেই সেটা প্রচলিত হতে পারে। সমস্যা একটাই, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এখানে যেভাবে দল-মত নির্বিশেষে শ্রদ্ধার পাত্র, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আইকন শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা সে জায়গায় নিয়ে যেতে পারিনি। এর দায় শুধু এন্টি-আওয়ামী মনোভাবাপন্নদের নয়, আওয়ামী মনোভাবাপন্নদেরও।
৬.
আশার কথা, উচ্চমাধ্যমিকের ইংরেজি প্রথম পত্রে, ‘Diaspora’ বিষয়ক লেখাপত্র সংযুক্ত হয়েছে। যদিও, এই ধারণা একদমই নতুন বাংলাদেশে, তাই শুরুর দিকে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। ধারণা করি, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কোনো অভিধানেও সম্ভবত শব্দটি নেই। দেশে প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকের লেখাপত্র উল্টেপাল্টে দেখলাম, Diaspora অর্থে ‘প্রবাসী’, ‘অভিবাসী’ দুটো শব্দই পড়ানো হচ্ছে। একটি গাইড বইয়ে প্রকাশিত ইংরেজি প্যারাগ্রাফে পড়লাম Diaspora-এর শব্দার্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘অভিবাসী’ শব্দটি। ‘অভিবাসী’ বলা বা লেখাটা আসলে সঠিক হচ্ছে না। অভিবাসী বলতে ‘Immigrant’ বিশেষ্যটি ব্যবহৃত হয়। কোনো হোস্টল্যান্ড তার বংশোদ্ভূত নয় এমন নাগরিককে অভিবাসীই বলে। কিন্তু, হোমল্যান্ডের কাছে সেই ব্যক্তিটিই ‘ডায়াসপরা’ বা ‘প্রবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চোখে ‘বাংলাদেশী ডায়াসপরা’ মানে তাই ‘বাংলাদেশী প্রবাসী’, অন্য কিছু নয়।
এই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করতে এবং আরও আরও গভীর পঠন-পাঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশেও ডায়াসপরা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হতে পারে। নানা কারণে প্রবাস জীবন বেছে নেওয়া বাংলাদেশীদের সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। এই সংখ্যাটাও আমাদের শক্তি হতে পারে। ১৬ কোটি মানুষের দেশটা ছোট্ট হতে পারে, কিন্তু মানচিত্রের বাইরের এই শক্তিটা মোটেও ফেলনা নয়। ভারতের কাছে এ বিষয়ে আমাদের বোঝার ও শেখার আছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, এটাই যেন আমাদের সর্ব প্রথম ও সর্ব উত্তম চাওয়া হয়। সেই এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে অন্য কোন দেশের দারুণ একটি ধারণাকে আমরাও রপ্ত করতে পারি বৈকি।
আমরাও তো বলতেই পারি, বাংলাদেশীরা বাংলাদেশের বাইরে থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশকে বাংলাদেশীদের হৃদয়ের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)