৯ জুন আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিলেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এম.এ. জলিল। অর্থশাস্ত্রে পিএইচডি করা এই আলোকিতজন মৃত্যুঅব্দি ছিলেন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের এক নিরব নিবেদিত প্রাণ। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই বলেছেন, মানুষকে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি একইসাথে দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণ করতে হবে। পরিবার, সমাজে, রাষ্ট্রে জ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগই হলো মূল সাফল্য। তিনি বলতেন সার্থক জীবন গড়তে অর্থবিত্তের চেয়েও অনেক বেশি প্রয়োজন জ্ঞান, সততা, সৃষ্টিশীল চিন্তা ও কর্মকূশলতা। এসবের বাইরে মানুষের বাহ্যিক বিত্তবৈভব অনাকর্ষণীয়। যতদিন বেঁচেছিলেন নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে তিনি এই কথাগুলো বিলিয়েছেন। মানসজীবন যাতে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয় নিরন্তর সে কথাই বলেছেন।
সেই ষাট দশকে তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শ্রীপুর থানার নিভৃতপল্লী বরিশাট থেকে তিনি মেধার জোরেই নগরে উঠে এসেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মাগুরা কলেজ, এরপর দীর্ঘসময় রংপুর কারমাইকেল কলেজ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে লোক প্রশাসন কেন্দ্র (পিএটিসি), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম)-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রাইম ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় অনুষদের ডীনও ছিলেন তিনি। ২০১৬-১৮ মেয়াদে ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি। আর মৃত্যু অব্দি বৃহত্তর যশোর জেলা সমিতি ও মাগুরা জেলা সমিতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিজ গ্রাম বরিশাটে পরম মমতায় গড়ে তুলেন ‘বরিশাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। টানা পনেরো বছর তিনি এই স্কুলের সভাপতি ছিলেন।
মুুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে সত্তর দশকের মধ্যভাগে ভারতের হায়দারাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থশাস্ত্রে শুধু পিএইচডি নয়, গোল্ডমেডালিস্ট খেতাব নিয়েও আসেন। সেই সময়ে মাগুরার আনাচে-কানাচে মেধাবীজন হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। স্কুল, কলেজের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে তাঁর নাম উল্লেখ করতে থাকেন। বালকবেলায় আমাদের কাছেই সত্যিই স্বপ্নের মতো নামটি শোনাতো ‘ড. এম.এ.জলিল’। অবশ্য এর অনেকগুলো সমাজ ও মনস্তত্ত্বও ছিল। ষাট-সত্তর দশকে গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে অর্থনীতি ছিল একেবারেই ভূমিনির্ভর। যার যত জমি সমাজে তার ছিল তত সম্মান, প্রতিপত্তি। জমির মালিক বা ভূ-স্বামীরাই হতেন সমাজের মূলচালিকা শক্তি। এই শ্রেণির বাইরে সমাজের অন্যান্য ক্ষুদ্র পেশাভিত্তিক মানুষের প্রভাব তেমন একটা ছিল না। সেসময় ভূমিহীন পরিবারগুলোকে খাদ্যচাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেতে হতো। একই সাথে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অপ্রতুল হওয়ার কারণে গরিবের জন্য লেখাপড়া করাটাও ছিল প্রাণান্তকর এক লড়াই। কিন্তু সে লড়াই-এ জিতেছিলেন এই মানুষটি। একেবারেই নিজের চেষ্টায় লড়াই করতে করতে মেধার জোরে উঠে এসেছিলেন তিনি। সেই ষাট দশকে মাগুরার শ্রীপুর থানাতে মেট্রিক পরীক্ষাকেন্দ্র পর্যন্ত ছিল না । তখন মহকুমাতে এসে পরীক্ষা দিতে হতো। শ্রীপুর থানা সদরের আশপাশের গ্রাম থেকে মাগুরাতে আসতে হতো টানা বারো থেকে চৌদ্দকিলোমিটার রাস্তা। এসব প্রতিকূলতা জয় করেই তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন।
কর্ম আর সততার এক অনন্য উদাহরণ ড. এম.এ. জলিল। সরকারি চাকুরি জীবনে সারাজীবনে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন একনিষ্ঠভাবে। রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা করেননি এক মিনিটের জন্যেও। রাষ্ট্রের কাছ থেকে যতুটুক নিয়েছেন তার চেয়ে ঢের রাষ্ট্রকে প্রাণখুলে দিয়েছেন। কখনই গাড়ি-বাড়ির চিন্তা করেননি। কিছু পাননি বলে হা পিত্যেশ করেননি। দায়িত্বে অবিচল থেকেছেন একনিষ্ঠভাবে। সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন থেকেও সারাজীবনই পরিশীলিত পরিমিত জীবনযাপন করেছেন। রাষ্ট্র বা সরকার থেকে কোনোকালে কোনো সময় অনৈতিক সুযোগ নেওয়াতো দূরে থাক, বরং নিজের প্রাপ্য সুযোগটুকুও উপেক্ষা করেছেন নির্বিবাদে। অবারিত সুযোগ থাকার পরেও সরকারের ফ্লাট, প্লট নেওয়ার জন্য কোনোদিন দৌড়াদৌড়ি করেননি। নীতি নৈতিকতার কাছে অনড় থেকে কারো কাছে হাত পাতেননি। উল্টো নিজের পেনশনের টাকা তুলতে রিকশা, বাসে চড়ে ব্যাংকে গিয়েছেন, আর দশটা মানুষের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। গাড়ি, বাড়ির চেয়ে উনি ভালবাসতেন কাজ করতে। যশোর-মাগুরার ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুসন্ধান করা, মাগুরা, শ্রীপুরের কোন লাইব্রেরিতে নুতন কী বই পাঠাবেন, শ্রীপুরের দ্বারিয়াপুরে সাধক-পীর তোয়াজউদ্দিন পাঠাগার আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবে যাবেন-এসব যেনো উনাকে বেশি টানতো।
ড. এম.এ. জলিল ভীষণরকম শুধু কর্মপ্রিয়ই নয় অনেকটা গণমুখীও ছিলেন। মানুষের সাথে নিরবে মিশতে, কথা বলতে চলতে ভালবাসতেন। নিজের ব্যক্তিগত অনেক কাজ তুচ্ছ করে তিনি সমষ্টির জন্যেই আত্মত্যাগ করতে ভালবাসতেন। বহুমাত্রিক কাজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। এ কারণেই যশোর বা মাগুরাবাসীর দুর্দিনে সবসময় পাশে থেকে সুপরামর্শ দিয়েছেন। বৃহত্তর যশোর জেলা সমিতি ও মাগুরা জেলার সমিতির সাথে তিনি জড়িত ছিলেন মৃত্যুঅব্দি। সমিতির নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব তাঁকেই কমবেশি পালন করতো হতো। আবার সমিতি থেকে স্মরণিকা, সুভেনির যেগুলো বের হতো সেখানে তাঁর হাতের স্পর্শ লেগেই থাকতো। লেখা তৈরি, সম্পাদনা, প্রুফদেখা এসব কাজ করতেন ভালবাসতেন। প্রফুল্ল হ্নদয়ে আনন্দচিত্তে এসব কাজ করতেন। এসব কাজে সর্বশেষ নির্ভরতা ছিলেন তিনিই। সাংস্কৃতিক ও সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ হওয়ার কারণে সবকিছুতেই বিদগ্ধরুপ দিতে তিনি আপোষহীন থাকতেন।
মননে-চিন্তায় আধুনিক এই অনন্য আলোকিত মানুষ সবসময়ই পরিবার থেকে শুরু করে পরিচিত বলয়ে সৃষ্টি আর বিদগ্ধতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ কারণেই বোধ হয় তাঁরই ছোটকন্যা তাহসীনা শাহীনের ফ্যাশন হাউস ‘সাদাকালো’ আজ পৃথিবীময় বিখ্যাত হয়েছে। ‘সাদাকালো’র পোশাকের কদর আজ সর্বত্র। শুধু ছোটকন্যা তাহসীনা শাহীন বলে নয়, তাঁর চারকন্যাই আজ প্রতিষ্ঠিত। চারজনই আলো ছড়িয়েছেন নিজ নিজ ভূবণে। তাঁর আরেক কণ্যা লুনা শিরীন, কানাডা প্রবাসী। নিয়মিত লেখালেখি করেন প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। অন্য দুইকন্যাও আমেরিকা প্রবাসী। এই কৃতিমানকে পরিপূর্ণতা দিতে নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখেন তাঁর স্ত্রী হাজেরা বুলবুলি।
ড. এম.এ. জলিল শায়িত হয়েছেন বরিশাট নিজগ্রামে পিতা-মাতার কোলেই। যে গ্রাম থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন নগরে, সেই নগর ছেড়ে তিনি আবার ফিরে গেছেন নিজগ্রামে তাল-তমালের ছায়ে। করোনা দুর্যোগের কাল না থাকলে অসংখ্যজন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন তাঁর কফিনে। সেই আফসোসটুকু সবার থেকেই গেল। বিত্তবৈভবের এইযুগে নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর এই আলোকিতজন সততা এবং জ্ঞানশক্তির যে অনন্যতা রেখে গেলেন তা মূল্যায়িত হবেই। শেষবয়সেও এসেও মানুষ কতোটা কর্মমূখর, প্রাণবন্ত থাকতে পারে তাঁর অনন্য উদাহরণ তিনিই। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর জীবনের গল্পগুলো আমরা যত তুলে ধরতে পারব ততই এ প্রজন্ম জ্ঞানে-গরিমায়, আদর্শে ঋদ্ধ হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)