নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোর এবং উঠতি তরুণদের চলমান আন্দোলন খুব শিগগিরই জনগণের বিরক্তির কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে। কেননা বিভিন্ন সড়কে তাদের হাতে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ যেভাবে নাজেহাল হচ্ছে, সেটি কোনোভাবেই শিক্ষার্থীসুলভ নয়। সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসব চিত্র দেখেছি।
তাছাড়া যদি তারা এভাবে রাস্তায় দীর্ঘমেয়াদে অবস্থান করে এবং যান চলাচল ব্যাহত হতে থাকে, তাতে শ্রমিক-শিক্ষার্থী মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। তখন পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠবে এবং সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে। কোনো একটি পক্ষ সম্ভবত সেটিই চাচ্ছে। কারণ জনদাবিতে গড়ে ওঠা অনেক আন্দোলনে তৃতীয়পক্ষ বা সুবিধাবাদীরা ঢুকে আন্দোলনের চরিত্র পাল্টে দেয় এবং বিতর্কিত করে—তার নজির আমাদের সামনে আছে। সুতরাং এ মুহূর্তে কী করণীয়?
আমাদের দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান যে ঠিকমতো চলে না, সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যে নিজেদের কাজটা ঠিকমতো করেন না এবং দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সব প্রতিষ্ঠানই যে লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত—সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণের লোক কম। যে কারণে যখনই দেশে বড় কোনো ঘটনা ঘটে, তখনই সেখানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়। ফলে এখন সময় এসেছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করে ঘরে ও ক্লাসে ফেরাতেও প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য এবং ঘোষণা অত্যন্ত জরুরি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন সংবেদনশীল মানুষ। একজন শিল্পীর জন্মদিনে টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে ফোন করে তাকে শুভেচ্ছা জানানোর মতো হাল্কা বিষয় থেকে শুরু করে বিডিআর বিদ্রোহের চলাকালীন ইস্পাতদৃঢ় অবস্থান—সবকিছুতেই তিনি পারদর্শী। ফলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী যদি এখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলেন, তাহলেই তারা রাস্তা ছেড়ে যাবে। কেননা, তাদের এখন রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার বিকল্প নেই। মানুষের বিরক্তির কারণ হবার আগেই তাদের ক্লাসে ফেরা বাঞ্ছনীয়। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের যদি পরিবহন শ্রমিকদের মুখোমুখি করে দেয়া হয় বা এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে কোনো পক্ষ ভিন্ন কোনো স্বার্থ হাসিল করতে চায়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
সুতরাং এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিতে পারেন যেখানে তিনি কয়েকটা বিষয় রাখতে পারেন। যেমন:
১. প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, যে দাবিতে তোমরা রাস্তায় নেমেছ, তাতে আমার নৈতিক সমর্থন আছে। কোন পরিস্থিতিতে তোমরা ক্লাসরুম ছেড়ে বৃষ্টিতে ভিজে এই আন্দোলন করছ, তা আমি জানি। তোমরা তোমাদের প্রিয় সহপাঠীদের হারিয়েছো। স্বজন হারানোর বেদনা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ঘাতকের বুলেট আমার পুরো পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যে অগণিত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তা কারোরই কাম্য নয়।
২. আমি শুধু এটুকু বলব, তোমরা যেসব দাবি জানিয়েছো, আমরা এরইমধ্যে সেসব দাবি পূরণ শুরু করেছি। প্রতিটি স্কুল সংলগ্ন সড়কে স্পিডব্রেকার নির্মাণ, বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগেরও সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। সড়কের নিরাপত্তায় নতুন আইন হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, এই আইন হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
৩. আমরা বিআরটিএকে দুর্নীতিমুক্ত করব যাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির ফিটনেস প্রক্রিয়া ত্রুটিমুক্ত হয়।
৪. ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ঘুষখোর আর দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৫. ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থায় যে দুষ্টচক্র আছে, সেটিকে আমরা চিহ্নিত করে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসব। ফিটনেসবিহীন কোনো গাড়ি রাস্তায় চলবে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালাতে পারবেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরতে পারলে সাথে সাথে তার বিচার হবে।
৬. আমি আগেও বলেছি, দূরপাল্লার বাসে দুজন ড্রাইভার রাখতে হবে। একজন ড্রাইভার একটানা ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবেন না। এ বিষয়ে আমি মালিকদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিচ্ছি, যদি কেউ এই পদ্ধতি না মানে, আমরা সেই বাসের রুট পারমিট বাতিল করে দেব।
৭. পরিবহন শ্রমিকদেরও অনেক ক্ষোভ আছে। তারা খুবই অল্প বেতন পায়। যে কারণে উপরির আশায় তারা বেশি বেশি ট্রিপ দিতে গিয়ে রাস্তায় বেপরোয়া হয়। এ বিষয়ে কী করা যায়, সেটি আমরা ভাবছি। আমরা এটি নিয়ে মালিকদের সাথে শিগগিরই বসব।
৮. বাসের যারা হেলপার, তাদেরও একটা ন্যূনতম শিক্ষাদিক্ষা থাকা দরকার বলে আমি মনে করি। আমরা যে নতুন আইন আনছি, সেখানেও বিষয়টা আছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, বাসের চালক হেলপার কন্ডাকটররাও আমাদেরই ভাই, আমাদের স্বজন। আমরা কেউ কারো প্রতিপক্ষ নই।
৯. পরিবহন খাতে একটা বড় সিন্ডিকেট আছে, এরকম অভিযোগ আমরা সব সময়ই শুনি। এই সিন্ডিকেটের কবল থেকে পরিবহন খাত কিভাবে মুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আমরা ভাববো।
১০. আমরা সকলেই চাই, দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। সড়ক দুর্ঘটনায়, বেপরোয়া বাসের চাপায় খালি আর একটি মায়ের কোলও যেন খালি না হয়। আমি তোমাদের অনুরোধ করি, তোমাদের দাবি যেহেতু আমরা মেনে নিয়েছি, তাই তোমরা ঘরে ফিরে যাও, ক্লাসে ফিরে যাও। রাস্তা তোমাদের জায়গা না। অভিভাবকদেরও আমি অনুরোধ করি, আপনারা আপনাদের সন্তানদের বোঝান। সবার জীবন আমাদের কাছে মূল্যবান।
আমার কাছে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী এরকম একটি বক্তৃতা দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। না হলে যারা এই আন্দোলন পুঁজি করে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই জয়ী হবে। হেরে যাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)