চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রথম বিএমএ ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর দীপ্তময় ভাষণ আজও চিরভাস্বর

পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে একটি স্বাধীনতাকামী দেশ হিসাবে নিজেদেরকে পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক কাঠামো সংক্ষিপ্ত আকারে কাজ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের পূর্নাঙ্গ রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটে ’৭১এর ১৬ ডিসেম্বরের পর। ‘মূলধারা ৭১’ বইটি থেকে জানা যায়, যুদ্ধোত্তর সময়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে সাথে বঙ্গবুন্ধ শেখ মুজিবর রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন ও আন্তজার্তিক ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছিলো। একই সময় অর্থ্যাৎ ’৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে দ্রুত সংগঠিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি ভারতের ডিপি ধরের সাথে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কার্যকর করার পর দুই তিন মাসের মধ্যেই যে সব ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের ভিতরে অবস্থান করছে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। এলক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্প্রসারনের জন্য নতুন অফিসারদের প্রশিক্ষণ প্রদান অতীব জরুরী হয়ে পড়ে। ফলে ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রীসভা ‘জাতীয় দেশ রক্ষা একাডেমী’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ প্রতিষ্ঠিত হয় যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। পরবতীতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য সেনাবাহিনীকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা অনস্বীকার্য বলে ‘বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী’ গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

১৯৭৪ সালের ১১ই মার্চ কাজী নজরুল ইসলামের “ চির উন্নত মম শির ” এই দৃপ্ত শপথকে বুকে ধারন করে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের মিলিটারী একাডেমীর উদ্বোধন করেন। আর সেদিন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী আরেকটি নতুন যুগে পদার্পণ করল দেশরক্ষার অতন্দ্র প্রহরীর প্রদীপ জ্বালিয়ে।

এর ঠিক দশ মাস পর এই একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অফিসারদের প্রথম দল বের হয়ে আসে ভবিষ্যতের এক সোনালী স্বপ্ন নিয়ে। সেদিন কুমিল্লা সেনানিবাসের এক গাম্ভীর্য পূর্ণ পরিবেশে প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ক্যাডেটরা বীরদর্পে, সুসজ্জিতভাবে মার্চপাস্ট করে ও গার্ড অব অনার প্রদান করে জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শপথ অনুষ্ঠান ও অন্যান্য আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণের প্রতিটি শব্দে ছিল, নতুন দেশের নতুন সেনা সদস্যদের প্রতি আদেশ-উপদেশ এবং স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার। সর্বপরি ভাষণটিতে দৃপ্তময় বাণী ছিল সারা দেশবাসীর জন্যও।
এই ভাষণে বঙ্গবুন্ধ শুধু যে সেনা সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলেছেন তা নয়; একই সাথে তিনি সমগ্র জাতিকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিত সম্পর্কে অবহিত করেছেন। নতুন দেশের জন্মলগ্নেই আভ্যন্তরীন ও বহিঃবিশ্বের নানা ধরনের কু-পরিকল্পনা ও অপকর্মকে নসাৎ করার জন্য দেশের জনগণকে সজাগ হতে যেমন বলেছেন তেমনি সেনাবাহিনী ও সাধারন জনগনকে নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য কাজ করার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রয়োজনে বাঙালী জাতিকে আবারো প্রতিবাদী হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁনোর আদেশ দিয়েছেন। জানিয়েছেন সেই প্রতিবাদের সম্মুখভাগে থাকবেন তিনি; যেমন ছিলেন ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তেমনি থাকবেন সোনার বাংলা গড়তেও। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের মাত্র তিন বছর বয়সের মধ্যেই কিছু মানুষের হীনস্বার্থ চরিতার্থের কারনে সাত কোটি মানুষের যে দুর্দশা হয়েছিলো তা যেমন জাতির পিতাকে করেছে ব্যথিত তেমনি তা মনোকষ্টের কারন হয় দেশ প্রেমিক যেকোন মানুষের।

র্দুভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের মানুষ আজো ’৭১এ পাওয়া স্বাধীনতাকে ধারণ করে আছে এবং থাকবে আজীবন; কিন্তু হারিয়েছে সেই বলিষ্ঠ অঙ্গীকারবদ্ধ জাতির পিতাকে, যার নেতৃত্বেই এসেছিল দেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ভাষণটি প্রদানের মাত্র সাত মাস পরে কতিপয় দেশদ্রোহী ও লোভী মানুষের নৃংশতায় শুধু বঙ্গবুন্ধ নয় তাঁর পরিবারকেও কেড়ে নেয়া হয় বাংলার মাটি থেকে। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাঙালী জাতি বিশ্বে যেমন হয়েছে প্রশংসিত তেমনি জাতির পিতা ও তার পরিবারের জীবন কেড়ে নিয়ে হয়েছে ঘৃণিত।

নতুন প্রজন্ম যদি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিকে যথাযথভাবে উপলদ্ধি করতে পারে তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ধারন করা তথা বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাসটি তাদের সামনে উন্মোচিত হবে সহজেই।

ভাষণে সেদিন জাতিরপিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন –
“বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রধান, বিএমএ’র কমান্ডার, আমার ক্যাডেট ভাইয়েরা আপনারা সকলেই আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। বহুকাল সংগ্রাম করেছিলাম বাংলাদেশে মিলিটারি একাডেমি হোক, কিন্তু আমরা পারি নাই তখন। আজ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই জন্যই আজ বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি স্থাপিত হয়েছে। আমি স্মরণ করি, সেই সমস্ত শহীদ ভাইদের যারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে, আত্মাহুতি দিয়েছে। আমি স্মরণ করি, বাংলার ত্রিশ লক্ষ লোক রক্ত দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা এনেছে। আজ সত্যিই গর্বে আমার বুক ভরে যায়। এজন্যই বাংলাদেশের মালিক আজ বাংলাদেশের জনসাধারন। সেই জন্যই সম্ভব হয়েছে, আজ আমার নিজের মাটিতে একাডেমি করার। যখন আমি আশা করি, ইন্শাআল্লাহ এমন দিন আসবে, এই একাডেমির নাম শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয় সমস্ত দুনিয়াতে সম্মান অর্জন করবে। তোমাদের মনে রাখা উচিত, ক্যাডেট ভাইরা, আজ তোমরা তোমাদের ট্রেনিং শেষ করলা।

এক পর্যায় শেষ আরেক পর্যায় শুরু। এ পর্যায় দায়িত্ব অনেক বেশী। আজ তোমরা ট্রেনিং সমাপ্ত করে সামরিক বাহিনীর কর্মচারী হতে চলেছ। জাতির উপর তোমার দায়িত্ব, জনগণের উপর তোমার দায়িত্ব, দেশের উপর তোমার দায়িত্ব এবং যে সমস্ত সৈনিকদের তোমরা আদেশ-উপদেশ দিবে, পরিচালনা করবা তাদের উপর দায়িত্ব, তোমার কমান্ডারের উপর তোমার দায়িত্ব, তোমার নিজের উপর তোমার দায়িত্ব; তোমাদের দায়িত্ব জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তা না হলে জীবনে মানুষ হতে পারবা না। শৃঙ্খলা ছাড়া কোন জাতি জীবনে বড় হতে পারে নাই। আমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবো, আজ এই একডেমির আমাদের কিছুই নাই ধরতে গেলে; আমরা সামান্য কিছু দিয়ে শুরু করেছিলাম। অনেক অসুবিধার মধ্যে তোমাদের ট্রেনিং নিতে হয়েছে। সব কিছু তোমাদের আমরা দিতে পারি নাই। তোমাদের কমান্ডররা অনেক কষ্টের মধ্যে তোমাদের ট্রেনিং দিয়েছে। কিন্তু আজ যা আমি দেখলাম, তাতে আমি বিশ্বাস করতে পারি, যদি পূর্ণ সুযোগ সুবিধা দেওয়া যায়, তো আমার ছেলেদের এই শক্তি আছে যেকোন দেশের যেকোন সৈনিকের সঙ্গে তারা মোকাবেলা করতে পারে। তবে একদিনে কিছুই হয় না। এই তিন বছর হলো স্বাধীনতা পেয়েছি। যতটুকু দরকার চেষ্টার ত্রুটি করা হয় নাই। এমনকি নিজে চেষ্টা করেও জোগাড় করে রিলিফ দেয়ার কাজ আরম্ভ করা হয়েছে।

তোমরা জানো না, তোমরা ছোট ছিলে, স্কুলে পড়তা বা তোমরা বাচ্চা ছিলে, পাকিস্তানীরা দুনিয়াকে বুঝিয়েছিল যে, বাঙ্গালীরা নাকি যুদ্ধ করতে জানে না এবং সেই জন্যই তারা বাঙ্গালীদের সৈন্য বাহিনীতে নিত না। আমার মনে আছে, বহু আগে, আইয়ুব খান স্বয়ং কমান্ডিং এ্যাডজুডেন্ট ছিলেন, তিনি গোপনে সার্কুলার দিয়েছিলেন যে, বাঙ্গালীদের ২% এর বেশী নেওয়া যেন না হয়। সেই কাগজ যেভাবেই হোক আমি পেয়ে যাই। আর তাই নিয়ে আমি তোলপাড় শুরু করি, যদিও সেই হুকুম তারা উইথড্র করেন, কিন্তু ছলে-বলে-কৌশলে বাঙ্গালীদের দাবিয়ে রেখেছিলেন। বাঙ্গালীরা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে পারে না, বাঙ্গালীরা কাপুরুষ, বাঙ্গালীরা যুদ্ধ করতে জানে না; পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলার মাটিতে দেখে গেছে যে, কেমন করে বাঙ্গালীরা যুদ্ধ করতে পারে এবং মুক্তিবাহিনীদের ভয় পেয়ে তাদের বড় বড় শক্তিয়ালা, ভুড়ীয়ালাদের জান শেষ হয়ে গিয়েছে।

আমরা বাঙ্গালীরা কাপুরুষ নই। আমি আমার মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে পারি, যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালীরা পরাধীন ছিল, দুইশ’ বছর ইংরেজদের কাছে আমরা পরাধীন ছিলাম, ২৫ বচ্ছর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু দল ছলে-বলে-কৌশলে আমার বাংলার মাটিকে দখল করে শোষণ করেছিল। এই ক্যান্টনমেন্টে বাঙ্গালীদের স্থান ছিল না। যাওয়ার সময় বাঙ্গালীদের রাস্তায় অপমান করা হতো। আমার নিজের জানা আছে, যখন আমি এইখান দিয়ে কোন সময় গাড়ি নিয়ে পাস করেছি, সমস্ত শরীর আমার জ্বলে উঠতো। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, দুশমনদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। অনেক ব্যাথা, অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক জুলুম, অনেক মামলার আসামী, অনেক কারাগারে নির্যাতন আমি শুধু নই, হাজার হাজার কর্মী সহ্য করে বাংলার মাটিকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করেছে।

তোমাদের একটা জিনিষ মনে রাখা দরকার, দেশ যখন আমার আছে, মাটি যখন আমার আছে, বাংলার সোনার মানুষ যখন আছে, যদি আমরা সোনার ছেলে পয়দা করতে পারি ইন্শাআল্লাহ আমার যে স্বপ্ন সোনার বাংলা তা একদিন হবে। আমি দেখে না যাওয়ার পারি কিন্তু ইন্শাআল্লাহ হবে। আজ ইন্শাআল্লাহ বাংলার সম্পদ আর কেউ লুট করে নিবার পারবে না। বাংলার মাটিতে বাংলার সম্পদ থাকবে। বাংলার মানুষ ভোগ করবে। যে জাতির ত্রিশ লক্ষ লোক রক্ত দিতে পারে স্বাধীনতার জন্য সেই জাতি দরকার হলে কোটি লোকের জীবন দেবে বাংলার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য।

ছেলেরা আমার, তোমরা নতুন জীবনে যাচ্ছো, মনে রেখ, তোমরা এক একজন সামরিক কর্মচারী, যাদের নিচে থাকবে সৈনিক বাহিনী, তাদের কাছেও অনেক শেখার আছে, তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের জানতে হবে, সুখের সময়-দুখের সময় দাঁড়াতে হবে, তদের পাশে থাকতে হবে। মনে রেখ, ‘শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে।’ তুমি যখন শাসন করবা সোহাগ করতে শেখ। তাদের দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়িও। তাদের ভালোবেসো। কারন তোমার হুকুমে সে জীবন দেবে। তোমাকে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। সেই শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে তোমাকে শৃঙ্খলা শিখতে হবে। নিজকে সৎ হতে হবে। নিজের দেশকে ভালোবাসতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে এবং চরিত্রও ঠিক রাখতে হবে। তা না হলে কোন ভালো কাজ করা যায় না।

মনে রেখ, আজ তোমরা আমার প্রথম ক্যাডেট বাংলাদেশের মিলিটারি একাডেমির, তোমাদের দেখবে ভবিষ্যৎ ছেলেরা যারা আসবে। তোমাদের কাছে তারা শিখবে। আমার মুখ কালা কোরো না। দেশের মুখ কালা কোরো না। সাড়ে চার কোটি মানুষের মুখ কালা কোরো না। তোমরা আদর্শবান হও। সৎ পথে থেকো। মনে রেখ, ‘মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’ মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই।

এতো রক্ত দেয়ার পরে যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোররা বাংলার দুখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, ‘চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।’

কিন্তু আর না, বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। কাল যখন আমি আসতেছিলাম ঢাকা থেকে এতো দুঃখের মধ্যে না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে বাস করতেছে, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখবার জন্য। আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি, তোমরা আমাকে এতো ভালোবাস কেন? কিন্তু সেই দুঃখী মানুষ দিন ভরে পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, যার পেটে খাবার নাই, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত নাই, লক্ষ লক্ষ বেকার, পাকিস্তানীরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে, কাগজ ছাড়া আমার জন্য কিছু রেখে যাই নাই, বিদেশ থিকা ভিক্ষা কইরা আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে বা লুটতরাজ করে খায়। আমি শুধু এমার্জেন্সি দেই নাই এবার আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যদি ২৫ বছর এই পাকিস্তানী জালেমদের মধ্যে জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বুকের উপর টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি আর আমার ত্রিশ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি তাহলে পারবো না! নিশ্চয়ই, ইন্শাআল্লাহ পারবো এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোরী, এই চোরাচালানদের নির্মূল করতে হবে।

আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও বাংলার জনগণও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করুক। আর না, অসহ্য, সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এই জন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই। এই জন্য শহীদরা রক্ত দিয়ে যায় নাই। কয়েকটা চোরা কারবারী, মুনাফাখোরী, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বাইর করে দিয়ে আসে। জিনিষের দাম, গুদাম করে মানুষকে না খাওয়ে মারে। উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকে থেকে এদের। দেখি কতদিন তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশী না ঈমানদারের শক্তি বেশী সেই প্রমাণ হয়ে যাবে।

অন্যায়ের কাছে কোনদিন মাথা নত করি নাই। বারবার পাকিস্তানী আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে, বারবার বুক টান করে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি; কারন আল্লাহ আমার সহায় ছিল, বাংলার জনগণের আমার দোয়া ছিল, এখনো সেই দোয়া আছে। ইন্শাআল্লাহ তোমাদের সাহায্য, তোমাদের সহানুভূতি, তোমাদের কাজ, দেশের জনগণের ভালোবাসা, আর ঈমানদার মানুষের সহযোগিতায় এই দুষ্কৃতিকারীদের নিমূর্ল করতে হবে।

আর একদল আছে যারা বিদেশীর অর্থে বাংলার স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে চায়। রাতের অন্ধকারে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, যারা বিদেশী আদর্শ বাংলার মাটিতে চালু করতে চায়, তাদের বাংলার মাটিতে স্থান হবে না। মনে রেখো তোমরা, তাদের সেই বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে। কেমন করে একটা লোক নিজের দেশের মাতৃভূমিকে বিক্রি করতে পারে পয়সার লোভে ভাবলে আমি শিহরিয়া উঠি।

তোমরা মনে রেখো আমার ছেলেরা, জীবনে তোমরা যে কাজে নেমেছ, উপরে যারা তোমার হুকুম দেবে তোমরা ওয়াদা করলা এখনই তাদের হুমুক মানতে হবে। তুমি যদি তাদের হুকুম না মানো নিচে যারা তোমার আছে তারা তোমার হুকুম মানবে না। সেই জন্যই তোমাকে হুকুম মানতে হবে। আমি তোমাদের প্রধানমন্ত্রী, আসতে পারে অনেক, প্রধানমন্ত্রী যেতে পারে অনেক, আমি তোমাদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কথা বলছি না, আমি তোমাদের জাতির পিতা হিসেবে আদেশ দিচ্ছি, কারন জাতির পিতাই একবারই হয় দু’বার হয় না। প্রধানমন্ত্রী অনেক হবে, অনেক আসবে, প্রেসিডেন্ট অনেক হবে, অনেক আসবে, কিন্তু সেই হিসেবে তোমাদের আমি ভালোবাসি তোমরা জান। তোমরা সৎ পথে থেকো। মাতৃভূমিকে ভালোবেসো।

মনে রেখো, তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানী মেনটালিটি না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও। তোমরা বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবা আমার পিপলস আর্মি। তোমরা পেশাদার বাহিনী নয়। তোমরা শুধু সামরিক বাহিনী নও। তোমাদের দরকার হলে নিজে উৎপাদন করে খেয়ে তোমাদের বাঁচতে হবে। এটা হবে আমার জনগণের বাহিনী। এটা হবে পিপলস আর্মি। এটা পাকিস্তানের পেশাদারি আর্মি হবে না। এদিকে তোমাদের খেয়াল রাখা দরকার। আর যেখানে অন্যায়, অবিচার দেখবা চরম আঘাত করবা। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবা। গুরুজনকে মেনো। সৎ পথে থেকো। শৃঙ্খলা রেখো। তাহলে জীবনে মানুষ হতে পারবা। এটা তোমাদের ভুললে চলবে না।
ইন্শাআল্লাহ আমি গর্বিত। আমি যেমন আমার সামরিক বাহিনীকে স্মাগলিং বন্ধ করার হুকুম দিলাম। আমি নিশ্চয়ই আজ গর্ব করে বলতে পারি ২৫ বছরে স্মাগলিং বন্ধ করতে পারে নাই কিন্তু ইন্শাআল্লাহ এবার শতকরা ৯৫ ভাগ স্মাগলিং আমার সামরিক বাহিনী বন্ধ করতে পেরেছে বিডিআরের সাহায্য নিয়ে। তাদের জনগণের সহযোগিতার প্রয়োজন।

মনে রেখো, জনগণ কারা? তোমার বাপ, তোমার ভাই। তোমাদের যে মায়না আসে, কোত্থেকে আসে? সরকারী-বেসরকারী কর্মচারী, যারা এখানে আছেন, তাদের সকলের বেতন আসে বাংলার দুঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদের সেবক। তাদের অর্থে তোমাদের সংসার চলবে। তাদের শ্রদ্ধা করতে শিখো। তাদের ভালোবাসতে শিখো। নিশ্চয়ই যেখানে অন্যায় হবে সেখানে দমন করবা। কিন্তু নিরাপরাধ লোকের উপর যেন অন্যায় না হয় সেদিকে খেয়াল রেখো।

তোমাদের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল। আজ তোমরা বুঝতে পারবা কিনা আমি জানি না; কিন্তু আমার মনে যে কি আনন্দ তোমাদের আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কিন্তু আমি কোন দিন ভাবি নাই, যখন আমি আগরতলায় বন্দি ছিলাম, যখন পাকিস্তানে মেওয়ালী বন্দি ছিলাম, আমি ভাবি নাই যে, তোমাদের এভাবে প্যারেড হবে, আমার বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হবে এবং তা আমি দেখে যাবো। এ জানতাম যে হবে, ইন্শাআল্লাহ হবে, এ বিশ্বাস আমার ছিল, কিন্তু দেখে যাবো এ আমি ভাবি নাই। কিন্তু আল্লাহ আমাকে দেখালেন। আরো দেখতে চাই। সে কি জানো? সোনার বাংলা দেখতে চাই। আরো দেখতে চাই। কি জানো? দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আরো দেখতে চাই। এ দেশের দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, গায়ে কাপড় পোড়–ক, অত্যাচার-অবিচার, জুলুম বন্ধ হয়ে যাক। এইটা আমি দেখতে চাই। এই জন্য সকলের কাছে আমার আবেদন, আজ তোমাদের প্লাট ফরম থেকে সামরিক বাহিনী, বেসামরিক বাহিনী, জনগণ সকলকে আবেদন করবো, সংঘ বদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো আর দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করো। কাজ করবো না, পয়সা দাও, ফ্যাক্টরীতে কাজ করতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। কলে কারখানায় কাম করতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। লাফালে চলবে না। লাফানো আর আমি এ্যালাউ করবো না। তিন বছর করেছি আর নয়, কারন দেশের সম্পদ বাড়ানো না হলে দেশের মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই আজকে এই একাডেমি, তোমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে আমি জানি। অনেক দুঃখের মধ্যে তোমাদের শিখতে হয়েছে, তোমাদের কমান্ডারদের বহু কষ্ট করে তোমাদের শেখাতে হয়েছে। অনেক অসুবিধা তোমাদের আছে। একদিনে হয় না। যারা তোমার পুরানা এখানে সামরিক বাহিনীর লোকেরা আছে, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা কোরো যে, ’৪৭ সালে বাংলাদেশে কি ছিল? সেই যুগে আমার টাকা দিয়ে পাকিস্তানীদের একাডেমি করেছিল তার বা অবস্থা দশ বছর পর্যন্ত কি ছিল? আমি নিশ্চয়ই আনন্দিত যে, তিন বছরের মধ্যে কিছু বন্দোবস্ত আমি আমার সামরিক বাহিনীর জন্য করতে পেরেছি, সকলের জন্য করতে পেরেছি। অনেক দিন লাগে, একটা একাডেমি একদিনে গড়ে তোলে না। অনেক প্রয়োজন, ইন্শাআল্লাহ হবে, ভালো ভাবে হবে। এমন হবে যে, দুনিয়ার মানুষ দেখতে আসবে আমার একাডেমিকে এই বিশ্বাস আমি রাখি।
তোমরা, তোমাদের কাছে আমার শুভেচ্ছা রইল। আমার আদেশ তোমরা মনে রেখ। আমার স্নেহের  আবেদন তোমরা মনে রেখ। আমি তোমাদের দোয়া করবো। বাংলার জনগণ তোমাদের দোয়া করবে। তোমরা আমার ফাস্ট ব্যাচ। তোমরা কাল থেকে সরকারী অফিসার হয়ে যাবা। তোমরা আদর্শ সৃষ্টি কোরো যাতে তোমাদের যারা ফলো করে আসবে তারাও যেন আদর্শবান হয়। তোমাদের উপর আমার এই বিশ্বাস আছে। আমি তোমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আমার চিফ ্অব স্টাফদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি কমান্ডাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যারা ইন্সট্রাক্টর ছিল তাদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি আর যারা সহযোগিতা করেছিল তাদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এবং ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ ! স্বাধীন দেশে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি এই স্বাধীনতা নিশ্চয়ই ইন্শাআল্লাহ থাকবে। কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। তবে স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পার। সেই জন্য তোমাদের কাছে আমার আবেদন রইল সৎ পথে থেকো, খোদা নিশ্চয়ই তোমাদের সাহায্য করবে। বিদায় নিচ্ছি। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা। ধন্যবাদ।”

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)